জার্মানীয় ভাষাসমূহ
জার্মানীয় ভাষাসমূহ (ইংরেজি: Germanic languages) ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার এর অন্তর্গত একটি শাখা। এই শাখার সবগুলি ভাষা প্রত্ন-জার্মানীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত, যা খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দের মধ্য পর্যায়ে ও দ্বিতীয়ার্ধে লৌহ-যুগীয় উত্তর ইউরোপে কথিত হত। প্রাচীন জার্মানীয় ভাষাভাষী লোকেরা ২য় শতাব্দীতে উত্তর ইউরোপ এ রোমান সাম্রাজ্য এর সীমান্তে বসতি স্থাপন করেছিল।
জার্মানীয় | |
---|---|
ভৌগোলিক বিস্তার | আদিতে উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপ; বর্তমানে বিশ্বব্যাপী |
ভাষাগত শ্রেণীবিভাগ | ইন্দো-ইউরোপীয়
|
উপবিভাগ | |
আইএসও ৬৩৯-২/৫ | gem |
ইংরেজি ও জার্মান ভাষা সবচেয়ে বড় দুইটি জার্মানীয় ভাষা। ইংরেজিতে প্রায় ৪০ কোটি[১] এবং জার্মান ভাষায় প্রায় ১০ কোটি লোক কথা বলেন। ;[২] অন্যান্য উল্লেখযোগ্য জার্মানীয় ভাষার মধ্যে আছে ওলন্দাজ ভাষা (২ কোটি ভাষাভাষী) ও আফ্রিকান্স ভাষা (দেড় কোটি ভাষাভাষী); উত্তর জার্মানীয় ভাষা যেমন নরওয়েজীয় ভাষা, দিনেমার ভাষা, সুয়েডীয় ভাষা, আইসল্যান্ডীয় ভাষা এবং ফেরোয়েজীয় ভাষা (যেগুলির মোট ভাষাভাষী সংখ্যা প্রায় ২ কোটি)। এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল ৫৩টি জার্মানীয় ভাষা ও উপভাষা তালিকাবদ্ধ করেছে।
ভাষাবিজ্ঞানীরা প্রায়শ জার্মানীয় ভাষাগুলিকে তিনটি দলে ভাগ করেন:
- পশ্চিম জার্মানীয় ভাষাসমূহ: এদের মধ্যে আছে ইংরেজি, জার্মান, এবং নেদারল্যান্ডীয় ভাষাসমূহ (ওলন্দাজ ও ফ্লেমিশ)। এছাড়া আফ্রিকান্স ও ইডিশ-ও এই শাখার অন্তর্ভুক্ত।
- উত্তর জার্মানীয় ভাষাসমূহ: এদের মধ্যে আছে ডেনীয়, সুয়েডীয়, আইসল্যান্ডীয় এবং নরওয়েজীয়।
- পূর্ব জার্মানীয় ভাষাসমূহ: এগুলি এখন বিলুপ্ত। গথিক, এবং ভান্ডাল, বুরগুন্ডীয় ও আরও কিছু গোত্রের ভাষা এর মধ্যে পড়ত।
ব্যাকরণশাস্ত্রসম্পাদনা
জার্মানীয় ভাষাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও শব্দভাণ্ডারে প্রবল সাদৃশ্য দেখা যায়। এগুলি সবগুলিই একটি আদি ভাষা থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বিভিন্ন জার্মানীয় ভাষার মধ্যে তুলনা করে এই আদি ভাষার রূপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব।
প্রত্ন-জার্মানীয় ভাষাটি প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার তিনটি লিঙ্গ সংরক্ষণ করলেও আটটি কারক থেকে কমিয়ে ছয়টি কারক ব্যবহার করত এবং বিশেষণের রূপভেদ করত। পাঁচটি ভাবের স্থানে এতে তিনটি ভাব ছিল (নির্দেশক, অনুজ্ঞা ও সাপেক্ষ) এবং চারটি কালের স্থানে এটি দুইটি কাল (বর্তমান ও অতীত) ব্যবহার করত, যেগুলি থেকে বাকী কালগুলি গঠিত হত। কালক্রমে প্রত্ন-জার্মানীয় ভাষাটি তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে।
পূর্ব জার্মানীয় ভাষাসমূহসম্পাদনা
পূর্ব জার্মানীয় ভাষাগুলি বর্তমান পোল্যান্ড অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। এগুলি সবই এখন বিলুপ্ত, তবে সামান্য কিছু এলাকায় এখনও গোথিক ভাষার দেখা মেলে।
পশ্চিম জার্মানীয় ভাষাসমূহসম্পাদনা
পশ্চিম জার্মানীয় ভাষাগুলি মূলত উত্তর সাগরের উপকূল ঘেঁষে গড়ে ওঠে এবং এই এলাকার লোকেরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অন্য যেসব স্থানে গিয়ে বসতি করেছিল, সেখানেও এই ভাষাগুলির প্রচলন হয়। বর্তমানে ছয়টি আধুনিক ভাষা পশ্চিম জার্মানীয় ভাষার অন্তর্গত: ইংরেজি, ফ্রিজীয়, নেদারল্যান্ডীয়, আফ্রিকান্স, জার্মান ও ইডিশ।
মাতৃভাষাভাষীর সংখ্যা বিচারে চীনা ভাষার পরেই ইংরেজি ভাষার স্থান। আর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত দ্বিতীয় ভাষাও ইংরেজি।
ফ্রিজীয় ভাষার ধ্বনিব্যবস্থার সাথে ইংরেজির অনেক মিল আছে। তবে এ ভাষাটি বর্তমানে কেবল উত্তরাঞ্চলীয় নেদারল্যান্ড্স ও উত্তর-পশ্চিম জার্মানিতে প্রচলিত।
নেদারল্যান্ড্সের ওলন্দাজ ভাষা ও বেলজিয়ামের ফ্লেমিশ ভাষাকে একত্রে নেদারল্যান্ডীয় ভাষা বলা হয়। এগুলি গঠনগতভাবে একই ভাষা, তবে ফ্লেমিশ ভাষায় ঔপভাষিক বৈচিত্র্য বেশি।
নেদারল্যান্ডীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত একটি ভাষা আফ্রিকান্স, ইউরোপ থেকে বহু দূরে, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রচলিত। আফ্রিকান্স ভাষায় স্থানীয় বিভিন্ন বান্টু ভাষার প্রভাব পড়েছে।
জার্মান ভাষা জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রভাষা এবং সুইজারল্যান্ডের তিনটি সরকারী ভাষার একটি। ইংরেজি ও ফরাসির পরে জার্মান ভাষা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অধীত ও ব্যবহৃত দ্বিতীয় ভাষা। ৬ষ্ঠ শতকে উচ্চ জার্মান ব্যঞ্জনধ্বনি সরণের ফলে উচ্চ জার্মান উপভাষাগুলি নেদারল্যান্ডীয় ভাষা ও নিম্ন-জার্মান ভাষাগুলি থেকে পৃথক হয়ে যায়। আদি জার্মান ভাষায় লাতিন ভাষার বড় রকমের প্রভাব ছিল, কেননা লেখালেখি মূলত ধর্মালয়গুলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মধ্যযুগের শেষ দিকে এসে ইউরোপে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে জার্মান ভাষা ফরাসি ভাষা থেকে অনেক শব্দ ঋণ নেয়। আধুনিক যুগে এসে লিখিত জার্মান ভাষা একটি আদর্শ রূপ ধারণ করলেও জার্মান মৌখিক উপভাষাগুলির মধ্যে বেশ ভালই পার্থক্য রয়ে গেছে।
ইডিশ ছিল মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদীদের ভাষা। জার্মানীয় ভাষা হলেও এতে বিভিন্ন রোমান্স ভাষা, হিব্রু ও আরামীয় ভাষা ও স্লাভীয় ভাষাগুলির প্রচুর উপাদান ছিল। ইডিশ ভাষায় প্রায় ১ কোটিরও বেশি লোক কথা বলতেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হলোকস্টে এদের অধিকাংশকেই নাৎসিরা হত্যা করে।
উত্তর জার্মানীয় ভাষাসমূহসম্পাদনা
আদি মধ্যযুগের ভাইকিং সম্প্রসারণের সময় পূর্ব দিকে গ্রিনল্যান্ড থেকে পশ্চিমে রাশিয়া পর্যন্ত উত্তর জার্মানীয় তথা স্ক্যান্ডিনেভীয় ভাষাগুলি প্রচলিত ছিল। ১১শ ও ১২শ শতকে এই এলাকায় খ্রিস্টধর্মের আগমনের পর পুরনো রুনীয় লিপি বর্জন করে লাতিন লিপি গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে মার্টিন লুথারের অনূদিত উচ্চ জার্মান ভাষায় লেখা বাইবেলও স্ক্যান্ডিনেভীয় ভাষাগুলিকে প্রভাবিত করে।
স্ক্যান্ডিনেভীয় ভাষাগুলির মধ্যে প্রথমে ডেনীয় ভাষার উদ্ভব ঘটে। এরপর ১৬শ শতকে সুয়েডীয়রা ডেনমার্ক থেকে আলাদা হয়ে যায় পরবর্তী শতকগুলিতে সুইডেনের সম্প্রসারণের সাথে সাথে সুয়েডীয় ভাষার আদর্শায়ন ঘটে। বর্তমানে সুয়েডীয় ভাষা কেবল সুইডেনেই নয়, ফিনল্যান্ডেও একটি সরকারী ভাষা।
আধুনিক স্ক্যান্ডীনেভীয় ভাষাগুলির আইসল্যান্ডীয় ভাষাই পুরনো স্ক্যান্ডিনেভীয় ব্যাকরণ প্রায় পুরোটাই ধরে রেখেছে এবং বিদেশী শব্দ ঋণ গ্রহণ করেনি বললেই চলে।
নরওয়েতে বোকমাল ও নিনর্স্ক এই দুইটি ভাষা পাশাপাশি বিদ্যমান। নরওয়ের অভিজাত শ্রেণীর ডেনীয় ভাষা ও স্থানীয় নরওয়েজীয় উপভাষাগুলির মধ্যে সমঝোতার ফসল হচ্ছে বোকমাল ভাষা। সরকারী ও বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে এখনও এটিই বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে নিনর্স্ক তথা "নতুন নরওয়েজীয়" ভাষাটি ভাষাবিজ্ঞানী ইভার আসেন দ্বারা ১৯শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আদর্শায়িত একটি ভাষা। আসেন চেয়েছিলেন নিনর্স্ক যেন সেসময়কার সরকারি ভাষা ডেনীয় ভাষাকে উৎখাত করে জাতীয় ভাষায় পরিণত হয়।
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ "The Germanic Languages" by Ekkehard Konig, Johan van der Auwera (page 1)
- ↑ "Världens 100 största språk 2010" [The world's 100 largest languages in 2010]। Nationalencyklopedin (সুইডিশ ভাষায়)। ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।