হাওড়া জেলার ইতিহাস

বাগনান, শ্যামপুর, জগৎবল্লভপুর ইত্যাদি কয়েকটি থানার কয়েকটি গ্রামে খননকার্য চালিয়ে সামান্য কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া অন্যান্য জেলার মতো হাওড়া জেলাতেও পোড়ামাটির কারুকার্য সহ অনেক প্রাচীন মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে।[১] প্রাচীন জৈন, বৌদ্ধ বা হিন্দু সাহিত্যে হাওড়া অঞ্চলের সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। গ্রিক বা চৈনিক লেখকদের রচনাতেও এই অঞ্চলের কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।[২] তবে গবেষকদের ধারণা, প্রাচীনকালে রাঢ়ের অন্তর্গত সুহ্ম অঞ্চলের দক্ষিণাংশ হাওড়া ও অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা নিয়ে গঠিত ছিল।[২]

নামের উৎস সম্পাদনা

"হাওড়া" নামটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। একটি মতে, বর্তমান হাওড়া শহরের অদূরে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে হাড়িড়া নামে একটি গ্রামের অস্তিত্ব ছিল; "হাওড়া" নামটি এই "হাড়িড়া" নামেরই অপভ্রংশ।[২] অন্যমতে, "হাওড়া" নামটির উৎপত্তি "হাবড়" শব্দটি থেকে; যার অর্থ "যেখানে পাঁক ও কাদা বেশি হয়"।[৩] আবার কেউ কেউ মনে করেন, "হাওড়া" শব্দটির অর্থ "যে নিচু বা অবনত অঞ্চলে বর্ষার জল সঞ্চিত হয়"। হাওড়ার ভূমিরূপ এই জাতীয় ছিল বলে অঞ্চলটির এইরূপ নামকরণ হয়।[৩] ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেনের মতে, "হাওড়া" শব্দটি একটি ধ্বন্যাত্মক শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন হয়েছে; এর অর্থ "যেখানে কেবল জল-কাদা"।[৪]

প্রাচীনকাল সম্পাদনা

 
প্রাচীন ভুরশুট রাজ্যের মানচিত্র

প্রাচীকালে এই হাওড়া জেলাতেই ছিল ভুরশুট রাজ্য। এটি ছিল অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া ও হুগলি জেলার অন্তর্গত একটি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রাজ্য। রাঢ় অঞ্চলের দক্ষিণাঞ্চলে ভুরশুট রাজ্যটি স্থাপিত হয়েছিল। এই রাজ্যের অধিবাসীরা "ভুরিশ্রেষ্ঠী" নামে পরিচিত ছিল। এরা ছিল মূলত বণিক। এদের নামানুসারেই রাজ্যের নামকরণ হয় "ভুরশুট"। যদিও সম্ভবত ভুরশুটই ছিল রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের মূল বসতাঞ্চল। পাল সাম্রাজ্যের উত্থানের সময় কোনো এক সুর রাজা এই রাজ্য শাসন করতেন। একাধিক সামন্ত রাজা এই রাজ্য শাসন করেছিলেন। এই রাজ্যের রানী ভবশঙ্করীছিলেন এক বীর রমনী যিনি সম্রাট আকবরের দ্বারা রায়বাঘিনী উপাধি পান। ধীবর রাজবংশের (সম্ভবত ১৪শ-১৫শ শতাব্দী) লোককথায় এই রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর পর কোনো এক ব্রাহ্মণ রাজবংশ এই রাজ্য শাসন করে। দক্ষিণ রাঢ়ের ভূরী শ্রেষ্ঠিক নামক অঞ্চলটিও বর্তমান হাওড়ার আমতা-উদয়নারায়ণপুর-ডিহি ভুরশুট অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।[৩] অনুমিত হয়, খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমান হাওড়া অঞ্চলের ভূরিশ্রেষ্ঠ (অধুনা ভুরশুট) ছিল একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যনগরী।[৫] ভুরশুট রাজ্যে তিনটি দুর্গ ছিল। এগুলি হল গড় ভবানীপুর, পান্ডুয়া (পেদো বা পেদো বসন্তপুর) ও রাজবলহাট। এই দুর্গগুলির এখন আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে হাওড়া জেলায় রাজবলহাটের কাছে দামোদর নদের তীরে ডিহি ভুরশুট বলে একটি জায়গা এখনও আছে। ১৮শ শতাব্দীর বাঙালি কবি "রায়গুণাকর" ভারতচন্দ্র রায় পেদো ভুরশুটের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি সম্ভবত ভুরশুট রাজবংশের লোক ছিলেন। খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে বর্তমান হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া মহকুমার একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল উড়িষ্যা রাজ্যের অধীনে ছিল।[৩]

মধ্যযুগে সম্পাদনা

পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান বন্দর ছিল সপ্তগ্রাম। এই সময় সরস্বতী নদীপথে বর্তমান হাওড়া জেলার মধ্য দিয়েই সপ্তগ্রাম পর্যন্ত বাণিজ্যপথটি প্রসারিত ছিল। পরবর্তীকালে সরস্বতী নদীর নাব্যতা কমে গেলে ভাগীরথী ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হাওড়ার বেতর সপ্তগ্রামের বিকল্প বন্দর হিসেবে উন্নতি লাভ করে।[৩] ভেনিসের পর্যটক সিজার ফেদারিকি ১৫৬৫-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারত ভ্রমণ করেন। তিনি ১৫৭৮ সালে লেখা তার বিবরণীতে "Buttor" নামে একটি অঞ্চলের উল্লেখ করেন।[৬] এই বিবরণী অনুযায়ী, উক্ত অঞ্চলে জাহাজ যাতায়াতের (সম্ভবত হুগলি নদীর মাধ্যমে) সুবন্দ্যোবস্ত ছিল এবং সম্ভবত জায়গাটি ছিল বাণিজ্যিক বন্দর।[৬] জায়গার নামটির সঙ্গে দক্ষিণ হাওড়ার বেতড় অঞ্চলের নামের মিল পাওয়া যায়।[৬] বিপ্রদাস পিপলাইয়ের (১৪১৭-১৪৯৫) মঙ্গলচণ্ডী কাব্যে (১৪৯৫ খ্রি.) বেতড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫৫৩ সালে ডি ব্যারোজ অঙ্কিত মানচিত্রে হাওড়া জেলার কয়েকটি স্থানের নাম পাওয়া যায়। ১৭৭৯-৮০ সালের রেনেলের মানচিত্রেও বেতড় ও শিবপুর অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়।[৩]

আধুনিক যুগ সম্পাদনা

 
পুরনো হাওড়া পুল ও হাওড়া স্টেশন
 
হাওড়া বাস স্ট্যান্ড, ১৯৪৪

১৭১৩ সালে আওরঙ্গজেব নাতি ফর‌রুখসিয়ার রাজ্যাভিষেকের সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল কাউন্সিল তার কাছে একটি ডেপুটেশন পাঠিয়ে হুগলি নদীর পূর্বে ৩৩টি ও পশ্চিমে ৫টি গ্রামে বসতি স্থাপন করার অনুমতি চায়।[৭] ১৭১৪ সালের ৪ মে তারিখে লেখা কাউন্সিলের কনসালটেশন বুকের তালিকা অনুযায়ী এই ৫টি গ্রাম হল: সালিকা (সালকিয়া), হাড়িড়া, কাসুন্দিয়া, রামকৃষ্ণপুর ও বেতড়। এগুলি আজ হাওড়া শহরেরই অন্তর্গত অঞ্চল।[৮] কিন্তু কোম্পানি শুধু এই ৫টি শহরে বসতি স্থাপনেরই অনুমতি পায়নি।[৮] ১৭২৮ সালে আধুনিক হাওড়া জেলা ছিল বর্ধমান ও মহম্মদ আমিনপুর জমিদারির অন্তর্গত।[৮] পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৬০ সালের ১১ অক্টোবর বাংলার নবাব মীর কাসিম সাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে কোম্পানি হাওড়া জেলার অধিকার পায়।[৯]

বিংশ শতাব্দীর পূর্বে পৃথক জেলা হিসেবে হাওড়ার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ১৭৬০ সালে এই অঞ্চলটি বর্ধমানের অন্তর্গত হয়। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের পর হাওড়া ব্রিটিশদের অধিকারভুক্ত হয়।[১০] ১৭৯৫ সালে বর্ধমান জেলা থেকে হুগলি জেলাকে পৃথক করা হয়। হাওড়া জেলা সেই সময় হুগলি জেলার অন্তর্গত ছিল।[৩] ১৯১৭-১৮ সালে ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে হাওড়া জেলা হুগলি জেলা থেকে পৃথক ছিল। অবশ্য রাজস্ব ও দেওয়ানি বিচারের ক্ষেত্রে সেই সময়ও এই জেলা হুগলি জেলারই অন্তর্গত ছিল।[১০] ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি হাওড়া জেলা একটি পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা পায়। স্বাধীনতার পরও হাওড়া জেলা বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত ছিল। ১৯৬৩ সালে এই জেলা প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়।[৩] ১৯৬৫ সালের ২৪ জুলাই হাওড়া শহর কলকাতার ন্যায় হাওড়া পৌরসংস্থা বা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মর্যাদা পায়।[৩]

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই হাওড়া জেলার হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। ১৭৯৬ সালে সালকিয়ায় একটি জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ১৮১৭ সালে বাউড়িয়ায় স্থাপিত কটন মিলটি ছিল ভারতের প্রথম কার্পাস বয়ন কারখানা। বর্তমানে হাওড়ায় কটন মিলের সংখ্যা প্রায় ৪০। ১৮৩০ সালে জেসপ কোম্পানি হাওড়ায় একটি তেলকল চালু করার পর জেলায় তেলকলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ১৮৭৩ সালে ঘুসুড়ির কাছে ফোর্ট গ্লস্টারে একটি পাটকল চালু হয়। এটি ছিল জেলার প্রথম পাটকল। বর্তমানে জেলায় প্রায় ২০টি পাটকল রয়েছে। এছাড়া শিবপুর ও সালকিয়ায় গড়ে ওঠে দড়ি নির্মাণ কারখানা। বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি, হাওড়া ফাউন্ড্রি, জেনকিং কোম্পানি প্রভৃতি শিল্পোদ্যোগী সংস্থা হাওড়ায় ঢালাই ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকেন্দ্র গড়ে তোলে। ১৮৫৪ সালে হাওড়া স্টেশন প্রতিষ্ঠা, ১৮৬২ সালে মোগলসরাই পর্যন্ত রেলপথের প্রসার এবং ১৮৭৪ সালে হাওড়া পল্টুন ব্রিজ (পুরনো হাওড়া ব্রিজ) স্থাপনের ফলে হাওড়া জেলার শিল্পচিত্রে আমূল পরিবর্তন আসে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে হাওড়া, হুগলিমেদিনীপুরের তাঁতিদের অনুরোধে আন্দুলের মল্লিক পরিবার হাওড়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র তদনীন্তন চড়কডাঙা নামক এক স্থানে মঙ্গলা-হাট প্রতিষ্ঠা করেন। এই হাটকে ঘিরেই হাওড়ার আজকের ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্রগুলি বিকাশলাভ করেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফাউন্ড্রি সহ বিভিন্ন ভারী শিল্পে হাওড়া শহরের উৎকর্ষ ও ব্যাপকতা বিচার করে একে বাংলার শেফিল্ড বলা হত। বর্তমানে হাওড়া জেলার শিল্পচিত্রে অনেক পরিবর্তন সাধিত হলেও, এখনও ভারী ও মাঝারি শিল্পে এই জেলা একটি অগ্রপদ জেলা হিসেবেই বিবেচিত হয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "হাওড়া জেলার প্রাচীন ইতিহাস", পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, দ্বিতীয় খণ্ড, বিনয় ঘোষ, প্রকাশভবন, ১৯৭৮ (১৯৯৮ মুদ্রণ), পৃ. ২১১-২৪
  2. "হাওড়া", পশ্চিমবঙ্গ পরিচয়, বাসুদেব গঙ্গোপাধ্যায়, শিশু সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ১০৪-০৮
  3. "জেলা পরিচয়: হাওড়া জেলা", সপ্তর্ষি মিত্র, যোজনা (ধনধান্যে), সেপ্টেম্বর ২০০৭ সংখ্যা, পৃ. ৩৭-৪৫
  4. বাংলা স্থান নাম, সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৪০০ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১৪৬
  5. "ডিহি ভুরশুট", পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, দ্বিতীয় খণ্ড, বিনয় ঘোষ, প্রকাশভবন, ১৯৭৮ (১৯৯৮ মুদ্রণ), পৃ. ২১৯-২০
  6. Donald Frederick Lach, p.473
  7. O'Malley ও Chakravarti 1909, পৃ. 22
  8. O'Malley ও Chakravarti 1909, পৃ. 23
  9. O'Malley ও Chakravarti 1909, পৃ. 25
  10. "ইংরেজযুগে জেলাসীমানার পরিবর্তন:হাওড়া", পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, প্রথম খণ্ড, বিনয় ঘোষ, প্রকাশভবন, কলকাতা, ১৯৭৬ (২০০৩ মুদ্রণ), পৃ. ৯১-৯৩