ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল ও শোভাযাত্রা

শ্রাবণ বা ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষীয় অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাই এই দিনটি জন্মাষ্টমী হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশের ঢাকা শহরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে ঐতিহ্যবাহী ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়। এটি জন্মাষ্টমীর মিছিল বা জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা নামে পরিচিত। ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী মিছিল চারশ বছরের বেশি পুরনো এবং এটি একসময়ে ঢাকার অন্যতম প্রধান উৎসব ছিল যা অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হতো।

ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল, ২০১৭

ইতিহাসসম্পাদনা

উৎপত্তিসম্পাদনা

ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল শুরু হয় ঢাকার আনুষ্ঠানিক নগরপত্তন(১৬১০ খ্রি) এরও পূর্বে। ১৫৫৫ সালে রাধাষ্টমীর সময় বংশাল এর নিকটে পিরু মুনশীর পুকুরের পাশে থাকা এক সন্ন্যাসী প্রথম বালক ভক্তদের হলুদ রঙের বসনে সাজিয়ে একটি মিছিল বের করেন। দশ বছর পর রাধাষ্টমীর পরিবর্তে কৃষ্ণের জন্মতিথি জন্মাষ্টমীর নন্দোৎসবের সময় তাদের মিছিলের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ১৫৬৫ সালে প্রথমবারের মত জন্মাষ্টমীর মিছিল বের হয়। পরবর্তীকালে নবাবপুরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কৃষ্ণদাস বসাকের উপর মিছিলের দায়িত্ব অর্পিত হয়। কালক্রমে মিছিলটি বেশ জনপ্রিয়তা পায় এবং ঢাকায় জন্মাষ্টমী উদযাপনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। মুসলমানদের নিকট মিছিলটি ‘বার গোপালের মিছিল’ নামে পরিচিত ছিল। [১]

কৃষ্ণদাস ও জন্মাষ্টমীর মিছিলসম্পাদনা

কৃষ্ণদাস ঢাকার নবাবপুরে লক্ষ্মীনারায়ণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নবাবপুরের লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির থেকে জন্মাষ্টমীর মিছিল বের করা শুরু করেন। মিছিলে একটি কাঠের মঞ্চে কৃষ্ণ বলরাম নন্দ যশোদা প্রভৃতির বিগ্রহ থাকতো। মিছিলে বিভিন্ন মানুষ গোপ ও ব্রজবাসী সেজে ঘোড়ায় বা মাটিতে থেকে নাচগানে মুখর থাকতেন। বৈষ্ণব বসুকবৃদ্ধগণ পীতবসন পরে মাল্যপরিহিত হয়ে খোল করতালের বাদ্যে হরিনাম কীর্তন করতেন। কৃষ্ণদাসের মৃত্যুর পর চারপায়া বিশিষ্ট কাঠের চৌকিতে বিভিন্ন অবতারের মূর্তি প্রদর্শিত হয়। ধীরে ধীরে মিছিলে পতাকা, নিশান, বন্দুক-বর্শা, বল্লম-ছড়িধারী পদাতিক প্রভৃতি যুক্ত হয়। ক্রমেই বিভিন্ন সাজসজ্জায় মিছিলের গঠন ও কলেবর বৃদ্ধি পায়।[২]

কৃষ্ণদাস পরবর্তী যুগের মিছিলসম্পাদনা

 
ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিলে হাতি

কৃষ্ণদাসের প্রবর্তিত মিছিলের উৎকর্ষে অন্যান্য ধনী ব্যবসায়ীরাও নিজেদের স্থাপিত মন্দির থেকে জন্মাষ্টমীর মিছিল বের করা শুরু করেন। উর্দুবাজারের গঙ্গারাম ঠাকুর নামে একজন বৈষ্ণব উর্দুবাজার থেকে মিছিল শুরু করে নবাবপুর পর্যন্ত নিয়ে আসতেন। তবে এই মিছিলটি কিছুদিন পরে বন্ধ হয়ে যায়। পন্নিটোলার গদাধর ও বলাইচাঁদ বসুর উদ্যোগে ইসলামপুরের মিছিল প্রবর্তিত হয়। ইসলামপুরের মিছিল ও নবাবপুরের মিছিলের মধ্যে একরকম প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হয় যার ফলে উভয়পক্ষই মিছিলকে সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় করে তুলতে অধিকমাত্রায় উদ্যোগী হয়। এসময় বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যায়িকার প্রতিফলন, বড়চৌকি, সোনারূপার চতুর্দোলা, হাতি, ঘোড়া, জরির সাজসজ্জা, গভর্মেন্টের পিলখানার হাতি প্রভৃতি জন্মাষ্টমীর মিছিলে সংযুক্ত হয়ে এটিকে আরও জমকালো করে তোলে।[২]

জনপ্রিয়তা ও তাৎপর্যসম্পাদনা

ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল পুরো বাংলায় বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এই মিছিল দেখতে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে শুরু করে কলকাতা শহর থেকেও মানুষ ঢাকায় আসত। দর্শনার্থীরা যেসব নৌকায় ঢাকা আসতেন সেগুলো সারাদিন বুড়িগঙ্গায় সারিবদ্ধভাবে নোঙ্গর করা থাকত। কখনও বৃষ্টির কারণে যথাসময়ে মিছিল শুরু করা যেত না, তবুও তাতে দর্শকের উৎসাহের কমতি ছিল না। [৩] এ মিছিলে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলিমরাও যোগ দিতেন। পরিতোষ সেন লিখেছেন “সক্রিয় অংশীদাররা হিন্দু হলেও আক্ষরিকভাবে এ মিছিল সর্বজনীন।” তার সামসময়িক কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন “জন্মাষ্টমীর মিছিল যেমন হিন্দু-মুসলমান নারী-পুরুষ সকলেরই কাছেই প্রিয় ছিল, মহরমের মিছিল তেমনটি ছিল না।” [৪]

ঐতিহ্যবাহী মিছিলের বিলুপ্তিসম্পাদনা

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাজনের পরে দুবছর বহু প্রতিবন্ধবতার মধ্যে দিয়ে মিছিল করা হয়। তবে ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মিছিলটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।[৫] ঢাকার বহু ধনাঢ্য ও মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবার- যারা মিছিলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তারা ঢাকা ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় মিছিল অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে পড়ে। এছাড়া ধর্মান্ধ মুসলিমদের আক্রমণও মিছিল বন্ধের একটি কারণ। [৪]

আধুনিক পর্যায়সম্পাদনা

 
ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল

মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ১৯৮৯ সালে ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে জন্মাষ্টমীর মিছিল আয়োজিত হয়। মিছিলে কিছু আধুনিকায়ন থাকলেও এর মূল স্বরূপটি ধরে রাখার প্রয়াস করা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে ঢাকার মেয়র জন্মাষ্টমীর মিছিলের উদ্বোধন করতেন। সেই ধারা বজায় রেখে ১৯৮৯ সাল হতে ঢাকার নির্বাচিত মেয়র মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বালনের মাধ্যমে মিছিলের উদ্বোধন করে আসছেন। বর্তমানে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুরু হওয়া জন্মাষ্টমীর মিছিল বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একটি বিশেষ মাত্রা পেয়েছে।[৫]

তথ্যসূত্রসম্পাদনা

  1. জন্মাষ্টমীর মিছিলের ঢাকা ইতিহাস, ভুবনমোহন বসাক
  2. ঢাকার ইতিহাস, যতীন্দ্রমোহন রায়
  3. জনৈকা গৃহবধূর ডায়েরী, মনোদা দেবী, বর্ষা ১৩৮৯, পৃষ্ঠা ১১৫
  4. ঢাকা সমগ্র, মুনতাসীর মামুন
  5. "ঢাকার ঐতিহ্য জন্মাষ্টমী মিছিল"। ১৮ আগস্ট ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০১৭