অনরণ্য

হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র

অনরণ্য ইক্ষ্বাকুবংশ সূর্যবংশের বিখ্যাত রাজা। তিনি অযোধ্যায় রাজত্ব করতেন। ইনি শ্রীরামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ।[১]

অনরণ্য
अनरण्य
পরিবারইক্ষ্বাকু বংশ
সন্তানপৃষদশ্ব
আত্মীয়সম্ভূত (পিতা)

রামায়ণ এবং অন্যান্য পুরাণগুলোতে ইক্ষ্বাকুবংশের যে কুলপঞ্জিকা পাওয়া যায়,তাতে রাজর্ষি অনরণ্যের সঠিক পরিচয় নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে।

রামায়ণ মতে, মহাতেজস্বী রাজা বাণের পুত্র অনরণ্যঅনরণ্যের পুত্র পৃথু।[২] শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে প্রাপ্ত, ত্রসদস্যুর পুত্র অনরণ্য; তার পুত্র হর্য্যশ্ব।[৩] কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ বলছে, ত্রসদস্যুর পুত্র 'সম্ভূত', তাঁর পুত্র অনরণ্য; আর অনরণ্যের পুত্র পৃষদশ্ব[তৎপুত্র হর্য্যশ্ব]।[৪]

আবার মৎস্যপুরাণে বলা হয়েছে যে, সৌদাস কল্মাষপাদের পুত্র সর্বকর্মা, সর্বকর্মার পুত্র অনরণ্যঅনরণ্যের পুত্রের নাম নিঘ্ন।[৫]

রাবণ ও অনরণ্য সম্পাদনা

ব্রহ্মার বলে বলীয়ান রাবণ দিগ্বিজয়ে বের হয়ে বহু রাজা-মহারাজা-দিকপালদের পরাজিত করেন। দুষ্মন্ত, সুরথ, গাধি, গয়, পুরূরবা প্রভৃতি বিখ্যাক প্রজাপালক রাজারা রাবণের কাছে পরাজয় স্বীকার করেন। এরপর রাবণ অযোধ্যার মহারাজা অনরণ্যের নিকট গিয়ে তাঁকে 'যুদ্ধ' অথবা 'পরাজয়' এই দুটির কোনো একটি বেছে নিতে বলেন। পাপাত্মা রাবণের কথায় ক্রোধান্বিত হয়ে অনরণ্য রাবণকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। সমুদ্রের মতন অযোধ্যার সেনাবাহিনী নিয়ে রাক্ষসসৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রবল বিক্রমের সঙ্গে অনরণ্য যুদ্ধ করলেন। শুক-সারণ, প্রহস্ত প্রভৃতি রাবণের মন্ত্রী-অমার্ত্যরা অনরণ্যের কাছে পরাজিত হলো। কিন্ত কিছুক্ষণ পরেই রাবণের পরাক্রমে এবং রাক্ষসসেনাদের যুদ্ধকুশলতায় অনরণ্যের সৈন্যরা ধ্বংস হলো। তখন অনরণ্য রাবণের মস্তক লক্ষ্য করে আটশ তীর নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু ব্রহ্মার বরে রাবণের কোনো ক্ষতি-ই হলো না। অতঃপর রাবণ অতি ক্রোধে অনরণ্যের মাথায় ভীষণ আঘাত করলেন।অনরণ্য রথ হতে ভূমিতে পড়ে গেলেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে অনরণ্য রাবণকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, 'রাবণ! কাল-কে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। তুমি নিজেই নিজের প্রশংসা করছ বটে, কিন্তু জেনো, অমি তোমার নিকট পরাজিত হইনি। কাল-ই আমার পরাজয়ের কারণ। তুমি নিমিত্ত মাত্র। তুমি কাল-প্রেরিত হয়ে আমার নিকট এসেছ। সেখানে আমি কি করতে পারি? তবু আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাইনি। যুদ্ধ করতে করতে আমি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি। ওরে রাক্ষস! আমি যদি যথাবিহিত প্রজাপালন করে থাকি, যদি সদা সত্যে অবিচল থাকি, তবে আমার এই ইক্ষ্বাকুকূলেই ভগবান বিষ্ণু দশরথের পুত্র রামচন্দ্র রূপে জন্মগ্রহণ করবেন। সেই রামের হাতেই তোমার মৃত্যু হবে।' রাবণকে এই অভিশাপ দেওয়ার পরেই তাঁর মৃত্যু হলো।[৬]

লঙ্কার যুদ্ধে প্রথমবার রাম-রাবণের সম্মুখ যুদ্ধে রাবণের পরাজয় হলে, ভীত রাবণের- অনরণ্যের সেই অভিশাপের কথা মনে পড়েছিল।[৭]

অন্যান্য সম্পাদনা

মহাভারতের আদিপর্বের সূচনায় অনরণ্যের নাম উল্লিখিত হয়েছ অন্যতম প্রচীন রাজর্ষি হিসেবে। পুত্রশোকার্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে সান্ত্বনা দেবার সময় সঞ্জয় যেসব প্রচীন রাজর্ষিদের নাম উল্লেখ করেছেন যারা দীর্ঘকাল যাবৎ বিশাল সাম্রাজ্য এবং অতুল ঐশ্বর্যভোগ করেছেন, এবং সময়ের অলঙ্ঘনীয় নিয়মে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনরণ্য একজন।[৮]

মহাভারতের অনুশাসন পর্বে প্রাতঃস্মরনীয় রাজর্ষিদের নামে অনরণ্যের নাম-ও উল্লিখিত হয়েছে।[৯][১০]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Gopal, Madan (১৯৯০)। K.S. Gautam, সম্পাদক। India through the ages। Publication Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India। পৃষ্ঠা 67 
  2. শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন বঙ্গানুবাদিত, রামায়ণম্। তাহারপুত্র মহাতেজস্বী প্রতাপবান বাণ। বাণের পুত্র মহাতেজস্বী প্রতাপসম্পন্ন অনরণ্য। আদ্কাণ্ড, সর্গ_৭০, শ্লোক_২৩-২৪ 
  3. শ্রীরামনারায়ণ বিদ্যারত্ন বঙ্গানুবাদিত, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ। সে যাহা হউক, পুরুকুৎসের পুত্র ত্রযদস্যু, তাহার তনয় অনরণ্য...।নবম স্কন্ধ, অধ্যায়_৭, শ্লোক_৪ 
  4. শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন বঙ্গানুবাদিত, বিষ্ণুপুরাণম্ , আর্য্যশাস্ত্র। পুরুকুৎস নর্মদার গর্ভে ত্রসদস্যু নামে এক পুত্রোৎপাদন করেন..। চতুর্থাংশ, অধ্যায়_৪, শ্লোক_১৩ 
  5. শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন বঙ্গানুবাদিত, মৎস্যপুরাণম্। তৎপুত্র কল্মাষপাদ, তৎপুত্র সর্বকর্মা, তৎপুত্র অনরণ্য..।অধ্যায়_১২, শ্লোক_৪৬-৪৭ 
  6. শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন বঙ্গানুবাদিত, রামায়ণম্। সেই রাক্ষসরাজ দশানন মরুত্তকে জয় করিয়া যুদ্ধ আকাঙ্খায়..।উত্তরকাণ্ড, সর্গ_১৯[সম্পূর্ণ] 
  7. শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন বঙ্গানুবাদিত, রামায়ণম্। পুর্বে ইক্ষ্বাকু কূলজাত অনরণ্য যে আমায় কহিয়াছিলেন, 'ওরে কুলাঙ্গার রাক্ষসাধম! আমার বংশে এরূপ কোনো পুরুষ উৎপন্ন হইবে, যে পুত্র, অমাত্য, সেনা এবং সারথির সহিত তোমাকে রণস্থলে সংহার করিবে।' এই দাশরথি রামচন্দ্র সেই মনুষ্য বলে বোধ হইতেছে। লঙ্কাকাণ্ড, সর্গ_৬০, শ্লোক_৮-৯ 
  8. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। সত্যব্রতঃ শান্তভয়ঃ সুমিত্রঃ সুবলঃ প্রভু।জানুজঙ্ঘো'নরণ্য'র্কঃ প্রিয়ভৃত্যঃ শুচিব্রতঃ।।আদিপর্ব, অধ্যায়_১, শ্লোক_১৯৭ 
  9. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। অজ, প্রাচীনবর্হি, মহাত্মা ইক্ষ্বাকু...তাঁহারাও প্রাতঃস্মরনীয়। অনুশাসন পর্ব, অধ্যায়_১৪৩, শ্লোক_৫৬ 
  10. নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী সম্পাদিত, পুরাণকোষ(অ-ঔ)। অনরণ্য