কারমাইকেল কলেজ, রংপুর
কারমাইকেল কলেজ বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।[১] ১৯১৬ সালে কলেজটি রংপুরের ম্যাজিস্ট্রেট কালেক্টর জে.এন. গুপ্ত প্রতিষ্ঠা করেন[২] এবং লর্ড ব্যারন কারমাইকেলের নামানুসারে নামকরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি সৃষ্টির লগ্ন থেকেই বৃহত্তর রংপুরের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক অবদান রেখে আসছে । এই কলেজ বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর অধিভুক্ত।[৩] ২০০১ ও ২০০৬ সালে দুটি পৃথক আইন পাশের মাধ্যমে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নিত করা হয়। তবে আইন দুটি অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি।
ধরন | সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ |
---|---|
স্থাপিত | ১০ নভেম্বর, ১৯১৬ |
অধিভুক্তি | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ( ?- ১৯৪৭) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৪৭- ১৯৫৩) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩- ১৯৯২) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯২- বর্তমান) |
অধ্যক্ষ | প্রফেসর চিন্ময় বাড়ৈ |
শিক্ষার্থী | ২৪,০০০ |
স্নাতক | ৩,৩৬০ |
স্নাতকোত্তর | ৬,০০০ |
ঠিকানা | , , |
শিক্ষাঙ্গন | শহর |
ভাষা | বাংলা |
পোশাকের রঙ | |
ক্রীড়া | ক্রিকেট, ফুটবল |
ওয়েবসাইট | www |
ইতিহাস
সম্পাদনা১৯১৩ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড থমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল রংপুর এলে তাঁকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেয়া হয়। ঐ সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানেই অত্র অঞ্চলে একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে সহযোগিতার জন্য অনুরোধ করা হয়ে, তিনি জানান এটির জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে তিন লক্ষ টাকার প্রয়োজন হবে। কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তহবিল সংগ্রহের জন্য তিনি রংপুর অঞ্চলের রাজা, জমিদার, বিত্তবান ব্যাক্তি ও শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে সভা ডাকা হয়। কথিত আছে, অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাকা সভায় তৎকালীন দানশীল জমিদার ও বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ কে কত টাকা দিবেন তা মুখে বলে অঙ্গীকার করেন এবং কাগজে লিপিবদ্ধ করেন। এক্ষেত্রে টেপার জমিদার তার মুখে উচ্চারিত ১০,০০০ টাকা লিখতে গিয়ে টাকার অংকের জায়গায় ভুল করে ডান পাশে একটি শূন্য বেশী বসিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তার টাকার পরিমাণ দাড়ায় এক লক্ষ টাকা। সভা শেষে সকলের লিখিত টাকার অংক যখন পড়ে শোনানো হচ্ছিল তখন অন্নদা মোহন রায় চৌধুরী (টেপার জমিদার) তার অঙ্গীকারকৃত টাকার অংক শুনে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কারও কারও মতে তিনি মূর্ছা গিয়েছিলেন। তবে তিনি কলেজ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারকৃত টাকার অংকই দান করেছিলেন । এই দানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই কারমাইকেল কলেজে প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন দর্শনীয় মূল ভবনের ঠিক মাঝের হল ঘরটির তার নামানুসারে “অন্নদা মোহন হল” নামকরণ করা হয় । প্রতিষ্ঠার জন্য যারা অর্থ এবং জমি দান করেছিলেন তাদের ২৮ জন দাতার নাম পাথরে খোদাই করে লেখা আছে। কেউ কেউ নগদ অর্থ দান করেন। কেউ বা দান করেন জমি অবকাঠামো নির্মাণের জন্য। সবচেয়ে বেশি জমি দান করেন, কুন্তির প্রসিদ্ধ জমিদার ও রংপুরের তৎকালীন সবচাইতে শিক্ষানুরাগী ব্যাক্তি সুরেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী, তারা দুই ভাই প্রায় সাড়ে চারশো বিঘা নিষ্কণ্টক জমি দান করেন।[৪]
১৯১৩ সালে রংপুরে গণ সম্বর্ধনায় গভর্নর লর্ড কারমাইকেল তিন লক্ষ টাকা সংগ্রহের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ১৯১৬ সালের মধ্যেই সংগৃহীত হলো চার লক্ষাধিক টাকা। এর পর ১৯১৬ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড থমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল রংপুরে এসে কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তাঁর নামানুসারেই কলেজটির নামকরণ করা হয় “কারমাইকেল কলেজ”। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে মূল ভবন নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত কলেজের কার্যক্রম পরিচালিত হয় জেলা পরিষদ ভবনে ।[৪] জার্মান নাগরিক ড. ওয়াটকিন ছিলেন কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ।
১৯১৭ সালে কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক চালু করা হয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান ১৯২২ সালে ও বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ১৯২৫ সাল থেকে শুরু হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৫৩ সালে নতুনভাবে স্থাপিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন করা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর এটি তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[৪]
১৯৬৩ সালের ১লা জানুয়ারী কলেজটি সরকারীকরণ করা হয় । এটিকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করতে ১৯৯৫ সাল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পাঠদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু রংপুরবাসীর দাবীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে গত বছর থেকে আবারও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পাঠদান চালু করা হয়েছে।[৪]
ক্যাম্পাস
সম্পাদনা৩০০ একর ভূমির উপর অবস্থিত কারমাইকেল কলেজের সুবিশাল ক্যাম্পাস। ছায়া সুনিবিড় এই বিশাল প্রাঙ্গনে একটি ক্যান্টিন, একটি সুদৃশ্য মসজিদ, একটি মন্দির, ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হল, বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন এবং বিশাল দুটি খেলার মাঠ। ক্যাম্পাসের দক্ষিণে রংপুর ক্যাডেট কলেজ, উত্তরে রংপুর রেল স্টেশন ও ঐতিহ্যবাহী লালবাগ হাট-বাজার এবং চারপাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছাত্রাবাস।
বর্তমানে কলেজে শিক্ষার্থীর প্রায় ২৪ হাজার। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য সাতটি আবাসিক হলে আসনের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র এক হাজার। ছাত্রীদের জন্য তিনটি ও ছাত্রদের জন্য রয়েছে চারটি আবাসিক হল।[৪]
ছাত্রীদের তিনটি আবাসিক হলঃ
- তাপসী রাবেয়া হল
- বেগম রোকেয়া হল
- জাহানারা ইমাম হল
ছাত্রদের তিনটি হলঃ
- জি এল ছাত্রাবাস
- ওসমানি ছাত্রাবাস
- সিএম ছাত্রাবাস (শুধুমাত্র হিন্দুদের জন্য)
- কে বি ছাত্রাবাস (পরিত্যক্ত)
একাডেমিক ও ভর্তি
সম্পাদনাএই কলেজে বর্তমানে এইচএসসি, অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে ২৪ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি এবং বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা অনুসারে অনার্স এবং মাস্টার্সে ১৮টি বিষয় পড়ানো হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির নিয়ম কলেজটি কঠোরভাবে অনুসরণ করে। মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী যোগ্য শিক্ষার্থী বাছাই করা হয় ।
শিক্ষার্থী
সম্পাদনা- একাদশ বিজ্ঞান: ৪২০
- একাদশ মানবিক: ৩০০
- একাদশ বাণিজ্য: ৩০০
- প্রথম বর্ষ (সম্মান): ৩৩৬০
- মাস্টার্স (প্রথম পর্ব): ৬০০০ (নিয়মিত+প্রাইভেট)
- মাস্টার্স (শেষ পর্ব): ৬০০০ (নিয়মিত+প্রাইভেট)[৫]
অনুষদ ও বিভাগ
সম্পাদনাউচ্চ মাধ্যমিক
সম্পাদনাউচ্চ মাধ্যমিকের মোট আসন ৯০০ টি।
- বিজ্ঞান (৪২০)
- মানবিক (৩০০)
- বাণিজ্য (৩০০)
অনার্স
সম্পাদনাঅনার্সের তিনটি অনুষদের মোট আসন ৩৩৬০ টি ।[৬][৭]
অনুষদ | বিষয়/বিভাগ | আসন |
---|---|---|
বিজ্ঞান | গণিত | ২১০ |
পদার্থ বিজ্ঞান | ১৩০ | |
রসায়ন | ১৩০ | |
প্রাণিবিদ্যা | ১৪০ | |
উদ্ভিদবিদ্যা | ১৩৫ | |
কলা | বাংলা | ২৩০ |
ইংরেজি | ২৩০ | |
অর্থনীতি | ২৪৫ | |
ইতিহাস | ২৪৫ | |
দর্শন | ২১০ | |
রাষ্ট্রবিজ্ঞান | ২৪৫ | |
সমাজ বিজ্ঞান | ৭০ | |
ইসলামের ইতিহাস | ২৪৫ | |
আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ | ১৩০ | |
বাণিজ্য | ব্যবস্থাপনা | ২৮০ |
হিসাব বিজ্ঞান | ২৮০ | |
মার্কেটিং | ১০০ | |
ফিন্যান্স এবং ব্যাংকিং | ১০০ |
উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন শিক্ষার্থী
সম্পাদনানিম্নে কিছু খ্যাতিমান মানুষের উল্লেখ করা হল যারা কারমাইকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র:
- জাহানারা ইমাম - সাহিত্যিক ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল আন্দোলনের নেত্রী।
- আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম - বাংলাদেশের ১ম প্রধান বিচারপতি, বাংলাদেশের ৬ষ্ঠ রাষ্ট্রপতি।
- হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ- রাজনীতিবিদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি।
- শাহ আব্দুল হামিদ - বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম স্পীকার।
- আসাদুজ্জামান নূর - অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ।
- রাউফুন বসুনীয়া - স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদ হওয়া ছাত্রনেতা।
- আনিসুল হক - সাংবাদিক, কথা-সাহিত্যিক, নাট্যকার, কলাম লেখক।
- শিস খন্দকার - শিক্ষক, লেখক ও সম্পাদক।
- আবদুল হাই শিকদার - কবি, নজরুল-গবেষক, সাংবাদিক।
- আসাদুল হাবিব দুলু - রাজনীতিক, সাবেক উপমন্ত্রী।
- রফিকুল হক - প্রখ্যাত ছড়াকার।
- আলতাফুর রহমান - সাবেক মেয়র, হিন্ডবার্ন সিটি, ল্যাংকাশায়ার, ইংল্যান্ডে।
- এম আব্দুর রহিম - বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য।
- মোনাজাতউদ্দিন - প্রথিতযশা সাংবাদিক।
- মণিকৃষ্ণ সেন - ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও তেভাগা আন্দোলনের নেতা।
- ধীরেন বল - (১৯১২-১৯৯২) প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী, গ্রন্থ চিত্রকর ও শিশুসাহিত্যিক।
- খয়রাত হোসেন - কারমাইকেল কলেজের প্রথম মুসলিম ভিপি, নির্বাচিত এমএলএ , যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী।
- রমেশ চন্দ্র সেন - ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সংসদ সদস্য।
চিত্রশালা
সম্পাদনা-
কলেজ ক্যাম্পাসের কাইজেলিয়া গাছ। গাছটি বিপন্নপ্রায় বৃক্ষ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত
-
কারমাইকেল কলেজ পুকুর
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "অফিসিয়াল ওয়েবসাইট"। ২১ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
- ↑ "Founders | Carmichael College, Rangpur" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-১৪।
- ↑ "কারমাইকেল কলেজ, রংপুর"। banglapedia.search.com.bd। ৪ মে ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-১৪।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "Brief History (Bn) | Carmichael College, Rangpur" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-১৪।
- ↑ "At a galnce"। Carmichael College Rangpur। ৬ জুন ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০২২।
- ↑ "Subject Information | Carmichael College, Rangpur" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-১৪।
- ↑ "বিভাগ সমুহ"। ২১ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০।