হুদাইবিয়ার সন্ধি

মদিনা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী মুহাম্মদ এবং মক্কার কুরাইশ গোত্রের মধ্যে চুক্তি

আল-হুদায়বিয়ার সন্ধি (আরবি: صُلح الْحُدَيْبِيَة) হল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় সংঘটিত হয়। এই চুক্তি ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে (৬ হিজরি, জিলকদ মাসে) মদিনার প্রতিনিধি হিসেবে মুহাম্মদ (সা.) এবং মক্কার কুরাইশ গোত্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়।

আল-হুদায়বিয়ার সন্ধি
ধরণশান্তিচুক্তি
স্বাক্ষরপ্রদানমার্চ ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ (জিলকদ ৬ হিজরি)
অবস্থানআল-হুদায়বিয়া
মেয়াদোত্তীর্ণ১০ জানুয়ারি ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ (২০ রমজান ৮ হিজরি)
আপসকারী
পক্ষ
ভাষাআরবি
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলি

এই সন্ধির ফলে মদিনা ও মক্কার মধ্যে চলমান উত্তেজনা প্রশমিত হয়। এতে দুই পক্ষের মধ্যে ১০ বছরের জন্য শান্তিচুক্তি স্থাপিত হয় এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারীদের পরের বছর শান্তিপূর্ণভাবে তীর্থযাত্রা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই তীর্থযাত্রা পরবর্তীতে প্রথম উমরা নামে পরিচিত হয়।

তবে, এই চুক্তি দুই বছরের মধ্যেই ভঙ্গ হয়। ইসলামি সূত্র অনুযায়ী, কুরাইশ গোত্র এই সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন করে। এর ফলস্বরূপ, ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ (সা.) ১০,০০০ সৈন্য নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হন।

পটভূমি

সম্পাদনা

ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বার্তা প্রত্যাখ্যান এবং তাঁর অনুসারীদের উপর নির্যাতনের ফলে তিনি ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে নিজ শহর মক্কা ত্যাগ করে তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে মদিনা নগরে অভিযান করেন।[] মদিনায় তিনি আরও অনুসারী লাভ করেন এবং একটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে থেকে তিনি তাঁর মক্কার প্রতিপক্ষদের সঙ্গে তিনবার যুদ্ধ করেন। এই প্রতিপক্ষরা ছিল তাঁর নিজ গোত্র কুরাইশ[]

এর ফলে মুসলমানদের জন্য মক্কা ছিল একপ্রকার নিষিদ্ধ এলাকা,[] যদিও শহরটিতে কাবা অবস্থিত ছিল, যা প্রাচীনকাল থেকেই একটি তীর্থকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ইসলাম-পূর্ব যুগেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাসনাস্থল ছিল। তবে মনে করা হয়, মুসলমানদেরকে কাবায় হজ পালনের নির্দেশ দেওয়া হয় মদিনা পর্বে গিয়ে।[]

শুরুর দিকে মুসলমানরা জেরুজালেমমুখী হয়ে নামাজ আদায় করতেন,[] কিন্তু পরবর্তীতে মদিনায় অবস্থানকালে মুহাম্মদ (সা.) একটি ঐশী নির্দেশনা পান, যাতে তাঁকে মক্কার দিকে মুখ করে নামাজ পড়ার আদেশ দেওয়া হয়।[]

প্রচলিত বিবরণ

সম্পাদনা

৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে, নবী মুহাম্মদ (সা.) একটি স্বপ্ন দেখেন, যেখানে তিনি কাবার তাওয়াফ করছেন। এই স্বপ্ন দেখে তিনি তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[] মক্কার লোকদের প্রতিক্রিয়া সহিংস হতে পারে, এই আশঙ্কায় তিনি মদিনার আশেপাশের বেদুইন ও গোত্রীয় মিত্রদের আমন্ত্রণ জানান তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে। তবে অধিকাংশই যোগ দেয়নি, সম্ভবত তারা কোনো যুদ্ধলাভ বা লুটের আশাবাদী ছিল না অথবা সংঘর্ষের আশঙ্কা করেছিল।[][]

মুহাম্মদ (সা.) প্রায় ১,৫০০ মুসলমান ও কিছু গোত্রীয় মিত্র নিয়ে উমরা পালনের জন্য মক্কার দিকে যাত্রা করেন।[] [] কিছু সূত্রে মুসলমানরা অস্ত্র নিয়ে গিয়েছিল কিনা, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।[১০] তবে তারা তীর্থযাত্রীর পোশাকে ছিল এবং তাদের সঙ্গে কুরবানি করার পশুও ছিল।[১১]

এ খবর পেয়ে মক্কার কুরাইশরা ভেবেছিল এটি একটি আক্রমণ। তারা ২০০ জন অশ্বারোহী পাঠিয়ে পথরোধ করার চেষ্টা করে। মুহাম্মদ (সা.) সাধারণ পথ পরিহার করে বিকল্প পথে হেঁটে হুদায়বিয়া নামক স্থানে তাঁবু স্থাপন করেন। এই স্থানটি কাবার পবিত্র সীমার সীমানায় ছিল।[]

কুরাইশরা তাদের দূত পাঠিয়ে আলোচনা শুরু করে। মুহাম্মদ (সা.) জানিয়ে দেন, তিনি শুধু তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যেই এসেছেন, কোনো শত্রুতা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তবুও কুরাইশরা এটি দুর্বলতা এবং পরাজয় হিসেবে দেখেছিল। তারা বলেছিল, "যদি সে যুদ্ধ করতে না এসেও থাকে, তবে আল্লাহর কসম, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে কখনও এই পবিত্র স্থানে প্রবেশ করতে পারবে না, এবং বেদুইনরা যেন এমন কিছু আমাদের সম্পর্কে না বলে"।[১২]

এক পর্যায়ে, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবী উসমানকে আলোচনার জন্য মক্কায় পাঠান। এর মধ্যে গুজব ছড়ায় যে উসমানকে হত্যা করা হয়েছে। মুহাম্মদ (সা.) তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার নেন। এই অঙ্গীকার ‘গাছতলায় বাইআত’ (bay'at al-shajara) নামে পরিচিত হয়। পরে জানা যায়, গুজবটি ভুল ছিল, এবং কুরাইশরা তাদের প্রতিনিধি সুহাইল ইবন আমরকে আলোচনার জন্য পাঠায়। আলোচনা শেষে একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়।[১৩][১৪]

চুক্তির প্রধান শর্তাবলি ছিল:[১৫]

  • দুই পক্ষের মধ্যে ১০ বছরের জন্য যুদ্ধবিরতি থাকবে।
  • কুরাইশ থেকে কেউ মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে পালিয়ে এলে এবং তার অভিভাবকের অনুমতি না থাকলে, তাকে ফেরত পাঠাতে হবে; তবে মুসলমানদের কেউ কুরাইশে গেলে তাকে ফেরত পাঠানো হবে না।
  • কেউ মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে চুক্তি করতে চাইলে তা করতে পারবে, আবার কেউ কুরাইশের সঙ্গে চুক্তি করলে সেটিও গ্রহণযোগ্য হবে।
  • মুসলমানরা এ বছর তীর্থযাত্রা না করে মদিনায় ফিরে যাবে, তবে পরের বছর তারা মক্কায় তিনদিন অবস্থান করতে পারবে। সে সময় কুরাইশরা শহর খালি করে দেবে। মুসলমানরা কেবল খাপে বাঁধানো তলোয়ার নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে।

চুক্তিপত্রটি লেখেন আলি। তিনি যখন লিখছিলেন, "এটি হল আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে সুহাইল ইবন আমরের সঙ্গে চুক্তি", তখন সুহাইল আপত্তি জানান। তিনি বলেন, তিনি মুহাম্মদের নবুয়ত মেনে নেন না, তাই শুধুমাত্র ‘মুহাম্মদ’ নাম ব্যবহার করতে হবে। মুহাম্মদ (সা.) এতে সম্মতি দেন।[১৬]

চুক্তি শেষ হওয়ার পর, সুহাইলের পুত্র আবু জন্দাল ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দিতে আসেন। তবে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তাকে সুহাইলের হাতে ফেরত দেওয়া হয়।[১৩] উমর ও কিছু সাহাবী এই চুক্তিতে অসন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ তারা কুরাইশকে আল্লাহর শত্রু বলে মনে করতেন।[১৭]

পরবর্তীতে মুহাম্মদ (সা.) তাঁর অনুসারীদের পশু কোরবানি ও মাথা মুণ্ডন করার নির্দেশ দেন। তারা প্রথমে অনিচ্ছুক থাকলেও, নবী নিজে উদাহরণ সৃষ্টি করলে তারা তাঁর অনুসরণ করে। পরে মুসলমানরা মদিনায় ফিরে যায় এবং এই সময় সূরা আল-ফাতহ (সূরা ৪৮) অবতীর্ণ হয়।[১৩]

পরবর্তী ঘটনা

সম্পাদনা

সন্ধির শর্ত অনুযায়ী, যারা ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের কুরাইশদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আবু বাসির নামের একজন মুসলমানকে ফেরত দেওয়ার পর, তিনি পালিয়ে সাগরতট অঞ্চলে আশ্রয় নেন। পরে প্রায় ৭০ জন মুসলমান, যাদের মধ্যে আবু জন্দালও ছিলেন, তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করে মক্কার সিরিয়া-মুখী বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ শুরু করেন।

এতে কুরাইশরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং পরে মুহাম্মদ (সা.)-কে অনুরোধ জানায় যেন তিনি এই গেরিলা দলকে মদিনায় নিয়ে আসেন।

পরবর্তীতে মুসলমানরা একতরফাভাবে সন্ধিতে একটি ব্যতিক্রম সৃষ্টি করে। কিছু মুসলিম নারী মক্কা থেকে পালিয়ে মদিনায় চলে আসেন। তখন মুহাম্মদ (সা.) সূরা আল-মুমতাহিনা (৬০:১০) অবতীর্ণ লাভ করেন, যাতে অবিশ্বাসীদের কাছে এসব নারীদের ফিরিয়ে না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।[১৩]

মূল্যায়ন ও উত্তরাধিকার

সম্পাদনা

দীর্ঘমেয়াদে হুদায়বিয়ার সন্ধি মুসলমানদের জন্য লাভজনক প্রমাণিত হয়। অনেক ঐতিহাসিক এটিকে মুহাম্মদ (সা.)-এর ক্ষমতা সংহতকরণের একটি "গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ" হিসেবে গণ্য করেন।[১৮] এই চুক্তির মাধ্যমে কুরাইশরা পরোক্ষভাবে মুহাম্মদ (সা.)-কে নিজেদের সমমর্যাদাসম্পন্ন নেতা হিসেবে স্বীকার করে।[১৯] পাশাপাশি, কাবায় তীর্থযাত্রার সুযোগ পাওয়ার মাধ্যমে ইসলামকে এমনসব গোত্রের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব হয়, যারা কাবাকে অত্যন্ত মর্যাদার চোখে দেখত।[১৮]

জীবনীকার ইবন হিশাম লিখেছেন, "ইসলামের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় কোনো বিজয় হয়নি... যখন যুদ্ধ বন্ধ হয়, নিরাপদে মানুষের সাক্ষাৎ হয় এবং আলাপ-আলোচনা চলে, তখন কেউ ইসলাম নিয়ে যুক্তিযুক্তভাবে আলোচনা করে এবং তা গ্রহণ না করে থাকে না।"[২০]

এই সন্ধির ফলে মুহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষে আরবের অন্যান্য অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার সহজ হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক ফ্রেড ডোনার ধারণা করেন, মূলত এই তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যই ছিল মক্কার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি অর্জন করা, কারণ মদিনা ছিল দুটি শত্রুপূর্ণ শহরের মাঝে অবস্থিত — উত্তরে খায়বার ও দক্ষিণে মক্কা — ফলে শহরটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু তিনি সরাসরি মক্কাবাসীদের কাছে শান্তির আবেদন করতে পারেননি। তিনি এমন কৌশল অবলম্বন করেন, যাতে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং শান্তিচুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্জিত হয়। যদিও এটি ছিল একটি "বিপজ্জনক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ", কারণ কুরাইশরা যদি সন্ধি না করে যুদ্ধ বেছে নিত, তাহলে তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারত।[২১]

চুক্তির অল্প কিছুদিন পর মুহাম্মদ (সা.) খায়বার অবরোধ করেন এবং তাদের নিরস্ত করেন।[২২] এরপর অন্যান্য গোত্র তাদের পছন্দমতো পক্ষ বেছে নিতে স্বাধীনতা পায় এবং মুহাম্মদ (সা.) কিছু কুরাইশ-সমর্থিত গোত্রকেও নিজের পক্ষে আনতে সক্ষম হন।[২৩]

ইসলাম-বিশেষজ্ঞ মন্টগোমারি ওয়াট মনে করেন, এই সন্ধির মাধ্যমে মদিনার অবরোধ ভেঙে মক্কার সিরিয়াগামী বাণিজ্য পুনরায় সচল করা এবং কুরাইশদের জন্য কিছু ছাড় দেওয়া মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিকল্পিত পদক্ষেপ ছিল, যাতে সম্পর্কোন্নয়ন ঘটে এবং কুরাইশদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা যায়।[২৪]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Donner 2010, পৃ. 42-43।
  2. Donner 2010, পৃ. 43-44, 46-47।
  3. Hawting 1986, পৃ. 1।
  4. Donner 2010, পৃ. 64-65।
  5. Kennedy 2016, পৃ. 35।
  6. Watt 1971
  7. Guillaume 1998, পৃ. 499।
  8. Watt 1956, পৃ. 46।
  9. Fishbein 1997, পৃ. 68–70।
  10. Donner 1979, পৃ. 240 n।
  11. Guillaume 1998, পৃ. 499–500।
  12. Donner 1979, পৃ. 240।
  13. Goerke 2000, পৃ. 241।
  14. Ali 1981, পৃ. 61।
  15. Watt 1956, পৃ. 47–48।
  16. Guillaume 1998, পৃ. 504।
  17. Ali 1981, পৃ. 61–62।
  18. Donner 1979, পৃ. 241।
  19. Watt 1956, পৃ. 48।
  20. Guillaume 1998, পৃ. 507।
  21. Donner 1979, পৃ. 242–244।
  22. Donner 1979, পৃ. 245।
  23. Watt 1956, পৃ. 48–49।
  24. Watt 1956, পৃ. 49।


উদ্ধৃতি ত্রুটি: "lower-alpha" নামক গ্রুপের জন্য <ref> ট্যাগ রয়েছে, কিন্তু এর জন্য কোন সঙ্গতিপূর্ণ <references group="lower-alpha"/> ট্যাগ পাওয়া যায়নি