গাধি

হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র

গাধি (সংস্কৃত:गाधि) একজন ক্ষত্রিয় রাজা এবং কৌশিক (পরে বিশ্বামিত্র) ও সত্যবতীর (পরশুরামের পিতামহী) পিতা।[১] গাধি প্রাচীন কুশিকবংশীয় রাজা। বেদে বর্ণিত হয়েছে গাধি ছিলেন একজন পুরোহিত যিনি কুশিকের পুত্র ও ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের পিতা[২][৩]

গাধি
ব্যক্তিগত তথ্য
ধর্মহিন্দুধর্ম
সন্তানবিশ্বামিত্র, সত্যবতী[১]
পিতামাতা

ঐতরেয় ব্রাহ্মণে গাধিকে 'গাথিন' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গাথিন কুশিকের পুত্র। গাধির পুত্র বিশ্বামিত্র এবং গাধির পৌত্র মধুচ্ছন্দা ঋষি। গাধি কান্যকুব্জে রাজত্ব করতেন।[৪][৫]

জন্ম বৃত্তান্ত সম্পাদনা

বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে,  চন্দ্রবংশীয় জহ্নুর বংশধারায় জাত কুশের পুত্র কুশাশ্ব। কুশাশ্ব একদা ইন্দ্রের তুল্য পুত্রলাভ করবার জন্য তপস্যা করেছিলেন। তিনি কঠিন থেকে কঠিনতর তপস্যা করছেন দেখে দেবরাজ ইন্দ্র 'আর কেউ আমার তুল্য না হোক' এই ভাবনায় নিজেই কুশাশ্বের পুত্ররূপে জন্ম নিলেন।[৬]

রামায়ণে বলা হয়েছে কুশের পুত্র কুশনাভ। তাঁর পুত্র গাধি।[৭]

মহাভারতের বিবরণ বিষ্ণুপুরাণের বিবরণকে সমর্থন করে। কিন্তু মহাভারতে গাধির পিতার নাম বলা হয়েছে কুশিক।[৮]

ঋচীক-সত্যবতীর বিবাহ সম্পাদনা

মহাভারতের বনপর্বে এবং বিষ্ণুপুরাণে গাধি রাজার কন্যা সত্যবতী ও ঋচীকের বিবাহের বর্ণনা আছে।

বনবাসকালে গাধিরাজার অপ্সরাতুল্য একটি কন্যার জন্ম হয়েছিল। সেই-ই সত্যবতী। একদিন ভৃগুবংশীয় ঋচীক সেই কন্যার পাণি প্রার্থনা করেন। ঋচীক ছিলেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ স্বভাবের এবং বয়সে প্রবীণ। সেই কারণে ঋচীককে কন্যা সম্প্রদান করবার অনিচ্ছায় গাধি বললেন, 'পূর্বপুরুষেরা আমাদের বংশ যে রীতি-নীতি প্রচলন করে গিয়েছেন তা আমাদের পালন করা উচিত[কন্যাপণ?]। সুতরাং হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ!  কানের ভিতর রক্তবর্ণ,  কানের বাইরের বর্ণ শ্যাম, অন্য সমস্ত অঙ্গ পাণ্ডুবর্ণ, মুখ হবে চন্দ্রের মতো এবং অত্যন্ত দ্রুতগামী হবে এমন এক হাজার ঘোড়া আপনি আমায় এনে দিন।' মহর্ষি ঋচীক এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। তিনি তখনই বরুণ দেবের কাছে গিয়ে সেই রকম একহাজার ঘোড়া চাইলেন।

বরুণদেব প্রসন্ন মনে সেই ঘোড়াগুলো ঋচীককে এনে দিলেন।

ঋচীক শর্তপূরণ করেছেন। কন্যাশুল্ক দিয়েছেন। কাজেই আর অমত করা চলে না। তাই ঋচীকের সঙ্গেই সত্যবতীর বিবাহ দিলেন। এই বিবাহে দেবতারা বরযাত্রী হয়েছিলেন।[৯][১০]

যখন ঋচীক বরুণদেবের নিকট এক সহস্র অশ্ব চেয়েছিলেন, তখন অদিতপুত্র বরুণ তাঁকে বলেছিলেন, 'যে স্থানে আপনার ইচ্ছা, সেই স্থানেই এইরকম একহাজার ঘোড়া উঠবে[অর্থাৎ জলের ভিতর থেকে উঠে আসবে]।' ঋচীক কান্যকুব্জের নিকট গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে ঘোড়াগুলোর কথা চিন্তা করামাত্র একহাজার ঘোড়া উঠে এল। এই কারণে গঙ্গার তীরে ঐ স্থানকে অশ্বতীর্থ বলা হয়।[১১]

সত্যবতীর বিবাহ উপলক্ষ্যে পাওয়া অশ্বগুলি গাধিরাজা পুণ্ডরীক - যজ্ঞ করে ব্রাহ্মণদের দান করেছিলেন । ব্রাহ্মণদের থেকে আবার দুইশত করে অশ্ব রাজা হৰ্য্যশ্ব , দিবােদাস এবং উশীনর ক্রয় করেন । বাকি চার শত অশ্ব দস্যুদের দ্বারা অপহৃত হয় । পরবর্তীকালে গাধিপুত্র বিশ্বামিত্রের জন্য গালব হৰ্য্যশ্ব , দিবােদাস ও উশীনর রাজার নিকট থেকে গুরুদক্ষিণা পরিশােধের জন্য অশ্বগুলি সংগ্রহ করেছিলেন।[মহাভারতের উদ্যোগপর্বে গালব-মাধবীর গল্পে দ্রষ্টব্য][৫][১২]

পুত্রপ্রাপ্তি সম্পাদনা

[জমদগ্নি নিবন্ধে 'জন্ম বৃৃৃৃৃত্তান্ত' অনুুুুচ্ছেদ দেখুন]

গাধিরাজা প্রজাপালক, ন্যায়পরায়ণ সত্যনিষ্ঠ হলেও বৃদ্ধবয়স পর্যন্ত সন্তানহীন ছিলেন। সেই কারণেই সম্ভবত সত্যবতীর জন্মের আগে তিনি বনবাসে গিয়েছিলেন। এবং সেখানেই সত্যবতীর জন্ম হয়, এবং তারও অনেক কাল পরে, সত্যবতীর বিয়ের পর গাধির নাতি[জমদগ্নি] এবং পুত্র[বিশ্বামিত্র] একই সঙ্গে জন্মে। সত্যবতী এবং তাঁর মাতা চরু ভক্ষণ এবং বৃক্ষ আলিঙ্গন করায় যে বিপর্যয় ঘটিয়েছিলেন, তার ফলে সত্যবতীর বংশে ক্ষত্রিয়গুণসম্পন্ম পুত্রের জন্ম হয় এবং সত্যবতীর মাতার বংশে পরবর্তী বংশধরেরা সবাই ব্রাহ্মণ হয়েছিল।

     দুষ্টমেতৎ পুরা ভদ্রে জ্ঞাতঞ্চ তপস্যা ময়াঃ।

     ব্রহ্মভূতং হি সকলং পিতুস্তব কুল ভবেৎ।।[৫]

গাধিরাজার কন্যা সত্যবতী হিমালয় পর্বত থেকে কৌশিকী নদীরূপে প্রবাহিত হন।[১৩]

অন্যান্য সম্পাদনা

গাধি অতি জনপ্রিয় রাজা ছিলেন। যখন তিনি পুত্র বিশ্বামিত্রের রাজ্যভিষেক করে দেহত্যাগ করবার জন্য বনগমনের ইচ্ছা করলেন,  তখন তাঁর প্রজারা অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে তাঁকে বনে না যাবার জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু দৃঢ়সঙ্কল্প গাধি বিশ্বামিত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন।[১৪]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Mani ২০১৫
  2. Stephanie Jamison (২০১৫)। The Rigveda –– Earliest Religious Poetry of India। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 464। আইএসবিএন 978-0190633394 
  3. Mani, Vettam (২০১৫-০১-০১)। Puranic Encyclopedia: A Comprehensive Work with Special Reference to the Epic and Puranic Literature (ইংরেজি ভাষায়)। Motilal Banarsidass। আইএসবিএন 978-81-208-0597-2 
  4. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। কান্যকুব্জে কুশিক রাজার পুত্র 'গাধি' নামে...। আদিপর্ব, অধ্যায়_১৬৮, শ্লোক_৩ 
  5. নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী সম্পাদিত, পুরাণকোষ[ক-ণ]। গাধি 
  6. শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন বঙ্গানুবাদিত, বিষ্ণুপুরাণম্ , আর্যশাস্ত্র। পরাশর বলিলেন,- পুরূরবারও আয়ুঃ, ধীমান..তৎপুত্র জহ্নু। চতুর্থাংশ, অধ্যায়_৪, শ্লোক_১-৪ 
  7. পঞ্চানন তর্করত্ন বঙ্গানুবাদিত, রামায়ণম্। পূর্বে এই ধর্মাত্মা অরিন্দম বিশ্বামিত্র বহুকাল...। আদিকাণ্ড, অধ্যায়_৫১, শ্লোক_১৭-১৮ 
  8. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। কালক্রমে কুশিক ইন্দ্রের তুল্য প্রভাবশালী হইয়া...।শান্তিপর্ব, অধ্যায়_৪৮, শ্লোক_৪-৬ 
  9. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। এই সময় পৃথিবীতে কান্যকুব্জ দেশে 'গাধি' নামে বিখ্যাত...তিনি বনবাসে গিয়াছিলেন..। বনপর্ব, অধ্যায়_৯৬, শ্লোক_২০-২৯ 
  10. শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক বঙ্গানুবাদিত, বিষ্ণুপুরাণম্ , আর্যশাস্ত্র। এই ইন্দ্রই...গাধির সত্যবতী নাম্নী এক কন্যা হয়...। চতুর্থাংশ, অধ্যায়_৭, শ্লোক_৫-৭ 
  11. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। ভীষ্ম বলিলেন,- তাহার পর ভৃগুবংশশ্রেষ্ঠ ও তপঃপ্রভাবশালী...। অনুশাসন পর্ব, অধ্যায়_৩, শ্লোক_৩২-৩৬ 
  12. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। ভগবান্ ! একদিকে শ্যামবর্ণ হইবে এবং...। উদ্যোগপর্ব, অধ্যায়_১১০, শ্লোক_৫-৮ 
  13. শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন বঙ্গানুবাদিত, রামায়ণম্। রাঘব! সুব্রতানুষ্ঠায়িনী সত্যবতী নাম্নী আমার জ্যেষ্ঠ ভগিনী..। আদিকাণ্ড, অধ্যায়_৩৪, শ্লোক_৭-১২ 
  14. হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত, মহাভারতম্। বৎস ! কুশিকনন্দন সেই গাধিরাজা মহাযোগী হইয়াছিলেন..। শল্যপর্ব, অধ্যায়_৩৭, শ্লোক_৪৯-৫২