তেজস্ক্রিয়তা
তেজস্ক্রিয়তা হলো যেসকল মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৮২ এর বেশি, তাদের নিউক্লিয়াস দ্রুত গতির নিউটন দ্বারা আঘাত করলে নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উচ্চভেদন সম্পূর্ণ বিকিরণ নির্গত হওয়ার ঘটনা। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত মৌল সমূহের মধ্যে তেজস্ক্রিয় মৌল ১৪ টি।
আবিষ্কারসম্পাদনা
ফরাসি বিজ্ঞানী অঁতোয়ান অঁরি বেকরেল ১৮৯৬ সালে এক্সরে নিয়ে গবেষণা করার সময় এমন একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রাকৃতিক ঘটনা আবিষ্কার করে ফেলেন যা সারা বিশ্বের বিজ্ঞান জগতে দারুন আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি দেখতে পান যে, ইউরেনিয়াম ধাতুর নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরত বিশেষ ভেদন শক্তি সম্পন্ন রশ্মি বা বিকিরন নির্গত হয়। তার নামানুসারে এই রশ্মির নাম দেওয়া হয় বেকারেল রশ্মি। তিনি লক্ষ করেন যে মৌল থেকে এই রশ্মি নির্গত হয়, তা একটি সম্পূর্ণ নতুন মৌলে রুপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত এই রশ্মি নির্গমন অব্যাহত থাকে। পরবর্তীকালে মাদাম কুরি ও তার স্বামী পিয়ের কুরি ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে দেখতে পান যে রেডিয়াম, পোলোনিয়াম, থোরিয়াম, আ্যক্টিনিয়াম প্রভৃতি ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস থেকেও বেকরেল রশ্মির মত একই ধরনের রশ্মি নির্গত হয়, যা এখন তেজষ্ক্রিয় রশ্মি নামে পরিচিত। যে সব মৌল হতে তেজষ্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হয় তাদেরকে তেজষ্ক্রিয় মৌল বলে। তেজষ্ক্রিয় রশ্মি নির্গমনের এই ঘটনাকে তেজষ্ক্রিয়তা(Radioactivity) বলে।
সংজ্ঞাসম্পাদনা
তেজস্ক্রিয়তা হল সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি অস্থিতিশীল পরমাণুর নিউক্লিয়াস আয়নাইজিং বিকিরণে আলফা কণা, বিটা কণিকা,গামা রশ্মি নির্গত করে শক্তি হারায়।[১]
বৈশিষ্ট্যসম্পাদনা
- যে সকল মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৮৩(83)-এর বেশি, সাধারণত সেই সকল পরমাণু তেজষ্ক্রিয় হয়। তবে ৮৩র থেকে হাল্কা অনেক মৌলের-ই কিছু সমস্থানিক তেজষ্ক্রিয়।
- তেজষ্ক্রিয় পদার্থ সাধারনতঃ আলফা, বিটা ও গামা এই তিন ধরনের তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই পজিট্রন, নিউট্রন, নিউট্রিনো, ইত্যাদিও নির্গত হতে পারে।
- তেজষ্ক্রিয়তা একটি সম্পূর্ণ নিউক্লিয় ঘটনা, এর মাধ্যমে নিউক্লিয়াসের ভাঙনের ফলে একটি মৌল আরেকটি নতুন মৌলে রূপান্তরিত হয়।
- নিউক্লিয় ঘটনা বলে তেজষ্ক্রিয়তা কে চাপ, তাপ, বিদ্যুৎ বা চৌম্বক ক্ষেত্রের ন্যায় বাইরের কোন সাধারণ ভৌত প্রক্রিয়া দ্বারা এর সক্রিয়তাকে রোধ বা হ্রাস বৃদ্ধি করা যায় না। তবে অত দ্রুতবেগ নিউট্রন, বা সূর্যের অভ্যন্তরের মত তীব্র তাপমাত্রা, বা সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময়কালীন চাপের মত চরম অবস্থায় নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটান সম্ভব।৷৷ ইউরেনিয়াম,রেডিয়াম ইত্যাদি তেজস্ক্রিয় পদার্থ।
তেজষ্ক্রিয় মৌলের অর্ধায়ুসম্পাদনা
যে সময়ে কোন তেজষ্ক্রিয় পদার্থের মোট পরমাণুর ঠিক অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাকে ঐ পদার্থের অর্ধায়ু বলে। উদাহরণ হিসেবে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ কার্বন-১৪ -এর অর্ধায়ু ৫৭৩০ বছর। যদি শুরুতে ১০০ গ্রাম কার্বন-১৪ থাকে তা তেজস্ক্রিয়-ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ৫০ গ্রামে পরিণত হতে সময় লাগবে ৫৭৩০ বছর। উক্ত ৫০ গ্রাম একইভাবে আবার ২৫ গ্রামে পরিণত হতে সময় লাগবে আরও ৫৭৩০ বছর। এই কারণে কার্বন-১৪ এর অর্ধ-জীবন = ৫৭৩০ বছর। এইভাবে ১০০ গ্রাম তেজক্রিয় কার্বন -১৪ সম্পুর্ণরূপে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে (বাস্তবে C-14 থেকে N-14 এ পরিণত হতে) সময় লাগবে ৫১৫৭০ বছর।
তেজষ্ক্রিয়তার এককসম্পাদনা
তেজষ্ক্রিয়তা পরিমাপ করার জন্য যে একক ধরা হয় তাকে বলা হয় বেকেরেল। প্রতি সেকেন্ডে একটি তেজষ্ক্রিয় বিভাজন বা তেজষ্ক্রিয় ক্ষয়কে এক বেকেরেল বলে। তেজস্ক্রিয়তা তথা বিকিরণের পরিমাপ তিন ধাপের (Radioactivity, Absorbed Dose, Effective dose) জন্য তিনভাবে করা হয়। পারমাণবিক চুল্লী ও তেজস্ক্রিয় মৌলের ব্যাপারে যখন বিকিরণের (Radiation) ব্যাপারটি আসে তখন দেখা হয় উৎস থেকে বিকিরণের পরিমাণ কত। এই পরিমাণকে বেকরেল বা ক্যুরি দিয়ে প্রকাশ করা হয়। প্রতি সেকেন্ডে একটি বিকিরণকে বলা হয় Becquerel। প্রতি সেকেন্ডে ৩৭,০০০,০০০,০০০ বিকিরণকে বলা হয় 1 curie (১ গ্রাম রেডিয়াম-২২৬ এক .সেকেন্ডে ১ ক্যুরি বিকিরণ ত্যাগ করে)। উৎস থেকে দুরত্ব, মানুষের বয়স, শারীরিক কাঠামো, বিকিরণের গ্রেড, সময় ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে তেজস্ক্রিয়তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি ও বস্তু বিশেষে বিভিন্ন রকম হতে পারে। বিকিরণগুলো বিভিন্ন বস্তুতে কতটুকু শোষিত হল তা (Absorbed Dose ) প্রকাশের জন্য ব্যবহার হয় রেড (rad) বা গ্রে (gray)। যখন স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও পরিবেশ সংক্রান্ত ব্যাপার আসে তখন বিকিরণগুলো কতটুকু বিপজ্জনক অর্থ্যাৎ কোন বস্তু বা ব্যক্তি বিকিরণ (Absorbed Dose) শোষণ করার পর ক্ষতির (biological effects) পরিমাণ কতটুকু সেটাই (effective dose) পরিমাপ করা হয়। এই ডোসের পরিমাণকে রেম (rem) বা সিভার্ট (sievert)দিয়ে প্রকাশ করা হয়। মানুষের শরীরে শোষিত বিকিরণ যদি বিটা, গামা বা এক্স রশ্নির হয় তবে 1 gray = 1 dose = 1 sievert ধরা হয়। আর যদি আলফা রশ্নির হয় তবে 1 gray = 1 dose = 20 sievert ধরা হয়। অর্থ্যাৎ কোন মানুষের শরীর যদি বিটা/গামার এক গ্রে'র একটি ডোস ও আলফা রশ্মির একটি ডোস গ্রহণ করে তবে ক্ষতির পরিমাণ হিসেবে তা হবে ২১ সিভার্ট। কারণ আলফা রশ্মির ক্ষতি বিটা/গামা রশ্মি অপেক্ষা প্রায় ২০ গুণ বেশি।
তেজস্ক্রিয়তার উৎসসম্পাদনা
তেজস্ক্রিয়তার উৎসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: প্রাকৃতিক, মানুষের সৃষ্ট ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত।
- প্রাকৃতিক উৎস - পৃথিবীর সবদিকে মহাশূন্য থেকে ইলেকট্রন, প্রোটন ও কয়েকটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস প্রায় আলোর বেগে পৃথিবীতে আঘাত হানে। এদেরকে মহাজাগতিক রশ্মি (Cosmic rays) বলে। এই রশ্মিগুলো বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত। প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা অল্প মাত্রায় বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে চলে আসে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা যত বেশি হয়, এর মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। প্রাকৃতিক উৎসের মধ্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হচ্ছে রেডন গ্যাস। এটি বাতাস থেকে ৮ গুণ ভারী। এর তিনটি প্রাকৃতিক আইসোটোপ রয়েছে। এগুলো রেডিয়াম, ইউরানিয়াম ও থোরিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা থেকে সৃষ্টি হয়। এছাড়া প্রাকৃতিক শিলা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও বিভিন্ন শিল্প থেকে প্রচুর রেডিয়ান গ্যাস বায়ুমন্ডলে যোগ হয়।
- মানুষের সৃষ্ট - চিকিৎসায় এক্স-রে (রঞ্জন রশ্মি) ও অন্যান্য বিকিরণ থেরাপির মেশিন তেজস্ক্রিয়তার উল্লেখযোগ্য উৎস। শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি ও দ্রব্যের মান যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন কমপোনেন্ট ব্যবহার হয় যেগুলো থেকে বিপজ্জনক বিরণের সৃষ্টি হয়। সামরিক নিউক্লিয়ার চুল্লী, পারমাণবিক মারণাস্ত্র পরীক্ষা-নিরিক্ষা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন দূর্ঘটনায় বিপুল পরিমানে তেজস্ক্রিয় পদার্থ আশেপাশের বিরাট এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
- পারিপার্শ্বিক পরিবেশ - আমাদের আশেপাশের প্রায় প্রত্যেক বস্তু থেকেই কমবেশি বিকিরণ হচ্ছে। আমাদের বাড়িঘর, খাদ্য, পানীয় এমনকি আমাদের নিজের শরীর থেকেও তেজস্ক্রিয় রশ্মির বিকিরণ হচ্ছে। এই বিকিরণ খুবই কম মাত্রার যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়।
ব্যবহারসম্পাদনা
- ক্যান্সার রোগ নিরাময়ের কাজে তেজষ্ক্রিয়তার ব্যবহার করা হয়।
- উন্নত বীজ তৈরির গবেষণায় তেজষ্ক্রিয়তা সফল ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
- খনিজ পদার্থে বিভিন্ন ধাতুর পরিমাণ নির্ণয়ে উক্ত ধাতুর তেজষ্ক্রিয় আইসোটোপ তেজষ্ক্রিয় প্রদর্শক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে।
- ঘড়ির কাঁটায় তেজষ্ক্রিয় থোরিয়ামের সাথে জিঙ্ক সালফাইড মিশিয়ে ঘড়ির কাঁটা ও নম্বরে প্রলেপ দেওয়া হয় ফলে এরা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে।
- তেজস্ক্রীয় আইসোটোপ থেকে ফিশন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ও জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
- নির্মাণ বা উৎপাদন-শিল্পে কাগজ, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি বিভিন্ন বস্তুর পুরুত্ব, ঘনত্ব ও উপাদানের সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ে আলফা ও বিটা রশ্মিকে ব্যবহার করা হয়।
- কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে (তেজস্ক্রিয়তা-ক্ষয়ের পরিমাপ) বিশ্লেষণ করে জীবাশ্মসংক্রান্ত নমুনা ও শিলাখন্ডের বয়স নির্ধারণ করা হয়।
তেজস্ক্রিয়তার বিপদসম্পাদনা
- এই রশ্মি জীবদেহে মারাত্নক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
- উচ্চ মাত্রার তেজষ্ক্রিয় বিকিরন মানবদেহে নানা রকম ক্যান্সারের জন্ম দিতে পারে।
- দীর্ঘদিন মাত্রাতিরিক্ত তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শে থাকলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়, মানসিক বিকার এমন কি বিকলাঙ্গতাও দেখা দিতে পারে।
- এর ক্ষতিকর প্রভাব বংশ পরস্পরায়ও পরিলক্ষিত হয়। যেমন-তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে বিকালঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।
- তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ মানব সভ্যতার জন্য হুমকি স্বরূপ।
তেজষ্ক্রিয়তার প্রতিকার ও চিকিৎসাসম্পাদনা
- প্রখর সূর্যকিরণে (দুপুর ১২ - ২টা) বাহিরে যাওয়া থেকে বিরত থাকা।
- যতটুকু সম্ভব বৃষ্টির জলকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা।
- ক্লোরোফিল ও অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা।
- খাবারে আয়োডিন ব্যবহার করা (আয়োডিনযুক্ত লবণ)।
- দিনের বেলায় বাহিরে বের হলে সান-গ্লাস ব্যবহার করা।
- বিভিন্ন রেডিয়েশন থেরাপি অতিমাত্রায় গ্রহণ না করা।
- এক্স-রে ও রেডিয়েশন হয় এমন সব মেশিন থেকে দূরে থাকা।
- দিনের বেলায় বাহিরে বের হলে শরীর ঢেকে রাখা বা সান-লোশন বা ক্রিম ব্যবহার করা।
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ "Radioactivity - an overview | ScienceDirect Topics"। www.sciencedirect.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-০৪।
- বিজ্ঞান বিশ্বকোষ - বাংলা একাডেমী
- Radiation, People and the Environment ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে
- Information on Sources of Radiation ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ আগস্ট ২০১১ তারিখে