গিরীন চক্রবর্তী
গিরীন চক্রবর্তী (৫ মে ১৯১৮ – ২২ ডিসেম্বর ১৯৬৫) ছিলেন কিংবদন্তি বাঙালি পল্লীগীতি তথা লোকসঙ্গীত ও নজরুলগীতি গায়ক, সুরকার ও সঙ্গীতগবেষক। অজস্র কালজয়ী বাংলাগান বিশেষকরে লোকসঙ্গীতের অমর স্রষ্টা ছিলেন তিনি।[১]
গিরীন চক্রবর্তী | |
---|---|
জন্ম | ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি (বর্তমানে বাংলাদেশ) | ৫ মে ১৯১৮
মৃত্যু | ২২ ডিসেম্বর ১৯৬৫ কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ | (বয়স ৪৭)
ধরন | লোকসঙ্গীত |
পেশা | কণ্ঠশিল্পী, সংগীতজ্ঞ |
কার্যকাল | ১৯২৫ –১৯৬৫ |
লেবেল | এইচএমভি কলম্বিয়া |
জন্ম ও সঙ্গীতশিক্ষা জীবন
সম্পাদনাগিরীন চক্রবর্তীর জন্ম ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে (১৩২৫ বঙ্গাব্দের ২২ বৈশাখ) ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লা জেলার অধুনা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের কালিকচ্ছ গ্রামে। [২]পিতা গৌরাঙ্গসুন্দর চক্রবর্তী ও মাতা ব্রজসুন্দরী দেবী। শৈশব থেকেই গিরীনের সংগীতের প্রতি আকর্ষণ ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই সন্তান সুর-সম্রাট বাবা আলাউদ্দিন খানের সান্নিধ্যে এসে তাঁর কাছেই শুরু হয় গিরীনের সঙ্গীতশিক্ষা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি লোকসঙ্গীতের প্রতিও ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। পরবর্তীতে তালিম নেন লোকসঙ্গীত শিল্পী ফকির আফতাবউদ্দিন খানের কাছে।[৩]
সঙ্গীত জীবন
সম্পাদনাপ্রথমদিকে কিছুদিন গিরীন চক্রবর্তী ঢাকা বেতারকেন্দ্রে কাজ করেন। তারপর চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতা বেতারকেন্দ্রে যোগ দিয়ে তিনিই প্রথম চালু করেন পল্লীগীতি'র আসর। পরে অবশ্য নামকরণ হয় লোকগীতি। আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে তিনি নজরুল গীতি, আধুনিক, পল্লীগীতি, শ্যামাসঙ্গীত, ভজন, গীত ও গজল নিয়মিতই পরিবেশন করতেন। [১] তিনি নিজেও অজস্র বাংলাগান রচনা ও সুরারোপ করেছেন। এরমধ্যে রয়েছে দেশাত্মবোধক, শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামি, আধুনিক, লোকগীতিসহ চলচ্চিত্রের গান। বাংলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে লোকগীতির ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন।[১] গান রচনা, সুরারোপে এমনকি কণ্ঠদান করেছেন কখনও স্বনামে, কখনও বা 'সুজন মাঝি', 'রতন মাঝি' বা 'দ্বিজ মহেন্দ্র' ছদ্মনামে। ইসলামি গানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন 'সোনা মিঞা'। অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তার রচিত গানগুলি। [৩] লোকসঙ্গীতের মধ্যে তিনি ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত, ইসলামি ও আধুনিক সুর অসামান্য দক্ষতায় স্বাচ্ছন্দ্যে মিশিয়ে জনমানসে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। ১৯৩০ এর দশকের কলকাতায় গিরীন চক্রবর্তী, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, শচীন দেববর্মণ প্রমুখেরা জনপ্রিয় বাংলাগানের জগত ভাটিয়ালী-ভাওয়াইয়া সংগীতের সুরে সমৃদ্ধ করেন।[৪] কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। নজরুল ইসলামের কারার ওই লৌহকপাট গানটি তিনি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম রেকর্ড করেন। এই শিকল পরা ছল- সহ নজরুল ইসলামের প্রায় ২৪টি গানের সুরারোপ করেন তিনি।[৫] কবির বিদ্রোহী কবিতা- বল বীর বল উন্নত মম শির তার দেওয়া গীতিরূপে সার্থক গণসঙ্গীত হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।[৬]
এইচএমভি কোম্পানিতে সঙ্গীতের প্রশিক্ষক হিসাবে তিনি কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে কবিশেখর কালিদাস রায়ের বিখ্যাত ‘নন্দপুর চন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার’ কবিতাটিতে সুরারোপ করে তিনিই রেকর্ড করেন। এই সময়েই তিনি খ্যাতির উচ্চ শিখরে পৌঁছান। বাংলা বহু সঙ্গীতশিল্পী তাঁর কাছে তালিম নিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তারা হলেন- আব্বাসউদ্দীন আহমদ, চিত্ত রায়, ভবানীচরণ দাস, চিন্ময় লাহিড়ী, আঙুরবালা দেবী, ইন্দুমতী দেবী, কমলা ঝরিয়া, শৈল দেবী, হরিমতি দেবী, রাধারাণী দেবী, যূথিকা রায়, বাঁশরী লাহিড়ী, শচীন দেববর্মণ, তালাত মাহমুদ, অসিতবরণ, সত্য চৌধুরী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখেরা।[৩] সঙ্গীত শিল্পী তালাত মাহমুদের কণ্ঠে গিরীন চক্রবর্তীর রচিত ও কমল দাশগুপ্ত সুরারোপিত গান - দুটি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে ধীরে ১৯৪০ এর দশকে বাংলা গানের জগতে সুপার হিট হয় এবং গজল গায়ক তালাত মাহমুদ বিশেষ পরিচিতি পান। গিরীন চক্রবর্তীকেই তার আবিষ্কারক হিসাবে গণ্য করা হয়।[১][৩]
বিখ্যাত কিছু গান
সম্পাদনা- নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে
- কিশোরগঞ্জে মাসির বাড়ি
- শিয়ালদহ গোয়ালন্দ আজও আছে ভাই
- বাড়ি ছিল পদ্মা নদীর পাড়ে
- আয় রে বাঙালি আয় সেজে
- কালী তারা ষোড়শী
- হিসাব যদি চাইবি মা তোর
- তুমি কোন বা দ্যাশে
- আল্লা ম্যাঘ দে, পানি দে (জালালউদ্দিন নামে এক গ্রামীণ লোকশিল্পী রচিত লোকগানের প্রথম চার পঙ্ক্তি সংগ্রহের পর বাকি অংশটা রচনা করেন)
গিরীন চক্রবর্তী কলকাতার 'বেঙ্গল মিউজিক কলেজ’, 'বাসন্তী বিদ্যাবীথি’ ও ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়’-এও অধ্যাপনা করেন। তিনি সেখানকার সিলেবাস কমিটির সদস্য ও পরীক্ষার প্রশ্নকর্তা ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ হতেই মাত্র ছত্রিশ বছর বয়স থেকেই তিনি দিল্লিতে ‘জাতীয় সঙ্গীত সম্মেলন'-এ নিয়মিত আমন্ত্রিত হতেন। এছাড়া তিনি সংগীত নাটক অকাদেমির প্রতিষ্ঠাকাল হতে তিনি সদস্য ছিলেন।
জীবনাবসান
সম্পাদনাবাংলা লোকগানের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গিরীন চক্রবর্তীর অকাল মৃত্যু ঘটে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর কলকাতায়। তাঁর কন্যা হলেন সঙ্গীতশিল্পী ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ আকাশবাণী কলকাতা, গীতাঞ্জলি প্রচার তরঙ্গ, প্রাত্যহিকী অনুষ্ঠান-তারিখ ০৫ মে,২০২৩
- ↑ "গিরীন চক্রবর্তীর সুরের আশ্রয়ে সঙ্গীতাসর"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-০৫।
- ↑ ক খ গ ঘ "'বিস্মৃতির অন্তরালে গিরীন চক্রবর্তী' - শ্রীরূপ গোপাল গোস্বামী"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-০৫।
- ↑ "Girin Chakraborty"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-০৫।
- ↑ "Row over AR Rahman version of Nazrul song gets murkier as family feud surfaces in the wake of legal threats for 'Pippa' producers"। www.telegraphindia.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১১-১৭।
- ↑ "'কারার এই লৌহকপাট' প্রথম রেকর্ড করেছিলেন গিরীন চক্রবর্তী, এ আর রহমানের কালোয়াতিতে বিরক্ত কন্যা ছন্দা"। TheWall। ২০২৩-১১-১১। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১১-১৭।