তাতারস্তানের ইতিহাস

ইতিহাসের বিভিন্ন দিক

তাতারস্তান হল বর্তমানে রাশিয়ান ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত একটা অঞ্চল; প্রাগৈতিহাসিক যুগে যেখানে বিভিন্ন ধরনের নৃগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। ভোলগা বুলগেরিয়া রাষ্ট্র বিস্তারলাভ করেছিল মধ্যযুগে এবং কোনো এক সময়ে এই ভূখণ্ড খাজারদের অধীন ছিল। কালক্রমে ভোলগা বুলগেরীয়রা মুসলিম হয়ে উঠেছিল এবং বিভিন্ন তুর্কি জনগণের সমন্বয়ে ভোলগা তাতার নামে আধুনিক জাতিগত গোষ্ঠী গঠন করেছিল।

পনেরো শতকে এই অঞ্চলের আধিপত্য ছিল কাজানের খানাতের অধীনে। ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দে ইভান দ্য টেরিবল খানাতে দখল করেছিলেন এবং ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে তার বিলুপ্তি ঘটে। এই সময়টা চিহ্নিত হয়ে আছে যখন রাশিয়ানরা এই অঞ্চল দখল করে এবং তাতার ও প্রতিবেশী গোষ্ঠীদের মধ্যে অসংখ্য বিদ্রোহীকে উস্কে দিয়ে গোঁড়া খ্রিস্টান ধর্মান্তরের চেষ্টা করেছিল। আঠারো এবং উনিশ শতকের শেষদিকে শিল্পের উন্নয়ন ঘটে, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয় এবং তাতাররা রাশিয়ানদের সঙ্গে আরো সমান মর্যাদা অর্জন করে। যাইহোক, তাতারদের জাতীয় চেতনা বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর বিপ্লবের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্থাপিত হয়েছিল এবং আইডেল-ইউরাল রাষ্ট্র হিসেবে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। বেশ কয়েক বছর গৃহযুদ্ধের পর সোভিয়েত সরকার স্বাধীনতা দমিয়ে রাখে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত তাতার স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।

সোভিয়েত শাসনাধীনে খ্রিস্টান ও মুসলমান দুই তরফেই তাতার ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় অবক্ষয়ের ফলে একটা দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। বৃহৎ পেট্রোলিয়াম ভাণ্ডারগুলোর আবিষ্কার পরবর্তী ক্ষেত্রে শিল্পোন্নয়নে ভীষণভাবে সহায়ক হয়েছিল। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ইউএসএসআর পতনের সময় পুনর্বার স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন হয়, কিন্তু ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলটা তাতারস্তান নামে রাশিয়ান ফেডারেশনের অধীনে একটা সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে পরিগণিত হয়। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে একটা জাতীয় সংসদ মিলি মেজলিস তাতারস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে, কিন্তু জাতিসংঘ অথবা রাশিয়ান সরকার এই অবস্থানকে স্বীকৃতি দেয়নি।

তাতারস্তান প্রেসিডেন্টের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও সুয়ুম্বাইক টাওয়ার

প্রাক-ইতিহাস সম্পাদনা

পুরোনো প্রস্তর যুগ থেকে তাতারস্তানে মানুষের বসবাস ছিল। তাতারস্তানের মাটিতে প্রস্তর এবং ব্রোঞ্জ যুগের বিভিন্ন সংস্কৃতির পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।

খ্রিস্টপূর্ব আট শতক থেকে খ্রিস্টীয় তিন শতক অর্থাৎ লৌহ যুগের সময়কালে সম্ভবত ফিনো-ইউগ্রিয়ান মানুষ, বলা ভালো আনানইনো সংস্কৃতি ঊর্ধ্ববর্তী ভোলগা এবং কামা নদীর উপত্যকার অঞ্চলগুলিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। গোরোডেটস সংস্কৃতির মানুষ প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যবর্তী সময় থেকে পশ্চিম তাতারস্তান দখল করে নিয়েছিল।

ভোলগা-কামা অববাহিকার অধিকাংশ ভূখণ্ড ইমানকিসকা সংস্কৃতির উপজাতিরা দখল করে নিয়েছিল; সিথিয়ানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল বলে মনে করা হয়; তারা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলত। তথাকথিত প্যানোবর সংস্কৃতি (সম্ভবত ফিনিক উৎসের) নামে একটা নতুন গোষ্ঠী খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের শুরুর দিকে নিম্ন কামায় উদ্ভূত হয়েছিল।

পরবর্তী প্রাচীন সাইবেরিয়ান তুর্কি এবং ইউগ্রিক উপজাতিগুলোর মহান অভিবাসনের সময় মধ্য ভোলগার পূর্বদিকের অঞ্চলটায় বসবাস করছিল এবং প্যানোবর সংস্কৃতিকে কামা অববাহিকা থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছিল। প্যানোবর উপজাতিরা যেখানে দীর্ঘকাল ছিল বর্তমানে সেগুলোই তাতারস্তানের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অংশ।

তুর্কি জনগণ সম্পাদনা

মোটামুটি ৫০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে তুর্কি ভাষাভাষী যাযাবরদের অন্তঃপ্রবাহ ঘটতে দেখা গিয়েছিল। এই অভিবাসীদের সংস্কৃতি যেসব গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল তারা হল: গোকটার্ক, খাজার এবং মহান বুলগেরিয়ার উপজাতিগণ।

ভোলগা বুলগেরিয়া সম্পাদনা

এই অঞ্চলের প্রথম সংগঠিত রাষ্ট্র ভোলগা বুলগার খানেটের উত্থান দেখা গিয়েছিল নবম এবং দশম শতকে। ভোলগা বুলগেরিয়ার বেশির ভাগ জনগণই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। অন্যান্য শহরগুলির সঙ্গে বোলঘর, বিলার এবং সুয়ার শহরে শিল্প (ঢালাই, গঠন) এবং বাণিজ্যের উন্নয়ন দেখা গিয়েছিল। অর্থনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল শস্য উৎপাদন এবং গবাদি পশুর প্রজনন। কৃষকরা ছিল প্রধানত মুক্ত ভূমির মালিক।

ভোলগা বুলগাররা দশম শতকের গোড়ার দিকে ইসলাম ধর্মান্তরিত হয়েছিল, কারণ মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম সংস্কৃতি তাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

মোঙ্গল আক্রমণ সম্পাদনা

গোল্ডেন হর্দের বাটু খানের অধীনে মোঙ্গল বাহিনীর ভোলগা বুলগেরিয়া জয়ের পর এই দেশ খানদের নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। এই সময়কালে ভোলগা বুলগারদের বিভিন্ন তুর্কি জনগণ এবং ভাষার সংমিশ্রণের ফলে আধুনিক ভোলগা তাতার জাতিগত উত্থান ঘটেছিল।

কাজানের খানাতে সম্পাদনা

পনেরো শতকের প্রথমার্ধে গোল্ডেন হর্দের পতনের ফলস্বরূপ ভোলগা-কামা অঞ্চলের চালিকা শক্তিরূপে কাজানের খানাতের উদ্ভব হয়েছিল। যেহেতু মাস্কোভি গোল্ডেন হর্দের উত্তরসূরি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে শক্তিবৃদ্ধি এবং বাণিজ্য পথ ও অঞ্চলের জন্যে লড়াই করেছিল, এক সময়ে কাজান ছিল মস্কোর পেটোয়া উপদলের নিয়ন্ত্রণাধীনে, এবং অন্য সময়ে ক্রিমীয় খানাতের মতো অন্যান্য তাতার রাজনীতির উপদলীয় জোটের অধীনে ছিল। শেষ পর্যন্ত ইভান দ্য টেরিবল ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দে খানাতে জয় করেছিল।

রাশিয়ান আক্রমণের পরবর্তীকাল সম্পাদনা

১৫৫২ খ্রিস্টাব্দের পর মস্কো শহরে গঠিত কার্যালয় থেকে কাজান প্রাসাদ দ্বারা খানাতে শাসন করা হোত। আইডেল-উরাল জনগণকে জবরদস্তি ব্যাপ্তাইজিত করার জন্যে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে কাজানে একজন বিশপ নিয়োগ করা হয়েছিল। সেখানে অনেক গির্জা ও গুম্ফা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং রাশিয়ান কৃষক এবং হস্তশিল্পীরা তাতারস্তানের মধ্যে পুনর্বাসিত হয়েছিল। একই সময়ে জাতিগত তাতাররা মূল কাজান এবং নদী ও রাস্তার কাছাকাছি অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়েছল। ষোলো এবং সতেরো শতকের সময়কালে রাশিয়ানদের তাড়নায় বহুসংখ্যক তাতার ঊর্ধ্ব কামা, কামার অপর পারে, বাশকোর্তোস্তান, উরাল পর্বতমালা এবং সাইবেরিয়ায় প্রবাসী হয়ে গিয়েছিল। ফলে এই পুরো অঞ্চল জুড়ে কৃষি, শিল্প এবং বাণিজ্যে পতন দেখা দিয়েছিল। স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে জোর করে ইয়াসাক কর আদায় করা হোত। তাতার আভিজাত্যের কিছু অংশ রাশিয়ান সাম্রাজ্যের আভিজাত্যের সঙ্গে সামিল ছিল; অনেকে সুযোগসুবিধে পাওয়ার জন্যে ব্যাপটিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে কাজানের খানাতে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং এই ভূখণ্ড এক নতুন কাজান গভর্নরেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। এই জায়গার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মধ্য ভোলগা এবং পশ্চিম উরাল পর্বতমালা। ২০,০০০ নাগরিক নিয়ে কাজান ছিল রাশিয়ার বৃহৎ বাণিজ্য এবং হস্তশিল্প কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। উনিশ শতকের গোড়ায় উৎপাদনের বিকাশ ঘটেছিল চামড়া, সাবান এবং মোমবাতি তৈরির কারখানাগুলো স্থাপনা করে। এক শ্রেণির তাতার বণিকের উদ্ভব ঘটে, যারা মধ্য এশিয়ার সঙ্গে প্রসারমান বাণিজ্য চালিয়েছিলেন।

পেশায় বিধিনিষেধ, করের বোঝা এবং অ-খ্রিস্টানদের প্রতি বৈষম্য তাতারদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ফলে বিভিন্ন বিদ্রোহী এবং কৃষকদের লড়াই শুরু হয়েছিল। ঝামেলার সময়কালে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর উপদলের সহায়তায় কাজান খানাতে তার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছিল। ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে ক্যানগলি বেক নামে একজন তাতার অভিজাত মানুষ আর একটা বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অন্যান্য বিদ্রোহগুলোর মধ্যে ছিল: বোলোৎনিকভ আন্দোলন (১৬০৬-১৬০৭), বাতির্সা আন্দোলন (১৭৫৫-১৭৫৬) এবং পুগাচেভের লড়াই (১৭৭৩-১৭৭৫)। আইডেল-উরাল অঞ্চলের অন্যান্য জনগণ এই সংঘাতে অংশগ্রহণ করেছিল।

১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় মুসলিমদেরকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত অধিকারসমূহ দেওয়া হয়েছিল। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে তাতার অভিজাত মানুষ (মোর্জালার) রাশিয়ান অভিজাত মানুষদের (দভোরয়ানে) সমান অধিকার ভোগ করতেন।

তাতার সৈন্যরা সকল রাশিয়ান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, কখনো বা জাতীয় ইউনিটে (যেমন ঘটেছিল নেপোলিয়নিক যুদ্ধকালে)।

বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধ সম্পাদনা

 
অগস্ট, ১৯১৮ খ্রিস্টব্দের যুদ্ধক্ষেত্র।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রাশিয়ান বিপ্লব সময়কালের বিশৃঙ্খলায় তাতারস্তান কার্যকরভাবে স্বাধীন হয়েছিল, সই সঙ্গে গঠিত হয়ছিল জাতীয় সংসদ (মিলান্ট ম্যাকলিস), জাতীয় সরকার (মিলি ইদারা), জাতীয় পর্ষদ (মিলি সুরা) এবং জাতীয় সেনা পর্ষদ (জারবি সুরা)। কিছু সংখ্যক তাতার সেনা ইউনিট কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে রাশিয়ান গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। অ-কমিউনিস্ট তাতার বিপ্লবীরা স্বাধীন আইডেল-উরাল রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল, কিন্তু মস্কোর বলশেভিক সরকার তাদের পাশে স্বাধীন তাতারস্তান প্রতিরোধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রধানত কাজান প্রদেশের তাতার-অধ্যুষিত অংশে বলাক আর্তি অথবা জাবুলাচি (ইংরেজিতে ট্রান্সবোলাকিয়া প্রজাতন্ত্র নামে 'মুসলিম পর্ষদ'কে 'ওয়ার্কার্স বলশেভিক কাউন্সিল' উচ্ছেদ করেছিল। মুসলিম পর্ষদ গ্রেপ্তার হয়েছিল।

১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের অগস্টে সাদা চেক এবং কোমুচ বাহিনী কাজানে পৌঁছেছিল, কিন্তু লাল চাপে পিছু হটেছিল

সোভিয়েত-পরবর্তী ইতিহাস সম্পাদনা

 
তাতারস্তানের মানচিত্র

আবখাজিয়া এবং দক্ষিণ ওসেটিয়াকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ায়, তাতার জনগণের মিলি মেজলিস তাতারস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর এবং জাতিসংঘের স্বীকৃতি প্রার্থনা করেছিল।[১] যাইহোক, জাতিসংঘ এবং রাশিয়ান সরকার উভয়েই এই ঘোষণাকে উপেক্ষা করেছিল।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "The Declaration of Independence of Tatarstan (archived copy)"CNN iReport। ৯ জানুয়ারি ২০০৯। ৩০ মার্চ ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।