দ্বাপর যুগ

হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী চার যুগের তৃতীয় যুগ

দ্বাপরযুগ (সংস্কৃত: द्वापरयुग) হলো হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, চার যুগের তৃতীয় যুগ। অন্য যুগগুলো হলো সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, ও কলিযুগ

হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, মহাভারতের ঘটনা দ্বাপর যুগে ঘটেছিল

ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে বৃহস্পতিবারে দ্বাপরযুগের উৎপত্তি। এর পরিমাণ ৮,৬৪,০০০ বছর। এ যুগের অবতার হলেন কৃষ্ণবলরাম

পুণ্য অর্ধেক, পাপ অর্ধেক। শাসক ছিল-শাল্ব, বিরাট, হংসধ্বজ, কুশধ্বজ, ময়ুরধ্বজ, বভ্রুবাহন, রুক্ষাঙ্গদ, ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন, যুধিষ্ঠির, পরীক্ষিৎ, জনমেজয়, বিষকসেন, শিশুপাল, জরাসন্ধ, উগ্রসেন, কংস।মানুষের উচ্চতা ছিল ৭ হাত পরিমিত বা প্রায় ১১ ফুট। আয়ু ছিল ১,০০০ বছর। প্রাণ ছিল রক্তে। বেদ ছিল যজুর্বেদ। তামার পাত্র ব্যবহার করা হত। তীর্থ ছিল কুরুক্ষেত্র। তারক ব্রহ্মনাম- হরে মুরারে মধুকৈটভারে গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরে যজ্ঞেশ নারায়ণ কৃষ্ণ বিষ্ণো নিরাশ্রয় মাং জগদীশ রক্ষো। অর্থাৎ হে হরি মুরারী মধু কৈটভ অরি, গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরি, নারায়ণ কৃষ্ণ বিষ্ণু যজ্ঞেশ, নিরাশ্রয় আমাকে, হে জগদীশ, রক্ষা কর।

বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, দ্বাপর যুগ হলো চার যুগের তৃতীয় যুগ। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে বৃহস্পতিবারে দ্বাপর যুগের উৎপত্তি। এই যুগে সত্য যুগে বিদ্যমান ধর্মের চার পাদ হতে দ্বিপাদ হীন হয়ে দ্বিপাদ বিদ্যমান থাকে।[১] এই যুগে পুণ্য অর্ধেক, পাপ অর্ধেক। এই যুগে প্রাণ ছিল রক্তে, এবং তামার পাত্র ব্যবহার করা হত। দ্বাপর যুগের বেদ-যজুর্বেদ

দ্বাপর যুগের ব্যাপ্তিকাল সম্পাদনা

 
হিন্দু টাইম চার্ট

হিন্দুগ্রন্থে চারটি যুগের (বিশ্বযুগ) কথা বর্ণনা হয়েছে, যেখানে এই চার যুগ চক্রাকারে আবরর্তন করে। সত্যযুগ হতে শুরু করে পরবর্তী যুগের (ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি) দৈর্ঘ্য ক্রমে এক-চতুর্থাংশ (২৫%) করে হ্রাস পায়।[২][৩] প্রতিটি যুগকে তার যুগ-সন্ধ্যা (ঊষা) এবং যুগ-সন্ধ্যাংশের (সন্ধ্যা) মধ্যবর্তী একটি প্রধান সময়কাল হিসাবে বর্ণনা করা হয়, যেখানে প্রতিটি গোধূলি (ভোর/সন্ধ্যা) প্রধান সময়কালের দশমাংশ অবধি থাকে। অর্থাৎ সত্যযুগ ৪,০০০ দৈব বছর হলে এবং ওই যুগের আগে ৪০০ দৈববছর সন্ধ্যা এবং শেষে ৪০০ দৈববছর সন্ধ্যাংশ হয়।[৪] পরবর্তী যুগগুলোতে সময়ের পরিমাণ ১,০০০(এক হাজার) দৈববছর করে এবং সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ ১০০(এক শত) দৈববছর করে কমে যায়। এর সময় দৈর্ঘ্যকে কখনো দৈব-বছর এককে হিসাব করা হয়। প্রতিটি দৈব-বছর ৩৬০টি সৌর (মানব) বছরের সমান।[৫][৬][৭]

দ্বাপর হচ্ছে চারযুগের মাঝে তৃতীয়। ঊষা ও সন্ধ্যা সহ দ্বাপর যুগের সময়কাল মোট ২,৪০০ দৈব বছর বা ৮৬৪,০০০ সৌর বছর।[৩][২]

  • দ্বাপরযুগ সন্ধ্যা (ঊষা): ৭৩,০০০ (২০০ দৈব) বছর
  • দ্বাপরযুগ (মধ্য): ৭২০,০০০ (২০০০ দৈব) বছর
  • দ্বাপরযুগ সন্ধ্যা (সন্ধ্যা):৭২,০০০ (২০০ দৈব) বছর

দ্বাপর যুগের অবতার সমূহ সম্পাদনা

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী দ্বাপর যুগে বিষ্ণুর অবতার সংখ্যা দুই।[৮] অর্থাৎ, এই সময়টিতে ধর্ম রক্ষার্থে স্বয়ং বিষ্ণু দুইটি রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

পুরাণে বর্ণিত দ্বাপর যুগের ঘটনাসমূহ সম্পাদনা

ভীমের রাজত্বের পর যদু বংশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সতবতের দুই পুত্র অন্ধকবৃষ্ণি নিজ নিজ নামে রাজ্য পরিচালনা করেন। কংসের পিতা উগ্রসেন ছিলেন অন্ধক বংশীয়। অপরদিকে কৃষ্ণের পিতা বাসুদেব ছিলেন বৃষ্ণি বংশীয়।

পাঞ্চাল ভরত বংশীয় রাজা সৃঞ্জয় এ সময় খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন। তার পুত্র চ্যবন ও পিজবন ছিলেন বীর যোদ্ধা। পিজবনের পুত্র সুদাস। তিনিও কিছু রাজ্য জয় করে সুদাস বংশের পত্তন করেন। কুরু, যাদব, শিবি, দ্রুহ্য, মৎস্য তুর্বসু ও অন্যান্যরা মিলে এক আন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজ্য স্থাপন করে। কেননা সুদাস রাজা তাদের সবাইকে পরুশ্নি নদীর তীরে এক বিশাল যুদ্ধে পরাজিত করে। এ যুদ্ধকে বলা হয় দশ রাজার যুদ্ধ[৯] ঋগ্বেদের অনেকগুলো শ্লোকে এ বংশের ৫-৬ পুরুষ পর্যন্ত রাজাদের ও তাদের সমসাময়িক কবিদের সম্পর্কে বলা আছে।[১০]

হস্তীর পুত্র অজমীঢ় কুরু/কৌরব বংশ অব্যহত রাখেন। পাঞ্চালরা এ বংশের সংবরণ রাজাকে সিন্ধু নদের তীরে এক যুদ্ধে পরাজিত করে তাকে বনবাসে পাঠান। পারগিটার এই পাঞ্চাল নরেশকে সুদাস বংশীয় বলে উল্লীখ করেন, কিন্তু তার সাথে এ বংশের কি সম্পর্ক বা তার বংশ পরিচয়ের কোন উল্লেখ করেননি। পরে সংবরণ পাঞ্চালদের কাছ থেকে তার রাজ্য উদ্ধার করেন ও সূর্য কন্যা তপতীকে বিয়ে করেন।[১১] নাট্যকার কুলশেখর(খ্রিঃ ৯০০) এ কাহিনীকে তার তপতি-সংবরণ নাটকে অমর করে রেখেছেন। তপতী ও সংবরণের পুত্র কুরু। কুরুর বংশধরগণ কৌরব নামে পরিচিত। তারপর কুরুর দ্বিতীয় পুত্র জহ্নু ক্ষমতায় বসেন।

কুরু বংশীয় বসু, যদু বংশের চেদী রাজ্য জয় করে সেখানে শাসন করতে থাকেন। তার জ্যেষ্ঠপুত্র বৃহদ্রথ মগধের রাজগিরিতে রাজধানী স্থাপন করেন। বৃহদ্রথের পুত্র জরাসন্ধ তার ক্ষমতা উত্তরে মথুরা ও দক্ষিণে বিদর্ভ পর্যন্ত বিস্তার করতে সক্ষম হন। উল্লেখ্য, যে মথুরার অন্ধক রাজা কংস তার বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। কংস ছিল অত্যাচারী শাসক। সে তার পিতা উগ্রসেন কে বন্দী করে ক্ষমতা দখল করে। কংসের ভাগ্নে শ্রীকৃষ্ণ। তিনি কংসকে বধ করে উগ্রসেনকে মুক্ত করে হৃত সিংহাসন ফিরিয়ে দেন। এতে জরাসন্ধ ক্ষিপ্ত হয়ে মথুরা আক্রমণ করেন। কৃষ্ণ তখন অন্ধক ও বৃষ্ণিদের সাথে পশ্চিম দিকে সৌরাষ্ট্রের দ্বারকায় রাজধানী স্থানান্তরিক হন। এরপর কৃষ্ণ বিদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিনীকে হরণ করতে গিয়ে রুক্মিনীর ভ্রাতাকে পরাজিত করেন ও রুক্মিনীকে বিয়ে করেন।[১২] পরবর্তী জীবনে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের মিত্রে পরিণত হন। (নিচে দেখুন।)

পরবর্তী বিখ্যাত কৌরব রাজা হলেন প্রতীপ। তার পুত্র শান্তনু । প্রতীপের জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবাপি সিংহাসনে বসলে বারো বছর রাজ্যে কোন বৃষ্টিপাত হয় না। এতে দেবাপি তার অনুজ শান্তনুকে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে প্রধান ধর্ম গুরুর ভূমিকা পালন করে যজ্ঞ করতে থাকেন। ফলে অচিরেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়।[১৩]

ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু ছিলেন শান্তুনুর পৌত্র । ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠ হলেও অন্ধ হওয়ার কারণে রাজ্য শাসনের অযোগ্য হন। ফলে পাণ্ডু সিংহাসনে বসেন। ধৃতরাষ্ট্রের অনেক পুত্র সন্তান ছিল, জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন। অপরদিকে পাণ্ডুর ছিল পাঁচ পুত্র যথা- যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুলসহদেব। ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু জ্যেষ্ঠ তাই তার পুত্রদের কৌরব বংশের ধরা হয়। আর পাণ্ডুর পুত্রদের পাণ্ডব বলা হয়। কুরু সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী কে, এ প্রশ্নে দুই পরিবারের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়। শান্তিপূর্ণ কোন সমাধান না হওয়ায় এ দুই পরিবার এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বলা হয় যে ভারতের সকল ক্ষত্রিয় রাজারা কোন না কোন এক পক্ষের হয়ে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আঠারো দিন ব্যাপী এ যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে পাণ্ডবরা অনেক চাপের মধ্যে থাকলেও শ্রীকৃষ্ণের অসাধারণ বুদ্ধির কারণে তারা জয়ী হয়। মহাভারতে-এ যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা আছে।

উত্তরকালে যাদবরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, কৃষ্ণও নিজেকে ধ্যানে মগ্ন রাখেন। দৈবক্রমে এক শিকারির বাণ এসে কৃষ্ণকে বিদ্ধ করে ও তিনি তিরোহিত হন।[১৪] পাণ্ডবরা কৃষ্ণের পৌত্রকে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজ্যভার দেন। শীঘ্রই পাণ্ডবরা ও অর্জুনের পৌত্র পরীক্ষিতকে হস্তীনাপুরের উত্তরাধিকারী করে নিজেরা বানপ্রস্থে গমন করেন। শ্রীকৃষ্ণের তিরোভাবের সাথে সাথে দ্বাপর যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. মনুসংহিতা ১ম অধ্যায়, ৮২শ্লোক
  2. মনুসংহিতা ১ম অধ্যায়, ৭০শ্লোক
  3. সূর্যসিদ্ধান্ত ১ম অধ্যায় ১৫-১৭
  4. মনুসংহিতা ১ম অধ্যায়, ৬৯শ্লোক
  5. Godwin, Joscelyn (২০১১)। Atlantis and the Cycles of Time: Prophecies, Traditions, and Occult RevelationsInner Traditions। পৃষ্ঠা ৩০০–৩০১। আইএসবিএন 9781594778575 
  6. Gupta, Dr. S. V. (২০১০)। "Ch. 1.2.4 Time Measurements"। Hull, Prof. Robert; Osgood, Jr., Prof. Richard M.; Parisi, Prof. Jurgen; Warlimont, Prof. Hans। Units of Measurement: Past, Present and Future. International System of Units। Springer Series in Materials Science: 122। Springer। পৃষ্ঠা ৬–৮। আইএসবিএন 9783642007378Paraphrased: Deva day equals solar year. Deva lifespan (36,000 solar years) equals 100 360-day years, each 12 months. Mahayuga equals 12,000 Deva (divine) years (4,320,000 solar years), and is divided into 10 charnas consisting of four Yugas: Satya Yuga (4 charnas of 1,728,000 solar years), Treta Yuga (3 charnas of 1,296,000 solar years), Dvapara Yuga (2 charnas of 864,000 solar years), and Kali Yuga (1 charna of 432,000 solar years). Manvantara equals 71 Mahayugas (306,720,000 solar years). Kalpa (day of Brahma) equals an Adi Sandhya, 14 Manvantaras, and 14 Sandhya Kalas, where 1st Manvantara preceded by Adi Sandhya and each Manvantara followed by Sandhya Kala, each Sandhya lasting same duration as Satya yuga (1,728,000 solar years), during which the entire earth is submerged in water. Day of Brahma equals 1,000 Mahayugas, the same length for a night of Brahma (Bhagavad-gita 8.17). Brahma lifespan (311.04 trillion solar years) equals 100 360-day years, each 12 months. Parardha is 50 Brahma years and we are in the 2nd half of his life. After 100 years of Brahma, the universe starts with a new Brahma. We are currently in the 28th Kali yuga of the first day of the 51st year of the second Parardha in the reign of the 7th (Vaivasvata) Manu. This is the 51st year of the present Brahma and so about 155 trillion years have elapsed. The current Kali Yuga (Iron Age) began at midnight on 17/18 February 3102 BC in the proleptic Julian calendar. 
  7. Merriam-Webster (১৯৯৯)। "Merriam-Webster's Encyclopedia of World Religions" Doniger, Wendy; Hawley, John Stratton। Merriam-WebsterMerriam-Webster, Incorporated। পৃষ্ঠা 445 (Hinduism), 1159 (Yuga)আইএসবিএন 0877790442
    * HINDUISM: Myths of time and eternity: ... Each yuga is preceded by an intermediate "dawn" and "dusk". The Krita yuga lasts 4,000 god-years, with a dawn and dusk of 400 god-years each, or a total of 4,800 god-years; Treta a total of 3,600 god-years; Dvapara 2,400 god-years; and Kali (the current yuga) 1,200 god-years. A mahayuga thus lasts 12,000 god-years ... Since each god-year lasts 360 human years, a mahayuga is 4,320,000 years long in human time. Two thousand mahayugas form one kalpa (eon) [and pralaya], which is itself but one day in the life of Brahma, whose full life lasts 100 years; the present is the midpoint of his life. Each kalpa is followed by an equally long period of abeyance (pralaya), in which the universe is asleep. Seemingly the universe will come to an end at the end of Brahma's life, but Brahmas too are innumerable, and a new universe is reborn with each new Brahma.
    * YUGA: each yuga is progressively shorter than the preceding one, corresponding to a decline in the moral and physical state of humanity. Four such yugas (called ... after throws of an Indian game of dice) make up a mahayuga ("great yuga") ... The first yuga (Krita) was an age of perfection, lasting 1,728,000 years. The fourth and most degenerate yuga (Kali) began in 3102 BCE and will last 432,000 years. At the close of the Kali yuga, the world will be destroyed by fire and flood, to be re-created as the cycle resumes. In a partially competing vision of time, Vishnu's 10th and final AVATAR, KALKI, is described as bringing the present cosmic cycle to a close by destroying the evil forces that rule the Kali yuga and ushering in an immediate return to the idyllic Krita yuga.
     
  8. Garuda Purana (1.86.10–11)
  9. Rigveda, VII.18;VII.83
  10. Witzel, Michael. The Development of the Vedic Canon and its Schools: The Social and Political Milieu. Inside the Texts, Beyond the Texts. Harvard Oriental Series (1997)
  11. Mahabharata, I.173-175
  12. Visnu Purana, V
  13. Brihaddevata, vii,155-7, viii.1-9
  14. Mahabharata, XIX

আরও দেখুন সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা