আব্দুল হক (আফগান নেতা)

আফগান মুজাহিদিন কমান্ডার

আব্দুল হক (জন্ম হুমায়ুন আরসালা; এপ্রিল ২৩, ১৯৫৮ – অক্টোবর ২৬, ২০০১) ছিলেন একজন আফগান মুজাহিদিন কমান্ডার, যিনি পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তানের পক্ষে ১৯৮০’র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। ২০০১ সালের অক্টোবরে তালিবানরা তাকে হত্যা করে।[১]

আব্দুল হক
আব্দুল হক
জন্ম(১৯৫৮-০৪-২৩)২৩ এপ্রিল ১৯৫৮
নাঙ্গারহার, আফগানিস্তান
মৃত্যু২৬ অক্টোবর ২০০১(2001-10-26) (বয়স ৪৩)
পূর্ব আফগানিস্তান
কার্যকাল১৯৭৭–২০০১
যুদ্ধ/সংগ্রামসোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ

প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা

হক আফগানিস্তানের নাঙ্গাহার প্রদেশের ছোট গ্রাম সিইডানে জন্মগ্রহণ করেন, যদিও তারা পরে হেলমান্দ প্রদেশে স্থানান্তরিত হন। তার বাবা, মোহাম্মাদ আমান হেলমান্দে একটি নির্মাণ সংস্থার প্রতিনিধি ছিলেন এবং আফগানিস্তানের অবস্থা অনুযায়ী অপেক্ষাকৃতভাবে ধনী ছিলেন।[২] তার প্রপিতামহ, ওয়াজির আরসালা খান একসময় আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। আব্দুল হকের চাচাত ভাই হেদায়াত আরসালা বিশ্বব্যাংকের পরিচালক হিসেবে ওয়াশিংটনে কর্মরত ছিলেন এবং পরে হামিদ কারজাইয়ের শাসনামলে তিনি আফগানিস্তানের উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।[৩]

হকের জ্যেষ্ঠ দুই ভাই হলেন হাজী দীন মোহাম্মাদ আর আব্দুল কাদির এবং কনিষ্ঠ ভাই নসরুল্লাহ বারইয়ালাই আরসালাই। আব্দুল কাদির প্রথমদিকে হামিদ কারজাইয়ের সমর্থক ছিলেন এবং ২০০২ সালে নিহত হওয়ার পূর্বে তিনি মন্ত্রীসভায়ও জায়গা করে নিয়েছিলেন। হাজি দীন মোহাম্মাদ হলেন হিজব্-ই ইসলামী খালিস দলের নেতা।[৪]

হকের ভাষ্যমতে শৈশবে তিনি ছিলেন অবাধ্য প্রকৃতির। পাঁচ বছর বয়সে তিনি তার বাবা মাকে তাকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য রাজী করান এবং কাজের সময় ঘুমানোর করণে একবার তিনি তার শিক্ষককে আঘাত করেন।[৫] কিডনীর রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫১ বছর বয়সে তার বাবা মারা যাওয়ার একবছর পর দীন মোহাম্মাদ পরিবারের হাল ধরেন[৬] এবং পুরো পরিবার নাঙ্গারহার চলে আস।

এদিকে তিনি ফতেহাবাদে মাদ্রাসায় থেকে লেখাপড়া করেন। ৮ বছর বয়সে তিনি লিচি (ফ্রান্সের সরকারী মাধ্যমিক স্কুল)-তে পড়াশোনা আরম্ভ করেন এবং এখানেই তিনি তার কিছু শিক্ষকদের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিরুদ্ধাচরণ করেন।[৭]

মুজাহিদিন সম্পাদনা

১৯৭৮ সালে হক প্রথমবার মোহাম্মদ ইউনুস খালিসের নেতৃত্বাধীন হিজব্-ই-ইসলামের সাথে আফগান সরকারের বিরুদ্ধে বাইরের কোন সহায়তা ছাড়াই যুদ্ধে অংশ নেন। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় হক কাবুল প্রদেশে মুজাহিদিনের কর্মকান্ডের সমন্বয় করেন।[৪] তার সাহসিকতা ও কৌশলগত দক্ষতার জন্য তিনি সুনাম অর্জন করেন।

হক সেই অল্প সংখ্যক আফগানদের মধ্যে একজন যাদের সাথে সিআইএ’র যোগাযোগ ছিল।[৮] পরে তিনি ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টালিজেন্স (আইএসআই) ও সিআইএ’র সমালোচনা শুরু করেন (তাদের সাথে সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর)।[৯]

হক তার ডান গোড়ালীর কিছু অংশ হারানোসহ বহুবার আঘাতপ্রাপ্ত হন। আঘাতের কারণে তিনি প্রায়ই ঘোড়ায় চেপে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়াই করেন।[১০]

যুদ্ধোত্তর সময় সম্পাদনা

হক ইসলামিক স্টেট অব আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিষয়ক কেবিনেট মিনিস্টার ছিলেন, যা ১৯৯২ সালের এপ্রিলে সমাজতান্ত্রিক নাজিবুল্লাহ সরকারের পতনের পর শান্তি ও শক্তি বিনিময় সমঝোতা পেশওয়ার অ্যাকর্ড অনুযায়ী তৈরী হয়েছিল। গুলবউদ্দীন হেকমাতিয়ার, যাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছি, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে অস্বীকৃতি জানান এবং রাজধানী কাবুলে বিপুল পরিমাণে গোলাবর্ষণ শুরু করেন। হেকমাতিয়ারের হামলা আফগানিস্তানকে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। ঐ সময়ে হক অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেন এবং আফগানিস্তান ছেড়ে দুবাইয়ে বসবাস শুরু করেন, যেখানে তিনি ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।[১০]

১৯৯৮ সালে তিনি জাতিসংঘের পিস মিডিয়েটর নিযুক্ত হন।[১০]

১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে একদল অজানা আক্রমনকারী পাকিস্তানের পেশওয়ারে হায়াতাবাদের হকের বাড়িতে দারোয়ানকে হত্যা করে ঘরে প্রবেশ করে এবং তার স্ত্রী ও এক পুত্রকে হত্যা করে। হামলায় তার অন্য এক পুত্র বেঁচে যায়।[১১]

নর্দান অ্যালায়েন্স সম্পাদনা

 
আব্দুল হক তুষারের ওপর দাড়িয়ে আছেন

১৯৯৯ সালের পুরোটা জুড়েই আহমেদ শাহ্ মাসউদ ও আব্দুল হক তালিবানের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের উপজাতিদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেন। মাসউদ তাজিক, হাজারা এবং উজবেকদের পাশাপাশি কিছু সংখ্যক পাশতুন নেতাদের সংঘবদ্ধ করতে পেরেছিলেন।[১২][১৩] বয়োঃজ্যেষ্ঠ কূটনীতিবিদ্ ও আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ পিটার টমসেন আশা করেছিলেন যে " ‘কাবুলের সিংহ’ [আব্দুল হক] এবং ‘পানশিরের সিংহ’ [আহমেদ শাহ্ মাসউদ] একটি ভয়ানক তালিবানবিরোধী দল গঠন করতে পারবেন, যদি তারা বাহিনীগুলোকে একত্রিত করতে পারেন। হক, মাসউদ, এবং কারজাই, তিন আফগান নেতৃস্থানীয় মধ্যপন্থী পশতুন, অ-পশতুন এবং উত্তর ও দক্ষিণের বিভক্তি দুর করতে সক্ষম হবেন।"[১৪] আফগান রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাইয়ের মত বয়োজ্যেষ্ঠ উজবেক ও হাজরা নেতারা এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন এবং তারা রাজা জহির শাহ্- এর ব্যানারে কাজ করতে সম্মত হয়েছিলেন, যিনি ইতালির রোমে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন।

নভেম্বর ২০০০ সালে, আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশ, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং ভারত থেকে উপজাতিয় নেতারা দক্ষিণ আফগানিস্তানে মাসউদের সদর দপ্তরে একত্রিত হন এবং আফগানিস্তানের সমস্যা ও তালিবান পরবর্তী সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা করে।[১৫][১৬][১৭]

মৃত্যু সম্পাদনা

সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়দার হামলার পর হক তালেবানের বিরুদ্ধে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া থেকে পূর্ব আফগানিস্তানে প্রবেশ করেন। কিছু উৎস অনুযায়ী ধারণা করা হয় যে, সিআইএ তার এই উদ্যোগকে সমর্থন করেছিল কিন্তু তার পরিবার ও অন্য উৎস থেকে[১৮] এই দাবী অস্বীকার করা হয় এবং জানানো হয় সিআইএ মুলত তাকে আফগানিস্তানে প্রবেশ না করতে অনুরোধ করেছিল। সাবেক সিআইএ পরিচালক জর্জ টেনট জানান, বাড ম্যাকফারলেন-এর পরামর্শে সিআইএ প্রতিনিধি দল পাকিস্তানে হকের সাথে দেখা করেন এবং তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করতে পেরে তারা তাকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন।[১৯][১৯] আফগানিস্তানে প্রবেশের পর তালেবান আরও ঊনিশ জনের সাথে তাকে নাঙ্গারহার প্রদেশের হিসারাক ও আজরো শহরের মাঝামাঝি স্থানে আটক করে এবং ২৬ অক্টোবর ২০০১ সালে তাকে হত্যা করা হয়।[৪] দ্য গার্ডিয়ানের তথ্য অনুযায়ী ডাবল এজেন্ট কর্তৃক বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল।[১০] তার মৃত্যুর পর কিছু প্রতিবেদনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রাখার জন্য সিআইএ’কে দায়ী করা হয় যারা আফগানিস্তানকে জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চায়নি এবং হককে তালেবানদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়।[২০]

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Taliban Claims Its Troops Pursuing American Advisor Who Arrived In Afghanistan With Abdul Haq"Pravda। ২০০১-১০-২৭। ২০১০-০৯-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১০RIA Novosti correspondent reports that the Taliban considers the capturing and execution of prominent Pushto field commander Abdul Haq and his 50 followers as their biggest victory. 
  2. Kaplan (1990), পৃ. 145–146
  3. Kaplan (1990), পৃ. 147
  4. Khan, M. Ismail. "Taliban execute ex-guerilla commander: Last moment rescue operation fails", Dawn, October 27, 2001. Retrieved September 25, 2006.
  5. Kaplan (1990), পৃ. 146
  6. Kaplan (1990), পৃ. 67
  7. Kaplan (1990), পৃ. 148
  8. Coll (2004), পৃ. 53–54
  9. Coll (2004), পৃ. 166, 206
  10. Abdul Haq: Veteran Afghan leader seeking post-Taliban consensus rule, The Guardian, October 29, 2001
  11. AFGHANISTAN Detention and killing of political personalities ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৬ তারিখে, Amnesty International, March 1, 1999.
  12. Tomsen (2011), পৃ. 565
  13. "The Afghan Solution"। Lucy Morgan Edwards। ১৫ জুলাই ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ ডিসেম্বর ২০১৮The central theme of the book is Edward's investigation into a major Afghan-led plan for toppling the Taliban: a plan which existed for two years prior to 9/11, and which had buy-in from senior tribal leaders, commanders within the military axis of the Taliban, possibly the Haqqani network, Commander Massoud and senior Taliban who were willing to bring about a new order. The ex King was to provide the 'glue' around which these different groups would coalesce. [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  14. Tomsen (2011), পৃ. 566
  15. "Council of Afghan opposition"। Corbis। ২০০১। 
  16. Marcela Grad। Massoud: An Intimate Portrait of the Legendary Afghan Leader (1 March 2009 সংস্করণ)। Webster University Press। পৃষ্ঠা 65। 
  17. "The lost lion of Kabul"। The New Statesman। ২০১১। 
  18. Afghan Warrior: The Life and Death of Abdul Haq, BBC
  19. Tenet (2007), পৃ. 218
  20. Slavin, Barbara and Weisman, Jonathan. "Taliban foe's death sparks criticism of U.S. goals", USA Today, October 31, 2001. Retrieved September 23, 2006.