হুলিয়া (কবিতা)

নির্মলেন্দু গুণের কবিতা

হুলিয়া নির্মলেন্দু গুণের লেখা বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রচিত একটি বাংলা ভাষার কবিতা। এটি তার কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই-এ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কবি এটা লিখেছিলেন বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। এতে ৮০টি ছন্দবদ্ধ ছত্র রয়েছে। কবিতাটিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে।[১]

হুলিয়া 
নির্মলেন্দু গুণ কর্তৃক রচিত
দেশবাংলাদেশ
ভাষাবাংলা
ধারাবাহিকপ্রেমাংশুর রক্ত চাই
বিষয়রাজনীতি
ধরনকবিতা
প্রকাশকআলেকজান্দ্রা স্টিম মেশিন প্রেস
প্রকাশনার তারিখ১৯৭০
লাইন৮০
আইএসবিএন৯৭৮৯৮৪৯১১৮৭১৮

পটভূমিসম্পাদনা

হুলিয়া কবিতাটি প্রেমাংশুর রক্ত চাই পদ্য সংকলনের অন্তর্গত। নির্মলেন্দু গুণ কবিতাটি লেখার সময় আবুল হাসানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকতেন। কবিতাটি লেখার পরদিন গুণ খুঁজে পায়নি। হোস্টেলের কক্ষ থেকে বের হয়ে তিনি যখন ছিন্নভিন্ন অবস্থায় দেখতে পেলেন, তখন তিনি আবুল হাসানের কাছে গিয়ে কবিতার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় তিনি কবিতাটিকে অপমান করে গল্পটির সাথে তুলনা করেন এবং কবিতাটি পুনরায় লিখতে বলেন। পুনরায় লিখে নির্মলেন্দু আবুল হাসানকে কবিতাটি পড়ে শোনানোর পর তিনি তার কথা ফিরিয়ে নেন।[২] নির্মলেন্দু গুণ তখন কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারে কবিতাটি আবার লেখেন। কবিতার বইটি নির্মলেন্দু গুণ প্রকাশের জন্য বেশ কয়েকজন প্রকাশকের কাছে আবেদন করে ব্যর্থ হোন। এরপর ১৯৭০ সালের ২১ জুলাই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি কবিতাটি আবৃত্তি করেন। অনুষ্ঠানে সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি তার পত্রিকার একটি জনপ্রিয় কলামে কবিতাটির নাম উল্লেখ করেন। খান ব্রাদার্সের মালিক মোসলেম খান গুণকে কবিতার বই প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করেন। কবিতাটি সহ বইটি পরে আলেকজান্দ্রা স্টিম মেশিন প্রেস প্রকাশ করে।[৩]

উপজীব্যসম্পাদনা

হুলিয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ হল এক প্রকার ঘোষণা যা পলাতক আসামীকে গ্রেফতার করতে ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের ঘোষণা পত্রে পলাতক ব্যক্তির নাম, পরিচয় ও বিবরণ থাকে।[৪] পাকিস্তানের সামরিক শাসনের সময় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থেকে একজন রাজনৈতিক কর্মীর পলায়নের চিত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে।[৫] হুলিয়া কবিতায় কবি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ছন্দে-ছন্দে মাধ্যমে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করেন। ১৯৬৯ সালে যখন উল্লিখিত নায়কের নতুন রাজনৈতিক নীতি জনসাধারণের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল, তখন গুণ কবিতায় পাকিস্তানে বাঙালি জাতির ভবিষ্যত, সেই পরিস্থিতিতে আইয়ুব খানের অবস্থান ও শেখ মুজিবুর রহমানের সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।[৬]

বিশ্লেষণসম্পাদনা

তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত ছন্দে লেখার পরিবর্তে, গুণ এখানে একটি নতুন ধরনের ছড়া ব্যবহার করেছেন যেখানে অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা রয়েছে। কবি নাসির আহমেদ বলেন এই কবিতায় কবি ভোটাধিকার বঞ্চিত পূর্ব পাকিস্তানকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতাটির পাঠ্যটি চমৎকার কাল্পনিক দৃশ্যের একটি ধারাবাহিকতা তৈরি করে।[৫] বর্ণনামূলক কবিতাটি ছন্দের বদলে একটি গল্পকে তুলে ধরে।[৭]

অভ্যর্থনাসম্পাদনা

কবি নাসির আহমেদ তাঁর সময়ের দলিল গ্রন্থে কবিতাটি সম্পর্কে লিখেছেন, “... এসব সামাজিক-রাজনৈতিক ও মানবিক চেতনার বিবেচনায় হুলিয়া সে সময়ের উজ্জ্বল দলিল। এবং সম্ভবত সেই কারণেই এই কবিতাটি তরুণ কবিকে অল্প বয়সেই খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৬৯ সালের বিপ্লবের স্বরূপ জানতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই যেমন অবশ্যম্ভাবী, সেই সাথে নির্মলেন্দু গুণের হুলিয়াও অবশ্যম্ভাবী।"[৫] আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দৈনিক পূর্বদেশ সংবাদপত্রে কবিতাটিকে সময়ের সেরা কবিতা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন কবিতাটি সময়ের চাহিদা পূরণ করেছে।[৮][৯] কলাম লেখক রফিকুল্লাহ খান মনে করেন যে কবিতাটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে সমাজের কাছে কবি হিসেবে নির্মলেন্দু গুনের দায়বদ্ধতা প্রমাণিত হয়।[১০]

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেসম্পাদনা

১৯৮৪ সালে কবিতার কাহিনী অবলম্বনে একই শিরোনামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত এ চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর যা ছিলো হুমায়ূন ফরীদি অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র।[১১]

তথ্যসূত্রসম্পাদনা

  1. খোরশেদ, ইকবাল (৩ আগস্ট ২০২১)। "শব্দে ও ছন্দে পিতার মুখ"যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জুলাই ২০২২ 
  2. আহমেদ, ফরিদ। "হুলিয়া কবিতার জন্ম কথা"বাংলাকাগজ.কম। ৫ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ আগস্ট ২০২২ 
  3. গৌরিক, গিরিশ (২১ জুন ২০২০)। "নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাৎকার"বাংলা ট্রিবিউন। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জুলাই ২০২২ 
  4. "হুলিয়া Meaning In Bengali"শব্দার্থ.কম। সংগ্রহের তারিখ ১ আগস্ট ২০২২ 
  5. "নির্মলেন্দু গুণের কবিতা: তিন কবির বিশ্লেষণ"সমকাল। ১৭ জুন ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১ আগস্ট ২০২২ 
  6. বিশ্বাস, মিল্টন (২১ জুন ২০২০)। "নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় রাজনীতির নিজস্ব স্বর"ইত্তেফাক। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জুলাই ২০২২ 
  7. কাদের, আবেদীন (১৫ এপ্রিল ২০২২)। "শামস আল মমীনের কবিতা: ভিন্ন স্বরের, ভিন্ন কাব্য-ভাষার ছবি"বিডিনিউজ২৪.কম। ৫ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ আগস্ট ২০২২ 
  8. "আমার হুলিয়া, আমার বঙ্গবন্ধু"আমাদের সময়। ১৩ আগস্ট ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১ আগস্ট ২০২২ 
  9. আলাউদ্দিন, রাজু (১৫ আগস্ট ২০১৫)। "নির্মলেন্দু গুণ: "প্রথমদিন শেখ মুজিব আমাকে 'আপনি' করে বললেন""বিডিনিউজ২৪.কম। সংগ্রহের তারিখ ১ আগস্ট ২০২২ 
  10. খান, রফিকুল্লাহ (২১ জুন ২০১৪)। "গুণের কবিতা: সংগ্রামের কবিতা"বাংলানিউজ২৪.কম। ৫ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ আগস্ট ২০২২ 
  11. সাদ, সাইমুম (২৯ মে ২০২১)। "হুলিয়া: ফরীদিকে মঞ্চে খুঁজে পেয়েছিলেন তানভীর মোকাম্মেল"বিডিনিউজ২৪.কম। সংগ্রহের তারিখ ১ আগস্ট ২০২২ 

বহিঃসংযোগসম্পাদনা

আরও পড়ুনসম্পাদনা