দীনেশচন্দ্র মজুমদার

ব্রিটিশ বিরোধী বাঙালি বিপ্লবী

দীনেশচন্দ্র মজুমদার (১৯ মে ১৯০৭ - ৯ জুন ১৯৩৪) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী। প্রতিবেশী বিপ্লবী অনুজাচরণ সেনের মাধ্যমে যুগান্তর বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঘা যতীনের নেতৃত্বে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময় বালেশ্বরের গুপ্ত ঘাঁটির পরিচালক শৈলেশ্বর বোস যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলে অনুজাচরণের সঙ্গে রাত জেগে সেবা করেন। এরপর দলনেতার নির্দেশে তিনি বগুড়া ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় বিপ্লবী সংগঠনের কাজে বর্তী হন। লাঠি খেলার শিক্ষক হিসেবে "ছাত্রী সংঘ" প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন।[১]

দীনেশচন্দ্র মজুমদার
জন্ম(১৯০৭-০৫-১৯)১৯ মে ১৯০৭
মৃত্যু৬ জুন ১৯৩৪(1934-06-06) (বয়স ২৭)
আলিপুর সেন্ট্রাল জেল
জাতীয়তাবাঙালি
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারত
পরিচিতির কারণভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন
রাজনৈতিক দলযুগান্তর দল
পিতা-মাতাপূর্ণচন্দ্র মজুমদার (পিতা)
বিনোদিনী দেবী (মাতা)

জন্ম সম্পাদনা

দীনেশচন্দ্র মজুমদারের জন্ম হয় ১৯০৭ সালের ১৯শে মে (৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৪ বঙ্গাব্দ) উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে। তার পিতার নাম পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। মাতা বিনোদিনী দেবী। তাদের চার পুত্র ও তিন কন্যার দ্বিতীয় সন্তান দীনেশ। দীনেশের ডাকনাম ছিল মেনি। শৈশবেই দীনেশ পিতৃহারা হন। আপাত দৃষ্টিতে দীনেশ শান্তশিষ্ট হলেও, ছোটবেলায় বেশ ডাকাবুকো ছিলেন।প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি বড় হয়েছেন।১৯২৪ সালে ১৭ বৎসর বয়সে বসিরহাট হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কলকাতায় আসেন জ্যেঠামশাই হরিমোহন মজুমদারের আশ্রয়ে। এখানেই লেখাপড়ার পাশাপাশি চলতে থাকে শরীরচর্চা, বিপ্লবী কাজকর্ম। দীনেশ বসিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তারপরে তিনি ১৯২৮ সালে B.Sc শেষ করেন এবং তারপরে একটি আইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি বিখ্যাত বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর কাছ থেকে বিপ্লবের পাঠ ও আদর্শবাদ শিখেন এবং ব্রিটিশবিরোধী গুপ্ত গোষ্ঠী 'যুগান্তর'-এর সদস্য হন, যারা এর মহিলা সদস্যদের জন্য লাঠি-খেলা এবং ছুরি-খেলা অনুশীলন করত।[২] ১৯২৮ সনে বি.এ. পাশ করে আইন শিক্ষা শুরু করেন। আই.এ. পড়ার সময় যোগাভ্যাস করতেন, পরে সিমলা ব্যায়াম সমিতিতে লাঠি ও ছোরা খেলা শিক্ষা করেন।[১]

রাজনৈতিক জীবন সম্পাদনা

তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা এবং উত্সর্গের গুণে, দীনেশ শীঘ্রই 'যুগান্তর' পার্টিতে একটি জনপ্রিয় নাম হয়ে ওঠেন যার মধ্যে কল্যাণী দাস (ভট্টাচার্য), শান্তিসুধা ঘোষ (পরে হুগলির মহাসিন কলেজের অধ্যক্ষ হন), সুলতা কর (প্রখ্যাত লেখক এবং সমাজকর্মী), প্রভাত নলিনী দেবী, লীলা কমলে (মহারাষ্ট্রের ছাত্রী), আভা দে, কমলা দাশগুপ্তের মতো মহিলা সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সুরমা মিত্র (সমিতির সভাপতি), সুহাসিনী দত্ত, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ। ১৯২১ সালের নাগরিক অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিভিন্ন বিপ্লবী পার্টি/গোষ্ঠী/সমিতির ব্রিটিশবিরোধী গোপন কার্যকলাপ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিকে হুমকির মুখে ফেলে এবং আলোড়িত করে। এর মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল পূর্ববঙ্গের 'অনুশীলন সমিতি' এবং পশ্চিমবঙ্গের 'যুগান্তর'। দীনেশ তাঁর জন্মস্থান বসিরহাটে আসেন এবং ডঃ যতীন্দ্রনাথ ঘোষালের সাথে সক্রিয় সহযোগিতায় নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিকদের সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ শুরু করেন। স্টেট ব্যাঙ্কের তৎকালীন পুরনো বাড়ির একটি মাটির ঘরে দীনেশের উদ্যোগে জড়ো হয়েছিল দুঃসাহসী যুবকরা। উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবীদের একটি গোপন ও প্রশিক্ষিত দল গড়ে তোলা যারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আত্মগঠন ও দেশপ্রেমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে।

টেগার্ট হত্যা চেষ্টা সম্পাদনা

১৯৩০ সালে দীনেশ বসিরহাটে 'জাতীয় পাঠাগার' (গ্রন্থাগার) এবং 'ব্যামপীঠ' (যোগ কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করেন। পরেরটি বিপ্লবী সৈন্যদের তালিকাভুক্ত করার জন্য একটি গোপন কেন্দ্র ছিল যারা আগুন-অস্ত্র, লাঠি, ছুরি প্রশিক্ষণ এবং বোমা প্রস্তুত করত। ১৯৩০ সালের ২৫ আগস্ট দীনেশ ও তাঁর তিন সহযোগী অনুজাচরণ সেন, শৈলেন নেওগী ও অতুল সেন কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার চার্লস অগাস্টাস টেগার্টকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন। দীনেশ ধরা পড়ে এবং একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার হয় এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭/১২০ বি, আইপিসি ৩০৭/৩৪, ৪বি, ৩(৬) বিস্ফোরক পদার্থ আইনের অধীনে দোষী সাব্যস্ত হয় এবং মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়।

১৯৩২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দীনেশ, আরও দুই বিপ্লবী সহযোগী শচীন করগুপ্তসুশীল দাশগুপ্ত জেল থেকে পালিয়ে যান এবং পরিচয় গোপন রাখেন। একই বছরের ৫ আগস্ট ও ২৮ সেপ্টেম্বর তারা দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক আলফ্রেড ওয়াটসনকে আক্রমণ করে। অবশেষে চন্দননগরে তাকে আশ্রয় দেন বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষ[১]

ওয়াটসন হত্যা চেষ্টা ও কুইন হত্যা সম্পাদনা

১৯৩২ সালে তার নেতৃত্বাধীন দু'বার ওয়াটসন হত্যার চেষ্টা হয়। চন্দননগরের পুলিস কমিশনার কুইনের নেতৃত্বে একদল পুলিস বিপ্লবীদের তাড়া করলে দীনেশের গুলিতে কুইন নিহত হন এবং তিনি বিপ্লবীদের নিয়ে আত্মগোপন করেন।[১]

দলের পুনর্গঠন ও কর্নওয়ালিস স্ট্রিট খণ্ডযুদ্ধ সম্পাদনা

১৯৩২ সালের দিকে পুলিসি অত্যাচার ও ব্যাপক গ্রেপ্তারের ফলে দলের অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন তিনি দলের পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেন। গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের জনৈক কর্মচারীর সাহায্যে টাকা সরিয়ে সেই টাকায় অস্ত্র কেনার চেষ্টা হয়। এসময় তিনি কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে নারায়ন ব্যানার্জীর বাড়িতে থাকতেন। ১৯৩৩ সনের ২৫ মে পুলিস সন্ধান পেয়ে বাড়িটি আক্রমণ করলে উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় চলে। দীনেশ, জগদানন্দ ও নলিনী দাস শেষ বুলেট পর্যন্ত লড়াই করে আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। বিচারে তার প্রাণদণ্ডাদেশ এবং অপর দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।[১]

ডালহৌসী স্কোয়ার বোমা মামলা সম্পাদনা

২৫ আগস্ট, ১৯৩০ তারিখে অনুজাচরণ সেনদীনেশচন্দ্র মজুমদার অত্যাচারী কুখ্যাত চার্লস টেগার্ট সাহেবের গাড়ীতে বোমা নিক্ষেপ করেন। টেগার্ট বেঁচে যান কিন্তু দীনেশ মজুমদার ধরা পড়েন। অনুজাচরণ ঘটনাস্থলেই মারা যান। বিচারে দীনেশ মজুমদারের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। এই উপলক্ষে পুলিস বহু বাড়ি খানাতল্লাশ করে এবং বহু লোককে গ্রেপ্তার করে। এই সম্পর্কে শোভারানি দত্ত, কমলা দাশগুপ্ত, শৈলরাণী দত্ত, ডা. নারায়ণ রায়, ভূপালচন্দ্র বসু, অদ্বৈত দত্ত, অম্বিকা রায়, রসিকলাল দাস, সতীশ ভৌমিক, সুরেন্দ্র দত্ত, রোহিণী অধিকারীসহ অনেকে ধৃত হন। বিচারে নারায়ণ রায় ও ভূপাল বসু ১৫ বছরের দ্বীপান্তর, সুরেন্দ্র দত্ত ১২ বছর, রোহিণী ৫ বছর ও সতীশ ২ বৎসর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হন এবং অন্যান্য সকলে মুক্তি পান। তারা সকলেই তরুণ বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন।[৩]

৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২ তারিখে মেদিনীপুর জেল থেকে পালিয়ে গেলেন দীনেশ। চারিদিকে সাড়া পড়ে গেল। দীনেশের নামে হুলিয়া ঘোষণা হল, ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার। এর মধ্যেই ধরা পড়ে গেলেন বক্সা, হিজলি ও মেদিনীপুর জেল থেকে পালানো বেশীরভাগ বিপ্লবীরা, শুধু ধরা পড়লেন না দীনেশ। পুলিশ পাগলের মত তাঁর খোঁজ চালাতে লাগল। এরমধ্যেই তিনি দলের হয়ে বেশ কিছু কাজ করে ফেলেছেন। একের পর এক আস্তানা বদলে বদলে তিনি পুলিসের চোখে ধূলো দিয়ে বেড়াতে লাগলেন। অবশেষে ১৯৩৩ সালের ২২ মে এক রক্তাক্ষয়ী সংঘর্ষের পর পুলিস তাঁকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়। শুরু হল বিচার। এক এক করে অনেক অভিযোগ আনা হল তাঁর বিরুদ্ধে। জেল পালানোর ষড়যন্ত্র, কুঁই হত্যা মামলা, গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্ক প্রতারণা ইত্যাদি। অবশেষে বিচারকরা রায় দিলেন প্রাণদণ্ড।

১৯৩৪ সালের ৯ জুলাই ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দেন দীনেশ মজুমদার।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৮৮, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. "ব্রিটিশের জেলে পচে মরার জন্য মেনির জন্ম হয়নি"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-১৩ 
  3. ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, জেলে ত্রিশ বছর, পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন, ঢাকা, ঢাকা বইমেলা ২০০৪, পৃষ্ঠা ১৮৪।