অতুলকৃষ্ণ ঘোষ

ভারতীয় বিপ্লবী

অতুলকৃষ্ণ ঘোষ (১৮৯০ - ৪ মে ১৯৬৬)[] একজন ভারতীয় বিপ্লবী, অনুশীলন সমিতির সদস্য এবং যুগান্তর দলের নেতা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হিন্দু জার্মান অস্ত্রসংগ্রহ ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেন।

অতুলকৃষ্ণ ঘোষ
অতুলকৃষ্ণ ঘোষ
জন্ম১৮৯০,
এতমামপুর, জাদুবয়রা, কুষ্টিয়া, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)
মৃত্যু৪ মে ১৯৬৬
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)
পাকিস্তান (১৯৬৪ সাল পর্যন্ত)
ভারত
শিক্ষাএম.এস.সি
পেশারাজনীতিবিদ
পরিচিতির কারণব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী
রাজনৈতিক দলস্বাধীনতার পুর্বে যুগান্তর দল,
আন্দোলনব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন,
পিতা-মাতা
  • তারেশচন্দ্র (পিতা)
  • বিনোদিনী দেবী (মাতা)

প্রাথমিক জীবন

সম্পাদনা

অতুলকৃষ্ণ ১৮৯০ সালে নদিয়া জেলায় কুষ্টিয়ার এতমামপুর-জাদুবয়রা গ্রামের এক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যা বর্তমানে বাংলাদেশে। তাঁর পিতা-মাতা তারেশচন্দ্র এবং বিনোদিনী দেবী। এই দম্পতির ছয়টি সন্তান ছিল। কুমারখালীতে তার প্রাথমিক স্কুল পরে, ১৯০৯ সালে কলকাতা হিন্দু স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৯১১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ ইন্টারমিডিয়েটে এবং ১৯১৩ সালে বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এসসি পাস করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে এম.এস.সি. পড়া শুরু করেন কিন্তু অতুল রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে পড়ায় কলেজ ছেড়ে দেন।[]

সশস্ত্র আন্দোলন

সম্পাদনা

১৯০৬ সালে গ্রামের সঙ্গী নলিনীকান্ত করের সঙ্গে তিনি যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অনুগ্রামী হন। তারা দুজনেই স্থানীয় অনুশীলন সমিতিতে প্রবেশ করেছিলেন। ডাব্লিউ সেলির প্রতিবেদনে জানান অতুলকৃষ্ণ ঘোষ এবং নলিনীকান্ত কর দুজন বিপজ্জনক গুরুত্বপূর্ণ বন্দুক চালানোর শেখেন। (P23)[] অতুল পাটালডাঙ্গায় অনুশীলন সমিতিতে আত্মরক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। অতুলকৃষ্ণ ঘোষ এবং যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় পাথুরিয়াঘাটা ব্যয়াম সামিতির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। বীরেন দত্তগুপ্ত একটি চিঠিতে লিখেছেন ১৯১০ সালের ২৪শে জানুয়ারিত ডেপুটি কমিশনার শামসুল আলমের হত্যা, আলিপুর বোমা মামলার আন্ডার-ট্রায়াল বন্দীদের ম্যানেজ করেন।[] বীরেনের সফল মিশনের সাথে সম্পর্কিত, হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলায় ছেচল্লিশ জন সহযোগী সহ যতীন্দ্রনাথকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। কারাগারের অভ্যন্তরে যতীন্দ্রনাথ বিদেশে তাঁর রাষ্ট্রদূতদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে জার্মানি গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ১৯১১ সালে মুক্তি পাওয়ার পরে যতীন্দ্রনাথ সমস্ত উগ্রবাদী তৎপরতা স্থগিত করেছিলেন, যতীন্দ্রনাথের নির্দেশে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য একত্রিত করার গুরু দায়িত্ব অতুলকৃষ্ণ নিয়েছিলেন।

যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সাথে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড

সম্পাদনা

কলকাতার পুরো দায়িত্ব অতুলকৃষ্ণ ঘোষের হাতে অর্পণ করে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে যতীন উপস্থিত হলেন তার পৈতৃক ভিটা ঝিনাইদহে। সেখানে ঠিকাদারের ব্যবসা শুরু করলেন তিনি যশোর-ঝিনাইদহ রেলপথ নির্মাণ উপলক্ষে। ব্যবসার সুবাদে তিনি সাইকেলে অথবা ঘোড়ার পিঠে চড়ে জেলায় জেলায় অবিশ্রাম ঘুরে গুপ্তসমিতির শাখাগুলিকে সন্নিহিত করে তুললেন।

১৯১৩ সালে বাংলা এবং বাংলার বাইরের বিভিন্ন শাখার কর্মী ও নেতারা মিলিত হলেন বর্ধমানে বন্যাত্রাণ উপলক্ষে।[] উত্তর ভারত থেকে রাসবিহারী বসু এসে যতীনের সংগে আলোচনা করে নূতন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হলেনঃ অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে যতীনের সংগে একাধিক বৈঠকে রাসবিহারী সিদ্ধান্ত নিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের সৈন্য-বহরের পরিচালকদের সহযোগিতায় কলকাতা থেকে পেশোয়ার অবধি বিদ্রোহের আগুন জ্বলবে ১৮৫৭ সালের দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে। ১৯১৪ সালে বাবা গুরুদিত সিং এর নেতৃত্বে আমেরিকা থেকে পাঞ্জাবী যাত্রী নিয়ে কোমাগাটা মারু জাহাজ বাংলার বজবজ বন্দরে এলে ব্রটিশ সেনার দ্বারা উৎপীড়িত যাত্রীদের পাঞ্জাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থায় তিনি বিশিষ্ট ভূমিকা নেয়। একবার এক অসুস্থ সহকর্মীকে কাঁধে করে হাসপাতালের পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে বাইরে নিয়ে আসেন। গার্ডেনরীচে মোটরচালিত ট্যাক্সির সাহায্যে অভিনব পদ্ধতিতে ডাকাতি করা এবং ইংস্পেক্টর সুরেশ মুখার্জির হত্যার ঘটনায় অতুলকৃষ্ণ ঘোষের যোগ ছিল। ১৯১৫-১৯২১ সাল পর্যন্ত এই সময়ে ভারত-জার্মান অস্ত্রসংগ্রহ ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকায় অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, যদুগোপাল মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্যদের সঙ্গে আত্মগোপন করে থাকেন ওই সময় চন্দননগরেফরাসীরা তাঁদের আশ্রয় দেন। সেখান থেকে তাঁরা পুলিশের কার্যকলাপের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় ইংরেজ সরকার ভারত - জার্মান ষড়যন্ত্রকারীদের উপর থেকে শাস্তির পরোয়ানা তুলে নেন। অতুলকৃষ্ণ মুক্তি পেলেন কিন্তু তার আগেই বুড়িবালামের যুদ্ধে যতীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় । এই আঘাতে তিনি সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সরে আসেন। []

তবুও, ১৯২৪ সালের জানুয়ারিতে, গোপীনাথ সাহা একজন ইংরেজ আর্নেস্ট ডে কে হত্যা করেন, যিনি কলকাতা পুলিশের বহুল-ঘৃণ্য কমিশনার (যতীন মুখোপাধ্যায়কে হত্যা করার জন্য) তাকে টেগার্ট বলে গণ্য করেছিলেন, অতুলকৃষ্ণকে রাজবন্দী করা হয়েছিল, ১৯২৬ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। একই বছর তিনি মজিলপুরের মেনকারানী রক্ষিতকে বিয়ে করেন এবং রাজনীতি থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ব্যবসায়ে নামেন। শেষ বয়সে তিনি আধ্যাত্মিক জীবনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।[] পৃথ্বীন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের (বাঘা যতিনের নাতি) এক সাক্ষাত্কারে ২৭ অক্টোবর ১৯৬৩সালে মৃত্যুর কিছু আগে - অতুলকৃষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন: "দাদা চুম্বক ছিলেন; আমরা সকলেই লোহার স্ক্র্যাপগুলি তার কাছ থেকে আমাদের শক্তি পেয়েছিলাম। যখন তিনি আর ছিলেন না, আমরা সবাই লোহার স্ক্র্যাপে পরিণত হয়েছি। আমার প্রথম আনুগত্য দাদার কাছে গিয়েছিল। যতীন্দ্রনাথের অভূতপূর্ব শক্তির উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে অতুলকৃষ্ণ জবাব দিয়েছিলেন: "তিনি ছিলেন একজন খুব দক্ষ প্রশিক্ষিত কুস্তিবিদ ছিলেন। কিন্তু যে বিষয়টি তাকে চিহ্নিত করেছিল তা ছিল তার দেশভক্তি, আত্মাশক্তি এবং তার একাগ্রতা শক্তি। []

অতুলকৃষ্ণ ঘোষ ৪ মে ১৯৬৬ সালে কলকাতায় তাঁর বাসভবনে শান্তিপূর্ণভাবে মারা যান।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "৪ মে: ইতিহাসের এই দিনে"Sahos 24। ৪ মে ২০১৭। ১১ জুন ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুলাই ২০১৭ 
  2. Ghose, Atulkrishna in Dictionary of National Biography,[abbrev. DNB], Edited by S.P. Sen, Volume II, Calcutta, 1974
  3. Terrorism in Bengal,[abbrev. Terrorism], Government of West Bengal, Volume V, 1995, p23
  4. Notes given by Atulkrishna Ghosh and Nalinikanta Kar in sadhak-biplabi jatindranath, [abbrev. jatindranath], by Dr Prithwindra Mukherjee, West Bengal State Book Board, 1990, several references
  5. Nixon's Report in Terrorism, Volume II, p590
  6. প্রথম খন্ড, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত (২০০২)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ৮। 
  7. DNB, Vol. II, p37
  8. jatindranath
  • "বিপ্লবী অতুলকৃষ্ণ ঘোষ", ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত, শ্রী সরস্বতী গ্রন্থাগার, কলকাতা, ১৯৬৬ (এবিবিআর বিকেডি)
  • "ঘোষ, অতুলকৃষ্ণ (১৮৯০-১৯৬৬))" ভুপেন্দ্রকুমার দত্ত ডিকশনারি অফ ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি, (সম্পাদনা) এসপি সেন, খণ্ড। II, ১৯৭৩, পিপিপি ৭–৩৮ (এবিবিআর ডিএনবি)
  • জে সি সি নিক্সনের রিপোর্ট "বিপ্লবী সংগঠন" বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামী, সম্পাদনা। অমিও কুমার সামন্ত, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৯৫ (এবিবিআর নিক্সন) লিখেছেন।
  • ডাব্লিউ. সিলির রিপোর্ট, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামী "বিহার ও উড়িষ্যার সাথে সংযোগ", সম্পাদনা। অমিও কুমার সামন্ত, ভোল্ট ভ, ১৯৯৫ (এবিবিআর সেলি) লিখেছেন।
  • সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, পৃথ্বীন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক বোর্ড, ১৯৯০
  • বিপ্লবীর জীবন-দর্শন, আত্মজীবনী, প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলি, ১৯৭৬

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা