হিজরি সন

ইসলামি বর্ষপঞ্জিতে ব্যবহৃত পঞ্জিকা সাল
(হিজরি সাল থেকে পুনর্নির্দেশিত)

হিজরি সন ( আরবি: السَنة الهِجْريّة ) হল ইসলামি চন্দ্র পঞ্জিকায় ব্যবহৃত পঞ্জিকা সাল, যার প্রথম বছর শুরু হয় ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ইসলামি নববর্ষের দিন থেকে। এই হিজরি সালের এই প্রথম বছরে মুহাম্মাদ ও তার সাহাবিরা মক্কা থেকে ইয়াসরিবে (বর্তমানে মদিনা) দেশান্তরিত হন। ঘটনাটি ইসলামি পরিভাষায় হিজরত নামে পরিচিত হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব হিজরি সন প্রত্যাবর্তন করেন।[১]

পশ্চিমা বিশ্বে, এই পঞ্জিকা সালকে সাধারণত বলা হয় এএইচ (লাতিন: Anno Hegirae /ˈæn ˈhɛɪr/, 'হিজরতের বছর') যা খ্রিস্টীয় (এডি), সাধারণ (সিই) ও ইহুদি সাল (এএম) এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সাদৃশ্যপূর্ণভাবে তারিখের আগে বা পরে বসানো সম্ভব। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এই সালকে সংক্ষেপে ইংরেজিতে এইচ ("হিজরি") দ্বারা লেখা হয় যা এসেছে এর আরবি আদ্যাক্ষর হা (هـ) থেকে। ১ হিজরির (ইংরেজি: 1 AH) আগের বর্ষকে বলা হয় ১ হিজরিপূর্ব (ইংরেজি: 1 BH)।[২]

ইসলামি চন্দ্র পঞ্জিকায় শুধু ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিন থাকার কারণে হিজরি বছর খুব ধীরে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতে দশ দিন করে পেছাতে থাকে। যেমন ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ইসলামি সন হিজরিতে ১৪৪৫ – ১৪৪৬। হিজরি ১৪৪৩ গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতে ২০২১ – ২০২২ খ্রিস্টাব্দে পড়ে।[ক]

সংজ্ঞা সম্পাদনা

হিজরি সন ইসলামি চন্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে গণনা করা হয়, জুলীয় কিংবা গ্রেগরীয় সৌর পঞ্জিকা অনুসারে নয়। এই পঞ্জিকা সাল ১ জানুয়ারি, ১ খ্রিস্টাব্দ তারিখে শুরু না হয়ে ১ মুহররম, ১ হিজরি তারিখে শুরু হয় যা জুলীয় বর্ষপঞ্জিতে ১৬ জুলাই, ৬২২ খ্রিস্টাব্দ তারিখে পড়ে।[৩]

হিজরতের তারিখ নববর্ষের তারিখ নয়। এই পঞ্জিকা সাল ব্যবস্থা সনাতনী মাসের ক্রম মেনে চলে যেখানে প্রথম বর্ষের ইসলামি নববর্ষের ৬৬ দিন পরে (৬ রবিউল আউয়াল) হিজরতের ঘটনা ঘটেছিলো।

ইতিহাস সম্পাদনা

পূর্বসূরী সম্পাদনা

মুহাম্মদের সময়ে ইতোমধ্যে নামকৃত মাস সহ একটি আরবীয় চন্দ্র পঞ্জিকা ছিলো। সেই সময় পঞ্জিকার বছর সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত না করে নাম দ্বারা চিহ্নিত করা হত:[৪] উদাহরণস্বরূপ, মুহাম্মদ এবং আম্মার ইবনে ইয়াসির (৫৭০ খ্রিস্টাব্দ) এর জন্ম সালকে প্রাক-ইসলামি মক্কায় বলা হত "হস্তিবর্ষ"।[৫] হিজরতের প্রথম বর্ষ (৬২২-২৩ খ্রিস্টাব্দ) পঞ্জিকায় পরিচিত ছিলো "ভ্রমণের অনুমতি" হিসেবে।[৪]

প্রতিষ্ঠা সম্পাদনা

হিজরতের ১৭ বছর পরে,[৪][৬] বসরার গভর্নর আবু মুসা আশয়ারী পত্রযোগে খলিফা উমরকে জানান “হে আমীরুল মু’মিনীন, আমাদের কাছে বহু পত্র আসে, যাতে তারিখ লেখা থাকে, কিন্তু তাতে সাল লেখা থাকে না। সুতরাং সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সাল গণনার ব্যবস্থা করুন।"[৭] অভিযোগটি পাওয়ার পর খলিফা নামভিত্তিক বছর গণনা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে একটি নতুন সংখ্যাভিত্তিক বছর গণনা ব্যবস্থা প্রচলন করার পদক্ষেপ নেন। এক হাদিস অনুসারে উমর পরামর্শ সভা আহবান করেন। সভায় সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস মুহাম্মদের মৃত্যুবরণের বছর, তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ নবুয়তের বছর এবং আলী ইবনে আবী তালিব হিজরতের বছর থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব দেন। অতঃপর সভার সকলে আলীর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন।[৭] উমর নতুন পঞ্জিকা সালের প্রথম বর্ষ হিসেবে মুহাম্মদ ও তার ৭০ জন সাহাবির মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার বছরকে গ্রহণ করেন।[৮] আরেক হাদিস অনুসারে উসমানআলী প্রচলিত মাসের ক্রম ঠিক রেখে পঞ্জিকা সাল অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দেন যা গৃহীত হয়।[৭] এরপর উমর কর্তৃক এই পঞ্জিকা সাল ব্যবহার মুসলিম সাম্রাজ্যে বাধ্যতামূলক করা হয়।[৯]

সূত্র সম্পাদনা

গ্রেগরীয় ও হিজরি তারিখের রূপান্তরের বিভিন্ন "প্রায় নির্ভুল" সূত্র তৈরি সম্ভব:[১০][১১][১২]

হিজরি = ১.০৩০৬৮৪ × (খ্রিস্টাব্দ − ৬২১.৫৬৪৩)
খ্রিস্টাব্দ = ০.৯৭০২২৯ × হিজরি + ৬২১.৫৬৪৩ 

অথবা

হিজরি = (খ্রিস্টাব্দ − ৬২২) × ৩৩ ÷ ৩২
খ্রিস্টাব্দ = হিজরি + ৬২২ − (হিজরি ÷ ৩২)

নিয়মানুসারে যেহেতু ইসলামি নববর্ষ জানুয়ারির ১ তারিখে শুরু হয়না এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি থেকে হিজরি সনের পঞ্জিকা ১১ দিনের ছোট,[১৩][খ] তাই এই দুটি সালের মধ্যে সাযুজ্যকরণ সম্ভব হয় না। একটি নির্দিষ্ট হিজরি বছর সাধারণত দুটি গ্রেগরীয় বছরে পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের বছরটি ১৪২৮ হিজরির শেষ সপ্তাহে থেকে ১৪৩০ হিজরি পর্যন্ত পড়েছিলো।[১৫][১৬][১৭] একইভাবে, ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ ১৯৯৫ সালের শেষ সপ্তাহ থেকে ১৩৯৭ সালের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ছিলো।

মাসসমূহ সম্পাদনা

প্রতিটি হিজরি বছরে ১২টি মাস থাকে, এসব মাসের দৈর্ঘ্য ইসলামের সম্প্রদায় ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রতিটি মাসের শুরু নতুন চন্দ্র চক্রের জন্মের উপর নির্ভর করে। ঐতিহ্যগতভাবে এটি অর্ধচন্দ্র (হিলাল) প্রত্যক্ষ করার নির্ভর করে যা আগের চন্দ্র চক্রের শেষ ও নতুন চন্দ্র চক্রের সূচনা নির্ধারণ করে। ফলস্বরূপ, চন্দ্রের দৃশ্যমানতা, জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় অবস্থান ও আবহাওয়ার অবস্থার উপর ভিত্তি করে প্রতিটি মাস ২৯ বা ৩০ দিন পূর্ণ করতে পারে৷ যদিও নির্দিষ্ট কিছু দল ও সম্প্রদায়, বিশেষত বোহরা মুসলিম যেমন আলাভীয়, দায়ূদীয়, সুলাইমানিশিয়া ইসমাইলি মুসলিমরা একটি সারণিকৃত ইসলামি বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করে যেখানে বিজোড় সংখ্যক মাসগুলো ৩০ দিন পূর্ণ করে (অধিবর্ষের দ্বাদশ মাসেও) এবং জোড় মাসগুলো ২৯ দিন পূর্ণ করে।

আরও দেখুন সম্পাদনা

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. বিস্তারিত দেখুন ইসলামী বর্ষের তালিকা
  2. ক্রান্তীয় বছরের গড় সময়কাল ৩৬৫.২৪২১৯ দিন হওয়ার ফলে, যখন চন্দ্র বছরের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৩৫৪.৩৬৭০৭ দিনে ঠেকে,[১৪] গড় চন্দ্র বছর (৩৬৫.২৪২১৯ বিয়োগ; ৩৫৪.৩৬৭০৭ ≈) গড় সৌর বছরের চেয়ে ১০.৮৮১৪৯ দিন ছোট হয়ে থাকে, যার ফলে হিজরি বর্ষপঞ্জির মাসগুলো প্রতি বছর গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি থেকে ১১ দিন করে পেছাতে থাকে। দিনের সমষ্টির সঠিক সংখ্যাটি সঞ্চিত পার্থক্য ও বিভিন্ন সময়ে আসা সম্ভাব্য অধিবর্ষের উপর নির্ভর করে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

উৎস সম্পাদনা

  • F. A. Shamsi (১৯৮৪)। "The Date of Hijrah"। Islamic Studies23: 189–224 & 289–332। 

উদ্ধৃতি সম্পাদনা

  1. "مهد له خطاب إلى أبي موسى الأشعري وحسمته استشارة الصحابة.. كيف بدأ التقويم الهجري؟"www.aljazeera.net (আরবি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৯-০৬ 
  2. Registration locations, শারজাহ সরকার, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২১ জানুয়ারি ২০১৭ .
  3. Shaikh, Fazlur Rehman (২০০২)। A. Clarke, সম্পাদক। Chronology of Prophetic Events। London: Ta-Ha Publishers Ltd.। পৃষ্ঠা 157। আইএসবিএন 9781842000342 
  4. Aisha El-Awady (২০০২-০৬-১১)। "Ramadan and the Lunar Calendar"Islamonline.net। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১২-১৬ 
  5. Hajjah Adil, Amina, "Prophet Muhammad", ISCA, Jun 1, 2002, আইএসবিএন ১-৯৩০৪০৯-১১-৭
  6. Hakim Muhammad Said (১৯৮১)। "The History of the Islamic Calendar in the Light of the Hijra"Ahlul Bayt Digital Islamic Library Project। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১২-১৬ 
  7. "হিজরতের স্মৃতিধন্য সন গণনা"দেশ রূপান্তর। ২১ আগস্ট ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ২১ অক্টোবর ২০২১ 
  8. The Beginning of Hijri calendar – Paul Lunde, Saudi Aramco World Magazine (November/December 2005), retrieved 1/1/2019
  9. Umar bin Al-Khattab (২০০২)। "Islamic Actions and Social Mandates: The Hijri Calendar"। witness-pioneer.org। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১২-১৬ 
  10. Islamic and Christian Dating Systems
  11. Clark, Malcolm (২০১৩)। Islam for dummies। Hoboken, N.J.: John Wiley & Sons। পৃষ্ঠা 489। আইএসবিএন 1118053966 
  12. Hodgson, Marshall G. S. (১৯৭৭)। The venture of Islam conscience and history in a world civilization। Chicago: University of Chicago Press। পৃষ্ঠা 21। আইএসবিএন 0226346862 
  13. চিসাম, হিউ, সম্পাদক (১৯১১)। "Hejira"। ব্রিটিশ বিশ্বকোষ13 (১১তম সংস্করণ)। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা 218। 
  14. P. Kenneth Seidelmann, সম্পাদক (১৯৯২)। Explanatory Supplement to the Astronomical Almanac। পৃষ্ঠা 577। For convenience, it is common to speak of a lunar year of twelve synodic months, or 354.36707 days.  (which gives a mean synodic month as 29.53059 days or 29 days 12 hours 44 minutes and 3 seconds)
  15. ""Islamic New Year Observed Today; President Airs Wish for Peace on Amon Jadid Exhorts Muslims to Assist in Nat'l Resurgence"Manila Bulletin। জানুয়ারি ২০, ২০০৭। [অকার্যকর সংযোগ]
  16. "Islamic New year to be observed on 11th January"AAJ News। Aaj.tv। ২০০৮-০১-১০। ২০১৮-১২-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৫-২২ 
  17. "Visibility of Muharram Crescent 1430 AH"Islamic Crescents' Observation Project। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ অক্টোবর ২০২১