মহম্মদ হাছানুজ্জামান
মহম্মদ হাছানুজ্জামান ছিলেন একজন বাঙালি শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ। তিনি বঙ্গীয় আইনসভা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মহম্মদ হাছানুজ্জামান | |
---|---|
সদস্য বঙ্গীয় আইনসভা | |
কাজের মেয়াদ ১৯৩৭ – ১৯৪৫ | |
নির্বাচনী এলাকা | ত্রিপুরা রাজ্য |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | আনু. ১৯০০ নাঙ্গলকোট,ত্রিপুরা জেলা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি |
মৃত্যু | ১৮ এপ্রিল ১৯৬৮ | (বয়স ৬৭–৬৮)
রাজনৈতিক দল | মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি |
প্রারম্ভিক জীবন এবং পরিবার।
সম্পাদনাহাছানুজ্জামানের জন্ম আনু. ১৯০০ কুমিল্লা জেলার তৎকালীন লাকসাম থানার অধীন নাঙ্গলকোট ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যেটি তখন ছিলো বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ত্রিপুরা জেলা (কুমিল্লা) জেলার লাকসাম মহকুমার অধীনে ছিল। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ আরিফুর রহমান ও সৈয়দেন্নেছা বেগম জ্যেষ্ঠ পুত্র। তার পিতা ছিলেন চট্টগ্রামের ইসলামিয়া মাদ্রাসার একজন স্নাতক ছিলেন এবং ১৮৯২ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ১৯২৩ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত স্থানীয় হরিপুর মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। হাছানুজ্জামানের মা স্থানীয় কাজী বংশের কন্যা ছিলেন।[১]
শিক্ষা
সম্পাদনাশৈশবে হাসানুজ্জামান তিনি বাবার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে পরে স্থানীয় উচ্চ প্রাইমারী কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত পাশ করেন। পরে চট্টগ্রাম সিনিয়র মাদ্রাসায় পড়ার জন্য উদ্গ্রীব হন ও ভর্তি হন। চট্টগ্রাম হতে তৎকালীন এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে সবার প্রশংসার সৌভাগ্য অর্জন করেন। শিক্ষানুরাগী হাছান,খান বাহাদুর ওয়াজউদ্দিন (তৎকালীন সিরাজগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ) সাহেবের নজরে পড়েন এবং ঐ কলেজে আই এ (বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক) ক্লাসে ভর্তি হন। পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে তার উপর পরিবারের দায়িত্ব বর্তিত হয় এবং চাকরির জন্য লেখা পড়া ছেড়ে দেন।[২]
কর্মজীবন
সম্পাদনাসিরাজগঞ্জের মাননীয় স্যার আজিজুল হক সাহেবের বাড়িতে থেকে একটি জুনিয়র মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হিসাবে প্রথম কর্ম জীবনে পর্দাপন করেন। আজিজুল হককে পর্যবেক্ষণ করে তিনি রাজনীতিতে যোগদানের জন্য প্রভাবিত হোন। তিনি ১৯২৬ সালে কুমিল্লায় ফিরে আসেন এবং পরের বছর তার পিতার স্মরণে নাঙ্গলকোট আরাফিয়া জুনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাত করেন। ১৯২৭ সালে তিনি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কুমিল্লা কেন্দ্রীয় সমবায়ের পরিচালক মনোনীত হন। তার কাজের মধ্যে ছিল ১৯২৯ সালে লাকসামে একটি ব্যাংকের শাখা খোলা কারণ ত্রিপুরা জেলায় একটি মাত্র ছিলো যা কুমিল্লা শহরে অবস্থিত ছিল। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করার কারণে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং হাসানুজ্জামান পরবর্তীকালে তৎকালীন সমবায় নিবন্ধক খান বাহাদুর এরশাদ আলীকে নাঙ্গলকোটে আমন্ত্রণ জানান। জনগণের পক্ষ থেকে আলীকে ঋণগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করার জন্য বলা হয়েছিল এবং তাই তিনি ১,৬৬,০০০ টাকার সুদ মওকুফ করেন। তিনি ১৯২৯ সালে ত্রিপুরা জেলা বোর্ডের সদস্য হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৩২ সালে তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের সভাপতি হন। ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে তিনি ইসলামী আইন মেনে চলার জন্য উলামা কমিটি গঠন করেন। দুই বছর পর লাকসাম কো-অপারেটিভ ব্যাংকের সচিব হন হাছানুজ্জামান। তিনি অনেক পরিশ্রম করে ব্যাংকের জন্য দোতলা সুরম্য ভবন নির্মাণের গৌরব অর্জন করেন।[৩]
তিনি ১৯৩৫ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ইউনিয়ন বোর্ডে পুনরায় নির্বাচিত হোন। ১৯৩৫ সালের স্থানীয় নির্বাচনের আগে ফাল্গুনের অমাবস্যায় মকরবপুরের সতীশ চন্দ্র কর জমিদার তহসিল কাছারি থেকে তার সঙ্গী মনসুর আহমদ, মৌলভী আব্দুল গণি এবং তার ছোট ভাই মৌলভী আলী আহমদকে নিয়ে হরিপুর যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হন। হাছানুজ্জামান তাদের রক্ষা করতে এসে গুরুতর আহত হন। তিনি ৩২ দিন কুমিল্লা হাসপাতালে বন্দী ছিলেন এবং কাছাকাছি মৃত্যুর অভিজ্ঞতা থেকে বেঁচে যান।[১]
হাসানুজ্জামান ১৯৩৭ সালের বেঙ্গল বিধানসভা নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিপ্পরা দক্ষিণ আসনে জয়লাভ করেন। আসনটি বর্তমান চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, নাঙ্গলকোট এবং হাজীগঞ্জ এলাকা নিয়ে গঠিত।[৪] পরের বছর হাসানুজ্জামান আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে বোর্ডের প্রথম জাতিগত বাঙালি সদস্য হন। ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ রাজ তাকে খান সাহেব উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি নাঙ্গলকোট আরিফুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং একই বছর এ কে ফজলুল হকের সহায়তায় পরীক্ষা পরিচালনার অনুমোদন ও অনুমতি পান। ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়, হাসানুজ্জামান সমবায় বিভাগের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার এ এম মার্টিনকে নাঙ্গলকোটে আমন্ত্রণ জানান।[২]
১৯৪৬ সালের বাংলার আইনসভা নির্বাচনে একটি আসনে জয়ী হতে ব্যর্থ হওয়ার পর, হাসানুজ্জামান হজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ফেরার পথে তিনি করাচিতে থামেন যেখানে তিনি সংক্ষিপ্তভাবে পাকিস্তান কো-অপারেটিভ বিভাগের ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫৪ সালের পূর্ববঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কিন্তু একটি আসন জিততে ব্যর্থ হন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের রাষ্ট্রপতির সময়, হাসানুজ্জামান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হন। তিনি গোলাম ফারুকীর আমলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ে সংসদীয় সচিব (বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর সমতুল্য) ছিলেন এবং হুইপ হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে তিনি ভূমি সংস্কার কমিটির সদস্য হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সানসেট আইন ৩০ চৈত্র আইনের বিরুদ্ধে সংসদে সরকার বিরোধী বক্তৃতা পেশ করেন এবং বলেছিলেন যে প্রয়োজনে তিনি তার আসন ছেড়ে দিতে দ্বিধা করবেন না। (এই আইন অনুযায়ী ৩০ মাসের মধ্যে খাজনা পরিশোধ না করলে জমি নিলাম করা হবে)। তিনি গাঁজা মদ জুয়া এবং অন্যান্য অনৈসলামিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও আইন প্রণয়নের জন্য বক্তৃতা দেন। পার্লামেন্টে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ধারণা প্রকাশ করেন। ১৯৬৩, ১৯৬৪ এবং ১৯৬৫ সালে, টানা তিন বছর তিনি সার্শিনার বার্ষিক অধিকার এবং সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বন্টনের উপর জোর দিয়েছিলেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে বরিশাল ও কক্সবাজারের বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হতে ব্যর্থ হন।[৩]
মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার
সম্পাদনা১৯৬৫ সালের পর থেকে তার শরীরও মন বিভিন্ন কারণে ভেঙ্গে পড়ছিল। তদুপরি বহুমূত্র রোগ ও হৃদযন্ত্রের অসুস্থতা দেখা দিল। ১৯৬৮ সালের ১৪ এপ্রিল তিনি ওনার ছেলে একে এম রফিকুজ্জামানের বসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর ওনাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পিজিতে) ভর্তি করা হয়। ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ভোর ৭টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ৪ ছেলে ৪ মেয়ে রেখে যান। সন্তানরা হলেন, ক্রমিক অনুসারে মিসেস মাহমুদা বেগম,মিসেস ছালেহা বেগম, ডা. একে এম কামারুজ্জামান খান, একিএম শামছ্জ্জুামান খান, একে এম রফিকুজ্জামান খান, মিসেস রোকেয়া বেগম, একেএম মাহবুব-উজ-জামান খান, মোসাম্মৎ উম্মে কুলছুম[৩]
মৃত্যুকালীন তার শেষ কথা ছিল এক. নাঙ্গলকোটে একটা কলেজ স্থাপন করা,যাতে স্থানীয় গরিব ছেলে মেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় অগ্রসর হতে পারে। দুই. নাঙ্গলকোট হাইস্কুলকে একটা আদর্শ স্কুলে পরিণত করা। তিন. তার সর্বকনিষ্ঠ ছেলে একেএম মাহবুব উজ জামানের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সুষ্ঠুভাবে শেষ করা। চার. সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে উম্মে কুলছুমকে সুপাত্রে অর্পণ করা।[১]