জ্যোতির্ময়ী দেবী

ভারতীয় লেখিকা

জ্যোতির্ময়ী দেবী (২৩ জানুয়ারি, ১৮৯৪ – ১৭ নভেম্বর, ১৯৮৮) বিশ শতকের গোড়ার দিকের বাঙালি  লেখিকা। রাজস্থানের নারীদের নিয়েই লিখেছেন, যেহেতু তিনি  বাল্যকাল অতিবাহিত করেন সেখানে আর দেশভাগের আগের বাংলায় বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গে। বাস্তবের প্রেক্ষাপটে তার সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে সুন্দর ভাবে স্থান পেয়েছে তার ছোটগল্পগুলিতে।

জ্যোতির্ময়ী দেবী
জন্ম২৩ জানুয়ারি ১৮৯৪
মৃত্যু১৭ নভেম্বর ১৯৮৮
জাতীয়তাভারতীয়
পেশালেখিকা
দাম্পত্য সঙ্গীকিরণচন্দ্র সেন
পিতা-মাতাঅবিনাশচন্দ্র সেন(পিতা)
সরলা দেবী (মাতা)
পুরস্কারভুবনমোহিনী দাসী পদক (১৯৬৫)
রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৭৩)

জীবনী সম্পাদনা

জোতির্ময়ী দেবী ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে  দেশীয় রাজ্য  অধুনা রাজস্থানের  জয়পুরে। তার পরিবার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ হতেই রাজস্থানে ছিলেন। জয়পুর রাজ্যের দেওয়ান  অবিনাশচন্দ্র সেন ছিলেন  তার পিতা আর পিতামহ সংসারচন্দ্র সেনের জ্যেষ্ঠপুত্র।  পিতামহ সংসারচন্দ্র স্কুলশিক্ষক হয়ে জয়পুর আসেন এবং পরে জয়পুর রাজের দেওয়ান হয়ে যান। জ্যোতির্ময়ী জয়পুরের  পরিবেশে নিজ পর্যবেক্ষণ শক্তিতে অল্প প্রথাগত  শিক্ষা লাভ করেন। সে সময়ের রাজ পরিবারের মহিলা মহলে নারীদের অবস্থান আর সামাজিক পরিস্থিতি, রক্ষণশীলতা তার মনে  প্রভাব বিস্তার করেছিল। তবে তাদের প্রবাসী পরিবারে সেকালের নিয়মমতো রক্ষণশীলতা আর পর্দাপ্রথা থাকলেও বাড়িতে পড়াশোনার আবহাওয়া ছিল। পিতামহের গড়ে তোলা বিশাল গ্রন্থাগার ছিল তার  অত্যন্ত প্রিয়। যা চাইতেন তাই পড়তে পারতেন। আর ফলে তিনি অনেক সারগ্রাহী জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন। ১০ বৎসর বয়সে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার সাহিত্যপ্রেমী ও অভিজাত পরিবারের  আইনজীবী  কিরণচন্দ্র সেনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তার স্বামী ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যান। ২৫ বৎসর বয়সে অকাল বৈধব্যে  ছয় সন্তানের ( অমিয়, অনুভা, অরুণচন্দ্র, অশোকা, অমিতাভ ও অঞ্জলি) জননী এক সন্তানকে স্বামীর পরিবারে রেখে পিত্রালয়ে ফিরে আসেন। গোঁড়া হিন্দু বিধবার কঠোর নিয়মে জীবন যাপন করতে থাকেন এবং এতে  সান্ত্বনা পেতে  নতুন উদ্যমে পড়াশোনা শুরু করেন। পিতামহের সংগ্রহ হতে জন স্টুয়ার্ট মিলের লেখা " অন দি সাবজেক্টাসান অব উইমেন" বইটি মহিলাদের অধিকার সম্পর্কে লিখতে অনুপ্রাণিত করে। বাস্তবে নিজের আচরণে রক্ষণশীল হয়ে,  তিনি সর্বদা তার পুত্র ও কন্যাদের সাথে সমান আচরণ করতেন। প্রতিবাদী, স্পষ্ট ভাষায় বহু ছোটগল্প রচনা করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। রাজস্থান, দিল্লি এবং বাংলায় অবস্থান কালে তিনি নারীর চিরন্তন সমস্যা নিয়ে নানাদিক থেকে বিশদে ভেবেছেন, সহানুভূতিশীল হয়ে  তিনি তার ছোটগল্প ও উপন্যাসে  রূপ দিয়েছেন ঐকান্তিক নিষ্ঠায়। বিশেষত মহিলা ও দলিতদের অধিকার নিয়ে অ-কল্পকাহিনী রচনা করেছেন। লেখার জগতে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিলেন তার বন্ধু কবি কান্তিচন্দ্র ঘোষ। তার একটি কবিতা ও 'নারীর কথা' নামে একটি প্রবন্ধ কান্তিচন্দ্র 'ভারতবর্ষ' পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।(জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ়, ১৯২১) ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ হতে তার লেখা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলা সাহিত্যে তার প্রথম প্রবেশ কবিরূপেই। প্রথম জীবনে প্রচুর কবিতা লেখেন,  পরবর্তীকালে গল্প। প্রথম দিকে "সুমিত্রা দেবী " ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। [১]

রচনাশৈলী সম্পাদনা

তার কবিতা ও ছোটগল্প  সকলের বোধগম্যের জন্য সহজ ও সরল ভাষায় রচিত হয়েছে। কিন্তু প্রকাশের ভঙ্গি ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। তার রচনার কোথাও  জটিল শব্দের প্রয়োগ নেই। এটিই ছিল তার  রচনার  প্রধান  বৈশিষ্ট্য। স্বামী  বিবেকানন্দর বাণী সমূহ তার লেখায় যথাযথ স্থান পেয়েছে। বাস্তবের প্রেক্ষাপটে,  অভিজ্ঞতা ও শিক্ষায় তার  লেখা চিত্রিত হয়েছে। তার প্রথাগত শিক্ষার অপ্রতুলতা কিন্তু অন্তরায় হয় নি বরং অন্যদের কাছে এটি এক দৃষ্টান্তস্বরূপ। সাহিত্য সমালোচক শিশির কুমার দাশ উল্লেখ করেছেন-   বহির্বাংলা, বিশেষত রাজস্থানের মানুষ ও সমাজের  ছবি ছিল তার গল্পের প্রধান উপকরণ। বাংলা সাহিত্যের ভৌগোলিক সীমাকে তিনি যথার্থই প্রসারিত করেছেন - "সেই কারণে", তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, তার সাহিত্যকর্মকে

"অনন্য সাহিত্যকীর্তি বলে অভিহিত করতে পারি"

[২]

রচনাবলী সম্পাদনা

তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -

  • 'চক্রবাল' (কবিতাগুচ্ছ)
  • 'বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ' (উপন্যাস) (১৯৪৮)
  • 'মনের অগোচরে' (উপন্যাস)(১৯৫২)
  • 'আরাবল্লীর কাহিনী'  (ছোটোগল্প)(১৯৬৫)
  • 'এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা' (উপন্যাস) (১৯৬৮)
  • 'সোনারূপা নয়' (ছোটোগল্প) (১৯৬৯)
  • 'ছায়াপথ'
  • 'রাজযোটক'
  • 'আরাবল্লীর আড়ালে'
  • 'ব্যান্ড মাস্টারের মা'
  • 'সময় ও সুকৃতি'
  • 'রাজারানীর যুগ'
  • 'নারীর অধিকার'
  • 'চিরন্তন নারী জিজ্ঞাসা'
  • 'স্মৃতি-বিস্মৃতির তরঙ্গ'

ভারতের মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা দিল্লির ইন্ডিয়ান সার্টিফিকেট অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন তাদের মাধ্যমিক স্তরের বাংলা পাঠ্যপুস্তকে তার রচিত গল্প "ডাইনি" অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ ছাড়াও তার রচিত বহু গল্প ইংরাজী সহ অন্য ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

সম্মাননা ও পুরস্কার সম্পাদনা

তার সাহিত্য রচনার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী দাসী স্বর্ণপদক লাভ করেন।

১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি গল্প সংগ্রহ "সোনা রূপা নয়" গ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাঁকে 'হরনাথ ঘোষ স্মৃতি পদক' প্রদান করে। [১]

তথ্যচিত্র সম্পাদনা

প্রখ্যাত পরিচালক রাজা সেন তার শতবর্ষের শ্রদ্ধা নিবেদন হিসাবে জ্যোতির্ময়ী দেবীকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন।

গ্রন্থাগার সম্পাদনা

জ্যোতির্ময়ী দেবী মিথ্যা অস্থিতিশীলতা (কলকাতা: Strée, 1999) ভূমিকা দ্বারা মহাশ্বেতা দেবী

জীবনাবসান সম্পাদনা

১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ হতে তিনি আমৃত্যু কলকাতার শ্যামবাজারের বসবাস করতেন। তার এক কন্যা সমাজসেবী  অশোকা গুপ্ত ছিলেন দাঙ্গা-পীড়িত নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর পদযাত্রায় অন্যতম সঙ্গী। জ্যোতির্ময়ী দেবী ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর কলকাতায় প্রয়াত হন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয়  খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি  ২০১৯, পৃষ্ঠা ১৪৭, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  2. শিশিরকুমার দাশ সংকলিত ও সম্পাদিত, সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট  ২০১৯, পৃষ্ঠা ৮৮ আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-০০৭-৯ {{আইএসবিএন}} এ প্যারামিটার ত্রুটি: চেকসাম