চৌবুর্জি
চৌবুর্জি (পাঞ্জাবি এবং উর্দু: چو برجی, "চার মিনার") হলো পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে অবস্থিত একটি মোঘল আমলের স্থাপনা। স্থাপনাটি ১৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। সম্রাট শাহজাহানের আমলে ভবনটি একটি বৃহৎ বাগানের তোরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
چو برجی | |
![]() চৌবুর্জি একসময় একটি মোঘল উদ্যানের তোরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো | |
স্থানাঙ্ক | ৩১°৩৩′১৪″ উত্তর ৭৪°১৮′১৭″ পূর্ব / ৩১.৫৫৪০° উত্তর ৭৪.৩০৪৮° পূর্ব |
---|---|
অবস্থান | লাহোর, পাঞ্জাব, পাকিস্তান |
সম্পূর্ণতা তারিখ | ১৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দ |
পটভূমিসম্পাদনা
চৌবুর্জি লাহোরের মুলতান সড়কের পাশে বাহাওয়ালপুর সড়কের মোড়ে অবস্থিত। এই সড়ক দক্ষিণে মুলতান পর্যন্ত যায়। মোঘল আমলে এটি একটি বাগানের প্রবেশ তোরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। স্থাপনার নাম "চৌবুর্জি" (অর্থ চারটি বুর্জ বা মিনার বা টাওয়ার বিশিষ্ট) খুব সম্ভবত পরবর্তী প্রজন্মের দেওয়া নাম। কেননা মূল স্থাপনাটি মোঘল আমলে বৃহৎ বাগানের অংশ হিসেবে দেখা হতো। ধারণা করা হয়, ভবনসংলগ্ন বাগানটি এলাকায় বন্যার কারণে টিকে থাকতে পারে নি।[১]
ইতিহাসসম্পাদনা
লাহোরের এই বাগানটি নির্মাণের কৃতিত্ব মোঘল রাজকন্যা জেবুন্নেসাকে প্রদান করা হয়, যিনি মোঘল কিতাবে "সাহেবে জেবিন্দা বেগমে দৌরান" হিসেবে উল্লিখিত বলে ধারণা করা হয়। চৌবুর্জির নির্মাণের সময় জেবুন্নেসার বয়স আট বছর ছিল। তাই কিতাবে তার ফুফু জাহানারা বেগমকে নির্দেশ করা হয়েছে বলেও মনে করা হয়। জাহানারা বেগম সম্রাট শাহজাহানের কন্যা ছিলেন।[১]
লুপ্ত মোঘল বাগানসম্পাদনা
চৌবুর্জি যেই বাগানের তোরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তার অস্তিত্ব আর পাওয়া যায় না। স্থাপনাটি বর্তমানে লাহোরের ব্যস্ত দুই রাস্তা মুলতান সড়ক ও বাহাওয়ালপুর সড়কের একটি ঘাসপূর্ণ সড়কদ্বীপে অবস্থিত। মোঘল আমলের বাগানটি দক্ষিণে নওয়ানকোট এবং লাহোর শহর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে ধারণা করা হয়।[১]
সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে রাবী নদীর বন্যায় বাগানের অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায় বলে মনে করা হয়। চৌবুর্জি তোরণের পাশে মূল্যবান বাগানের কোনো অস্তিত্বই আর পাওয়া যায় না।[১][২]
স্থাপত্যসম্পাদনা
চৌবুর্জিতে মোঘল স্থাপত্য, মধ্য এশিয়ার প্রাচীন তৈমুরি স্থাপত্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য-আরবি স্থাপত্যের মিশেল ঘটানো হয়েছে। চৌবুর্জির স্থাপত্যের বিশেষত্ব হলো এর মিনারেট, যেটি উপরের দিকে অনেক চওড়া; উপমহাদেশের অন্য কোথাও এরকম বিশেষত্ব দেখা যায় না। কারও কারও মতে মিনারেটের ওপরের ছোট গম্বুজ সময়ের সাথে ধ্বসে গিয়ে এই চওড়া মাথা তৈরি হয়েছে।
ভবনের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রবেশদ্বারে দ্বিতল ইওয়ান দেখা যায়, যা তৈমুরীয় স্থাপত্যের নিদর্শন। এর দুই পাশে তাকসদৃশ কাঠামো বিদ্যমান, যা শাহজাহান আমলের মোঘল স্থাপত্যে সাধারণত দেখা যায়। ভবনটির দেয়াল এক সময় নীল ও সবুজ কাশি কারি (বা কাশান রীতির) টালি ও ফ্রেস্কো দিয়ে সজ্জিত ছিল।[২] ইওয়ান অংশে মুকারনাসের সজ্জা দেখা যায়, যা পারস্য থেকে লাহোরের ওয়াজির খান মসজিদের মাধ্যমে মোঘল সাম্রাজ্যের স্থাপত্যরীতিতে প্রবেশ করে।
ভবনের লাল ইটের কাজ উপমহাদেশের মুসলমান স্থাপত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ভেতরের করিডোর বরাবর দরজা ও জানালা মোঘল স্থাপত্য শৈলীর জীবন্ত নিদর্শন। চৌবুর্জির অধিকাংশ দেয়াললিপি হারিয়ে গেলেও ভবনের উপরের অংশের দেয়ালে পোর্সেলিনের উপর আরবি ভাষায় নীল কালিতে আয়াতুল কুরসি লেখা পাওয়া যায়।
ভারতের হায়দ্রাবাদের চারমিনার চৌবুর্জির স্থাপত্যে প্রভাব ফেলেছিল বলে অনেকে ধারণা করেন।[৩]
সংস্কারসম্পাদনা
১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মহা ভূমিকম্পের জন্য উত্তর পশ্চিমের মিনারেট ধ্বসে পড়ে এবং ভবনের মধ্য খিলানে ফাটল ধরে। এরপর এটি যতটুকু সম্ভব সংস্কার করা হয়েছে, এবং বর্তমানে এটিকে মোঘল আমলে ভবনটির অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৬০ এর দশকের শেষভাগে পাকিস্তান সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই সংস্কারকাজ পরিচালনা করে।[১]
সংরক্ষণসম্পাদনা
চৌবুর্জিকে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সংরক্ষিত ঐতিহ্য স্থাপনার তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।[৪]
মেট্রো নির্মাণের প্রভাবসম্পাদনা
চৌবুর্জি লাহোর মেট্রোর অরেঞ্জ লাইন বরাবর অবস্থিত। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের পাঞ্জাব বিশেষ উদ্যান অধ্যাদেশ ও ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রত্নতত্ত্ব আইনের লঙ্ঘন করে চৌবুর্জি, শালিমার উদ্যান ও অন্যান্য নয়টি প্রত্নস্থাপনার পাশ দিয়ে অতিক্রম করায় ঐতিহ্য রক্ষণবাদীরা মেট্রো নির্মাণের বিপক্ষে লাহোর উচ্চ আদালতে পিটিশন করে।[৫] ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে ইউনেস্কো ঘোষিত সংরক্ষিত স্থানের "অপরিবর্তনশীল ক্ষতি" ঠেকানোর জন্য উচ্চ আদালত স্থাপনার ২০০ ফুটের ভেতরে মেট্রোর নির্মাণ কাজে স্থগিতাদেশ দেয়। ফলে মেট্রো বর্তমান স্থানে নির্মাণ করা হয়।[৬] ভূগর্ভস্থ চৌবুর্জি স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও, সেটি পরিবর্তন করে বর্তমানে ইউনেস্কোর নীতিমালা অনুযায়ী ভাসমান স্টেশন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
আরও দেখুনসম্পাদনা
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "Chauburji Gate, Lahore, Pakistan"। Asian Historical Architecture website। সংগ্রহের তারিখ ১২ নভেম্বর ২০২০।
- ↑ ক খ "Chauburji"। Lahore Sites। ২৫ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ আগস্ট ২০১৬।
- ↑ Daniyal Saleem Gilani (১৪ নভেম্বর ২০০১)। "DAWN - Features; November 14, 2001 (scroll down to read 'Our own Char Minar' (Chauburji monument)"। Dawn (newspaper)। সংগ্রহের তারিখ ১১ নভেম্বর ২০২০।
- ↑ Pakistan Environmental Protection Agency (২৩ মে ২০০৫)। "Guidelines For Sensitive And Critical Areas, Government of Pakistan (October 1997)" (পিডিএফ)। Government of Pakistan website। পৃষ্ঠা 12, 47, 48। ১৪ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ নভেম্বর ২০২০।
- ↑ "LHC suspended construction of Orange Line Metro Train"। Pakistan Tribune। ১৯ আগস্ট ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২৩ আগস্ট ২০১৬।
- ↑ "Lahore court backs heritage challenge over metro plans"। The Guardian। সংগ্রহের তারিখ ২৩ আগস্ট ২০১৬।