সগর (রাজা)

পৌরাণিক ভারতীয় রাজা

সগর (সংস্কৃত: सगर, অনুবাদ'যে গরল (বিষ) সহ জন্মেছে') হিন্দুধর্মে সূর্যবংশ রাজবংশের একজন রাজা। তিনি বাহুকের পুত্র ছিলেন এবং দুই স্ত্রী ও ৬০,০০১ পুত্র সহ অযোধ্যা নগর শাসন করেছিলেন।[১]

সগর
চিত্রকর্মে সগর
গ্রন্থসমূহরামায়ন, মহাভারত, পুরাণ
অঞ্চলঅযোধ্যা
ব্যক্তিগত তথ্য
মাতাপিতা
দম্পত্য সঙ্গীকেশিনী ও সুমতী
সন্তানঅসমঞ্জস (কেশিনী), ৬০,০০০ পুত্র (সুমতী)
রাজবংশসূর্যবংশ

কিংবদন্তি সম্পাদনা

জন্ম সম্পাদনা

হৈহয়ের রাজা তালজংঘের আক্রমণ থেকে বাঁচতে বাহুক এবং তার স্ত্রী যাদবী ঋষি ঔর্বের আশ্রমে আশ্রয় নেওয়ার সময় সগরের জন্ম হয়েছিল। যাদবী যখন তার গর্ভাবস্থার সপ্তম মাসে ছিলেন, তখন তার সপত্নী তাকে একটি বিষ প্রয়োগ করেছিলেন, যার কারণে তিনি সাত বছর ধরে গর্ভবতী ছিলেন। বাহুক যখন আশ্রমে মারা যান, তখন যাদবী তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তাকে অনুসরণ করতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু ঔর্ব তাকে বাধা দিয়েছিলেন এবং তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তার সন্তান বড় হয়ে একজন মহান এবং ভাগ্যবান সম্রাট হবে। যাদবী অল্প কিছু পরেই সন্তান প্রসব করেন। যেহেতু তার সপত্নীর তাকে দেওয়া বিষ (গর) তার গর্ভাবস্থাকে অচল করে দিয়েছিল, ঔর্ব সেই ছেলের নাম রাখেন সগর (স-সহ, গর-বিষ)।[২]

রাজত্ব সম্পাদনা

ঋষি ঔর্ব সগরের উপনয়ন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এবং তাকে বেদ শিক্ষা দেন। একবার, ছেলেটির মুখে ঋষিকে 'বাবা' সম্বোধন করতে শুনে যাদবী কেঁদেছিলেন। সগর এই কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, যাদবী তাকে তার আসল পিতা এবং উত্তরাধিকার সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। সগর তার জন্মগত অধিকার ফিরে পেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

অযোধ্যার লোকেরা, যারা তালজঙ্ঘের ত্রাসে বাস করত, তারা বশিষ্ঠের পরামর্শ চেয়েছিল। তিনি তাদের রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে সগরকে ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। জনসাধারণ সগরের কাছে তাদের আর্জি জানাতে পাঁচ দিন ধরে ঔর্বের আশ্রমের বাইরে অপেক্ষা করেছিল। ঋষির আশীর্বাদ পেয়ে জনগণকে সাথে নিয়ে, সগর তালজঙ্ঘের সাথে যুদ্ধ করে নিজের রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন এবং নিজেকে রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[৩]

সন্তান সম্পাদনা

সুমতি ও কেশিনী নামে সগরের দুই স্ত্রী ছিল।

দীর্ঘদিন ধরে তার কোন সন্তান না থাকায়, সগর, তার দুই স্ত্রীর সাথে, হিমালয়ে গিয়েছিলেন, এবং ভৃগুপ্রস্রবণ পর্বতে তপ শুরু করেছিলেন। এভাবে এক শতাব্দী পরে, ঋষি ভৃগু আবির্ভূত হন এবং সগরকে আশীর্বাদ করেন যে তার স্ত্রীদের মধ্যে একজন ৬০,০০০ পুত্রের ও অন্যজন একজনের জন্ম দেবেন, যিনি রাজবংশের গৌরব বাড়াবেন। সুমতি ৬০,০০০ পুত্রের এবং কেশিনী একটি পুত্রের জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল সুমতির পুত্ররা অধার্মিক হবে, আর কেশিনীর পুত্র হবে ধার্মিক।[৪]

রাজা ও রাণীরা অযোধ্যায় ফিরে আসেন এবং যথাসময়ে কেশিনী অসমঞ্জস নামে এক পুত্রের জন্ম দেন। সুমতি একটি মাংসের পিণ্ডের জন্ম দিয়েছিলেন, শিব সেটিকে হাজার হাজার উজ্জ্বল টুকরায় কাটায় সেগুলি ৬০,০০০ সন্তানে পরিণত হয়েছিল।

সগর তার পুত্রদের সাথে দিগ্বিজয়ে যাত্রা শুরু করেন। ভূমির উত্তরাঞ্চল জয় করার পর, তিনি দক্ষিণের দিকে চলে যান, তার উদ্দেশ্য ছিল হৈহয়দের রাজ্য মাহিষমতী জয়। যুদ্ধে তিনি পিতার রাজ্যের দখলদারদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছিলেন বলে কথিত আছে।

সগরপুত্রদের মৃত্যু সম্পাদনা

বিষ্ণু পুরাণ অনুসারে, রাজা সগর পৃথিবীর উপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। দেবতাদের রাজা ইন্দ্র যজ্ঞের ফলাফলে ভীত হয়ে পড়েন এবং তাই তিনি একটি পর্বতের কাছে যজ্ঞের ঘোড়াটি চুরি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পাতালে গভীর ধ্যানে মগ্ন ঋষি কপিলের কাছে ঘোড়াটি রেখে যান। রাজা সগরের ৬০,০০০ পুত্র এবং অসমঞ্জসকে (সম্মিলিতভাবে সগরপুত্র নামে পরিচিত) ঘোড়াটি খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অষ্টাদিগজদের প্রদক্ষিণ করার সময় ৬০,০০০ পুত্র ঘোড়াটিকে ঋষির কাছে চরতে দেখতে পেয়ে প্রচণ্ড হৈচৈ করে। ধ্যানভঙ্গ হওয়ায় ক্রুদ্ধ ঋষি চোখ খুলে তাদের দিকে তাকালে তারা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।[৫][৬]

কয়েক প্রজন্ম পরে, সগরের বংশধরদের মধ্যে একজন, ভগীরথ, পাতাল থেকে তার পূর্বপুরুষদের আত্মাকে মুক্ত করার কাজটি হাতে নেন। তিনি দেবী গঙ্গার তপস্যা করে এই কাজটি করেছিলেন। স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে নদী হিসাবে পৃথিবীতে অবতরণ করাতে এবং পাতালে ৬০,০০০ মৃত পুত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করতে তিনি সফল হন।[৭]

ত্যাগ সম্পাদনা

পুত্রদের মৃত্যুর পর, সগর অযোধ্যার সিংহাসন ত্যাগ করেন, অসমঞ্জের পুত্র অংশুমানকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে অভিষিক্ত করেন। তিনি ঔর্বের আশ্রমে বাণপ্রস্থ গ্রহণ করেন এবং গঙ্গাকে তাঁর পুত্রের ভস্মের ওপর দিয়ে প্রবাহিত করার জন্য তপস্যা শুরু করেন।[৮]

জৈন ধর্ম সম্পাদনা

জৈন ঐতিহ্যে সগর ছিলেন ভগবান অজিতনাথের (দ্বিতীয় তীর্থঙ্কর) ছোট ভাই।[৯] তিনি অযোধ্যায় ইক্ষ্বাকু রাজবংশের ক্ষত্রিয় রাজা জিতশত্রু এবং রাণী বিজয়ন্তীর (যশোমতী) ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।[৯] তিনি ছিলেন আভাসর্পিণীর (জৈন বিশ্বতত্ত্ব অনুসারে জাগতিক সময়চক্রের বর্তমান অর্ধেক) দ্বিতীয় চক্রবর্তী শাসক, যিনি তাঁর সাতটি রত্ন দিয়ে বিশ্ব জয় করেছিলেন।[১০] তার রাণীরা ছিলেন সুমতি ও ভদ্রা।[৯] তাঁদের ষাট হাজার পুত্র ছিল, যার মধ্যে জাহ্নু ছিলেন জ্যেষ্ঠ। জাহ্নু গঙ্গা নদীর জলে নাগ রাজ্যকে প্লাবিত করেছিলেন। এতে নাগ রাজাকে ক্রুদ্ধ হয়ে সগরের সমস্ত পুত্রকে ক্রোধে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন সাগর তার নাতি ভগীরথকে সিংহাসনে বসিয়ে তপস্যার জন্য চলে যান।[১১][১২]

আরও দেখুন সম্পাদনা

টীকা সম্পাদনা

  1. Raman, Varadaraja V. (১৯৯৮)। Bālakāṇḍa: Rāmāyaṇa as Literature and Cultural History (ইংরেজি ভাষায়)। Popular Prakashan। পৃষ্ঠা 166। আইএসবিএন 978-81-7154-746-3 
  2. www.wisdomlib.org (২০১৯-০১-২৮)। "Story of Aurva"www.wisdomlib.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২২ 
  3. www.wisdomlib.org (২০১৯-০১-২৮)। "Story of Sagara"www.wisdomlib.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২২ 
  4. Chaturvedi, B. K. (২০০৬)। Vishnu Purana (ইংরেজি ভাষায়)। Diamond Pocket Books (P) Ltd.। পৃষ্ঠা 74। আইএসবিএন 978-81-7182-673-5 
  5. Sons of Sagara Vishnu Purana translated by Horace Hayman Wilson, 1840, Book IV, Chapter IV. p. 378 the gods repaired to the Muni Kapila, who was a portion of Vishńu, free from fault, and endowed with all true wisdom. Having approached him with respect, they said, "O lord, what will become of the world, if these sons of Sagara are permitted to go on in the evil ways which they have learned from Asamanja! Do thou, then, assume a visible form, for the protection of the afflicted universe." "Be satisfied," replied the sage, "in a brief time the sons of Sagara shall be all destroyed."
  6. www.wisdomlib.org (২০১৯-০১-২৮)। "Story of Kapila"www.wisdomlib.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২২ 
  7. www.wisdomlib.org (২০২২-০৯-০১)। "The Descent of the Gaṅgā; The Story of Kalmāṣapāda [Chapter 9]"www.wisdomlib.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২২ 
  8. Shastri, J. L.; Tagare, Dr G. V. (২০০৪-০১-০১)। The Narada-Purana Part 1: Ancient Indian Tradition and Mythology Volume 15 (ইংরেজি ভাষায়)। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 141। আইএসবিএন 978-81-208-3882-6 
  9. Umakant P. Shah 1987
  10. Jacobi 2015
  11. McKay 2013
  12. von Glasenapp 1999

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

আরও পড়ুন সম্পাদনা