পোর্ট মোর্সবি
পোর্ট মোর্সবি (ইংরেজি: Port Moresby; তোক পিসিন ভাষায়: Pot Mosbi) দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র পাপুয়া নিউ গিনির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। শহরটি নিউ গিনি দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে পাপুয়া উপদ্বীপের উপকূলে, পাগা পয়েন্ট নামক অবস্থানে, ফেয়ারফ্যাক্স পোতাশ্রয় ও ওয়াল্টার উপসাগরের (গিনি উপসাগরের একটি বাহু) মধ্যবর্তী স্থানে, পোর্ট মোর্সবি পোতাশ্রয়ের পূর্ব তীরে অবস্থিত। প্রশাসনিকভাবে পোর্ট মোর্সবি পাপুয়া নিউ গিনি-র কেন্দ্রীয় প্রদেশের রাজধানী শহর, কিন্তু শহরটি নিজেই জাতীয় রাজধানী জেলা নামের আরেকটি সমগুরুত্বপূর্ণ প্রশসানিক অঞ্চল গঠন করেছে। জনসংখ্যার বিচারে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বাইরে এটি দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বৃহত্তম শহর।
পোর্ট মোর্সবি Pot Mosbi | |
---|---|
পাপুয়া নিউগিনির মধ্যে অবস্থান | |
স্থানাঙ্ক: ৯°২৮′৪৪″ দক্ষিণ ১৪৭°০৮′৫৮″ পূর্ব / ৯.৪৭৮৮৯° দক্ষিণ ১৪৭.১৪৯৪৪° পূর্ব | |
দেশ | পাপুয়া নিউ গিনি |
বিভাগ | জাতীয় রাজধানী জেলা |
প্রতিষ্ঠিত | ১৮৭৩ |
সরকার | |
• গভর্নর | পাওস পার্কোপ (২০০৭-) |
আয়তন | |
• মোট | ২৪০ বর্গকিমি (৯০ বর্গমাইল) |
উচ্চতা | ৩৫ মিটার (১১৫ ফুট) |
জনসংখ্যা (২০১১ আদমশুমারি) | |
• মোট | ৩,৬৪,১৪৫ |
• জনঘনত্ব | ১,৫০০/বর্গকিমি (৩,৯০০/বর্গমাইল) |
ভাষাসমূহ | |
• প্রধান ভাষা | মোটু, টোক পিসিন, ইংরেজি |
সময় অঞ্চল | এইএসটি (ইউটিসি+১০) |
পোস্টাল কোড | ১১১ |
ওয়েবসাইট | www |
শহরটিকে ঘিরে রয়েছে রবার গাছের বাগান, পরীক্ষামূলক গবাদিপশুর খামার এবং দুগ্ধখামার। এখান থেকে কোপরা বা শুষ্ক নারিকেল শাঁস, কফি, রবার, কাঠ ও স্বর্ণ রপ্তানি করা হয়। এখানকার মূল শিল্পগুলি হল করাতকল, মদ চোলাই, তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ, হস্তশিল্প ও কংক্রিট উৎপাদন। মৎস্যশিকারও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। পাপুয়া নিউ গিনিতে অনেক খনিজ সম্পদ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান ও সিঙ্গাপুর দেশটির শিল্পখাত উন্নয়নের ব্যাপারে সহায়তা দান করেছে। ২০১৮ সালে পোর্ট মোর্সবিতে এপেক (খনিজ তেল রপ্তানিকারী রাষ্ট্রসমূহের সংস্থা)-এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
পোর্ট মোর্সবিতে পাপুয়ার সরকারী কার্যালয় ভবনগুলি ছাড়াও একটি আঞ্চলিক জাদুঘর, ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত পাপুয়া নিউ গিনি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কর্মকাণ্ড ইন্সটিটিউট, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান এবং কয়েকটি ক্রীড়াকেন্দ্র অবস্থিত। শহরের দক্ষিণে এলা সমুদ্রসৈকতে সমুদ্রস্নানের চমৎকার ব্যবস্থা আছে। লালোকি নদী থেকে সুপেয় পানির সরবরাহ করার ব্যবস্থা আছে; নদীটির উপরে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রও আছে। শহরে সন্নিকটে বোওয়ানা নামের যুদ্ধ সমাধিস্থলটি অবস্থিত।
স্থানীয় ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পোর্ট মোর্সবিতে একটি অণু-জলবায়ুর সৃষ্টি হয়েছে। ওয়েন স্ট্যানলি পর্বতশ্রেণী দ্বারা সুরক্ষিত বলে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত অনেক কম। বাৎসরিক ১২৭০ মিলিমিটারেরও (৫০ ইঞ্চি) কম বৃষ্টিপাত হয়, যা নিউ গিনি দ্বীপের অন্যান্য অংশের গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় অনেক কম। শুষ্ক জলবায়ুর কারণে কদাচিৎ খরা ও সুপেয় পানির অভাব দেখা যায়। কিন্তু একই সাথে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারী বর্ষণের হাত থেকে শহরটি রক্ষা পায়। সমুদ্রের মধ্যে প্রবাল প্রাচীরের কারণে পোর্ট মোর্সবির পোতাশ্রয়টি উত্তর পশ্চিম থেকে আগত প্রতিকূল জলবায়ু থেকেও সুরক্ষিত থাকে। শহরের জলবায়ু ক্রান্তীয় সাভানা প্রকৃতির (ক্যোপ্পেন শ্রেণিবিভাজন অনুযায়ী)। তাপমাত্রা প্রায় সারা বছর ধরে সর্বনিম্ন ২৩ থেকে সর্বোচ্চ ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে।
পোর্ট মোর্সবি এলাকাতে ইউরোপীয়দের আগমনের বহু হাজার বছর আগে থেকেই মোতু এবং কোইতাবু জাতির লোকেরা বাস করত। তারা মৎস্য শিকার করত ও রাঙা আলুর চাষ করত। মোতু জাতির লোকেরা এখানে প্রায় ২ হাজার বছর আগে অভিবাসনের মাধ্যমে আগমন করে। যদিও এলাকাটির মাটি অনুর্বর এবং এখানে বৃষ্টিপাত কম, তা সত্ত্বেও তারা বিশালাকার (৫০ ফুট দীর্ঘ) পালতোলা নৌকা বানিয়ে পাপুয়া উপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে নৌকায় ভ্রমণ করতে পারত এবং অন্যান্য বসতিগুলির সাথে বাণিজ্য করত; তারা মৃৎশিল্পজাত বিভিন্ন দ্রব্যের বিনিময়ে সাগু ময়দা আমদানি করত।
পোর্ট মোর্সবি এখন যে এলাকাটিতে, সেখানে ১৮৭৩ সালে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন জন মোর্সবি একটি অভিযান সম্পন্ন করেন। তিনি তাঁর বাবার অ্যাডমিরাল স্যার ফেয়ারফ্যাক্স মোর্সবি-র নামে এলাটির একাংশের নাম রাখেন ফেয়ারফ্যাক্স এবং অপর অংশের নাম রাখেন মোর্সবি। এর প্রায় ১০ বছর পরে ১৮৮৪-৮৫ সালে যুক্তরাজ্য ব্রিটিশ নিউ গিনি উপনিবেশটি সৃষ্টি করে এবং সমগ্র এলাকাটিকে পোর্ট মোর্সবি নাম দিয়ে উপনিবেশের রাজধানী বানায়।
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোর্ট মোর্সবি মিত্রশক্তিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ছিল। যুদ্ধের দুই পক্ষই প্রবাল সাগর ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শহরটিকে দখলে রাখতে চাইছিল। ১৯৪২ সালে প্রবাল সাগরের যুদ্ধে জাপানি নৌবাহিনী শহরটিকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী তাদের সাথে যুদ্ধ করে ও তাদের পরাজিত করে। এর পরের বছর জাপান স্থলপথে ওয়েন স্ট্যানলি পর্বতশ্রেণী অতিক্রম করে শহরটি আক্রমণ করলে সেটিকেও মিত্রবাহিনী রুখে দেয়।
১৯৪৫ সালের পরে এটি অস্ট্রেলীয় বহির্দেশীয় অঞ্চল পাপুয়া এবং পরে অস্ট্রেলিয়া-শাসিত জাতিসংঘ ট্রাস্ট অঞ্চল নিউ গিনির প্রশাসনিক রাজধানীতে পরিণত হয়। অস্ট্রেলীয়দের শাসনামলে শহরটি একটি অনুন্নত বন্দর শহর থেকে আধুনিক সুযোগসুবিধাসম্পন্ন একটি সুপরিকল্পিত শহরে পরিণত হয়। ১৯৭৪ সালে পোর্ট মোর্সবিকে জাতীয় রাজধানী জেলার মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে পাপুয়া নিউ গিনি স্বাধীনতা লাভ করলে পোর্ট মোর্সবি এর রাজধানীতে পরিণত হয়।
১৯৬৯, ১৯৯১ ও ২০১৫ সালে পোর্ট মোর্সবিতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার (প্যাসিফিক গেমস) আয়োজন হয়। শহরে ক্রিকেট, ফুটবলও রাগবি খেলার আলাদা আলাদা ক্রীড়াক্ষেত্র আছে।
পোর্ট মোর্সবি শহরে ৩ লক্ষ ৬৪ হাজার লোকের বাস। শহরের প্রান্তসীমায় অবস্থিত বস্তিতে বাস করা লোকের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরে একটি বেশ বড় চীনা-বংশোদ্ভূত সম্প্রদায় আছে।
পোর্ট মোর্সবি থেকে জাহাজপথে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর এবং পাপুয়ার নিউ গিনির অন্যান্য বন্দর শহরে যোগাযোগ আছে। এখানে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও আছে, যার নাম জ্যাকসনস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সোগেরি, কুইকিলা এবং রুয়ানা জলপ্রপাতে সড়কপথে যাওয়ার সুব্যবস্থা আছে।