সুকুহ্ (ইন্দোনেশীয়: Candi Sukuh Indonesian উচ্চারণ: [ˈtʃandi ˈsukʊh]) ইন্দোনেশিয়ার জাভায় অবস্থিত একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির। এটি ১৫শতাব্দীতে নির্মিত এবং মধ্য ও পূর্ব জাভা প্রদেশের সীমানায় মাউন্ট লায়ু (৯১০ মিটার বা ২৯৯০ ফুট উচ্চতা) এর পশ্চিম ঢালে অবস্থিত।

সুকুহ মন্দিরের প্রধান স্থাপনা

ইন্দেনেশিয়ার অন্যান্য হিন্দু মন্দিরের চেয়ে সুকুহ্ সম্পূর্ণ পৃথক কেননা জন্মপূর্ব জীবন আর যৌনবিষয়ক শিক্ষা এই মন্দিরের প্রধান উপজীব্য। এর প্রধান অংশটি একটি পিরামিড আকৃতির কাঠামো যার সামনে বিভিন্ন কারুকাজ ও মূর্তি বিদ্যমান। এসব মূর্তির মধ্যে তিনটি সমতলীয় খোলসযুক্ত কচ্ছপ এবং একটি পুরুষের মুণ্ডুবিহীন মূর্তি উল্লেখযোগ্য। পুরুষটি স্বীয় লিঙ্গ হাতে ধরে আছে। এ মন্দিরে চারটি অণ্ডকোষসমেত একটি ৬ ফুট দীর্ঘ বিরাটাকার উত্থিত লিঙ্গের প্রতিকৃতি ছিল যা বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।[১]

ইতিহাস সম্পাদনা

সুকুহ্ ১৫ শতকে মাউন্ট লায়ুর উত্তরপশ্চিম ঢালে নির্মিত মন্দিরগুলোর একটি। ঐ সময় জাভানিজ ধর্ম ও শিল্পকলা ৮ম-১০ম শতকের মন্দিরের প্রভাবশালী ভারতীয় ধারা হতে সরে আসে। ১৬ষ শতকে জাভা দ্বীপের বিচারালয় ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বে এটিই ছিল ঐ অঞ্চলের শেষ উল্লেখযোগ্য মন্দির। জাভানিজ অনুষ্ঠানাদি এবং তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের অভাবে ঐতিহাসিকগণের জন্য এই পুরাকীর্তিটির অনন্যতা ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।[২]

সুকুহ্ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা মনে করতেন মাউন্ট লায়ুর ঢালটি পূর্বপুরুষ ও প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা এবং উর্বরতা আরাধনার জন্য পবিত্র স্থান।[৩] পশ্চিম দ্বারের ক্রোনোগ্রামের লেখা থেকে জানা যায় এটি ১৪৩৭ অব্দে নির্মিত হয়েছিল অর্থাৎ এলাকাটি যখন মাজাপাহিত সাম্রাজ্যের শাসনে ছিল (১২৯৩-১৫০০)। কিছু পুরাতত্ত্ববিদ মনে করেন মন্দির প্রতিষ্ঠাতার সাথে মাজাপাহিত পরিবারের একরকমের বৈরিতা ছিল- যা রাজ্যের একটি অভ্যন্তরীণ জাতিবৈরতা চিহ্নিত করে।[৪]

১৮১১থেকে ১৮১৬ সাল পর্যন্ত জাভার শাসক থাকা স্যার থমাস র‌্যাফলস ১৮১৫ সালে মন্দিরটি পরিদর্শন করে এটিকে দুর্দশাগ্রস্ত দেখতে পান।[৫] তিনি বহু মূর্তি মাটিতে শায়িত ও ভগ্নদশায় দেখতে পান। বৃহদাকার লিঙ্গমূর্তিটি দুভাগে বিভক্ত অবস্থায় ছিল, যা পরে জোড়া দেওয়া হয়। ১৬ শতকের মুসলিম আক্রমণের ফলেই মন্দিরের এই দুরবস্থা হয়ে থাকবে বলে মনে হয়, কেননা যে কোন ইসলামিক বা একেশ্বরবাদী আক্রমণে এমনটাই দেখা যায়।

স্থাপত্যশৈলী সম্পাদনা

 
প্রবেশপথের মেঝেতে লিঙ্গ ও যোনির অনুকৃতি

কেন্দ্রীয় পিরামিডটি তিনটি ভবনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুটির পিছে অবস্থিত। প্রাথমিক অবস্থায় উপাসকগণ পশ্চিমবর্তী দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারত। দরজাটির বামপাশে একটি মানুষ ভক্ষণরত দৈত্য, গাছে বসা পাখি, কুকুর এবং ১৪৩৭ সাল (যা সম্ভবত মন্দিরের নির্মাণকাল) খোদিত আছে। প্রবেশমুখের মেঝের একটি প্রস্তরশিল্পে যৌনসঙ্গমের সুস্পষ্ট চিত্র অঙ্কিত হয়েছে যেখানে লিঙ্গ ও যোনি স্পষ্টভাবে খোদিত আছে। মন্দিরের বহু প্রতিকৃতিতেই যৌনাঙ্গসমূহ প্রদর্শিত হয়েছে, যা জাভানিজ মন্দিরগুলোর মধ্যে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। সুকুহ্ এর প্রধান কাঠামোটি অন্যান্য প্রাচীন ভবনের মত নয়, এটি সম্মুখদ্বারবিহীন মায়া স্থাপত্যের অনুরূপ পিরামিডীয় কাঠামো যা বিভিন্ন প্রস্তরখণ্ড ও কিছু সুদৃশ্য মূর্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত। হিন্দু ধর্মের আধিপত্য কমে যাওয়ার পর নির্মিত হওয়ায় এই মন্দিরে হিন্দু স্থাপত্যকলা বা বাস্তুবিদ্যা অনুসৃত হয়নি। সাধারণতক মন্দিরের আয়তাকার বা বর্গাকার গঠন থাকে, সুকুহ্ এর গঠন ট্রাপিজিয়াম আকৃতির।এর তিনটি ধাপ আছে, একটি অপরটির চেয়ে উঁচু।[৬] সামনের অংশ থেকে শীর্ষভাগ পর্যন্ত একটি পাথরের সিঁড়ি আছে। এই মন্দিরের এমন ব্যতিক্রমী গঠন কী নির্দেশ করে তা জানা যায় না। কেউ মনে করেন এটি একটি পর্বত নির্দেশ করে।

মন্দিরে কোন প্রকার কাঠের অংশ থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এর চূড়া থেকে ১.৮২ মিটার দীর্ঘ একটি লিঙ্গমূর্তি পাওয়া গেছে, যা বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। সম্ভবত এটি একসময়ে প্রস্তরসোপানে অবস্থিত ছিল। লিঙ্গমূর্তির আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত পাথরে খোদিত লিপি আছে যার ক্রোনোগ্রামের সময় ১৪৪০ সালকে নির্দেশ করে। এর শিলালিপিতে লেখা হয়েছে “পবিত্র গঙ্গার অধিষ্ঠান………… ধরিত্রীর সারাংশে পুরুষত্বের প্রতীকে।”[৩] এতে পাথরের ফলক, অষ্টশিখাযুক্ত সূর্য ও অর্ধচন্দ্র শোভিত আছে।

প্রধান কাঠামোর দেয়ালে দুজন কামার কামারশালায় অস্ত্র তৈরি করছে এবং হাতির মাথাযুক্ত দেবতা গণেশ এর নৃত্যরত চিত্র পাথরে খোদিত রয়েছে। হিন্দু-জাভা ধর্মমতে, কামার কেবল ধাতু বদলের ক্ষমতা রাখে তা নয়- তারা আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠতার দাবিদারও বটে।[৫] কামারগণ অগ্নিদেবের কাছে কিরিচ তৈরির ক্ষমতা পেয়েছেন এবং কামারশালাকে তাই পবিত্র স্থান বা তীর্থ বিবেচনা করা হয়। হিন্দু-জাভানিজ রাজক্ষমতাকে কিরিচ এর অধিকার দিয়ে অভিষিক্ত করা হত।

 
নিজের লিঙ্গ ধরে রাখা একটি মুণ্ডবিহীন মানবাকার প্রস্তরমূর্তি

গজমুণ্ডবিশিষ্ট এবং মুকুটপরিহিত দেবতা গণেশ হিন্দু ধর্মমতে সকল বাধাবিঘ্ন দূর করে থাকেন। গণেশমূর্তিটি অন্যান্য মূর্তির চেয়ে কিছুটা আলাদা। আসনের পরিবর্তে গণেশ এখানে নৃত্যরত ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান, জননাঙ্গ অনাবৃত, মুখভঙ্গি আসুরিক, উদ্ভট মুদ্রা, কণ্ঠে অস্থিমাল্য এবং হাতে একটি ক্ষুদ্র প্রাণী (সম্ভবত কুকুর) ধরে আছেন। সুকুহ্ এর গণেশমূর্তির সঙ্গে তারানাথ কর্তৃক লিখিত History of Buddhism in Tibet (তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম) তে উল্লিখিত তান্ত্রিক প্রথার সাদৃশ্য দেখা যায়।[৫] তান্ত্রিক ক্রিয়ায় বর্ণিত একজন কুকুরাজার কথা জানা যায় যিনি হলেন ‘কুকুরদের রাজা’ এবং শ্মশানে দিবারাত্রি তার শিষ্যদের গণচক্র অনুষ্ঠান শিক্ষা দিয়েছেন।

 
বামপাশে কামার এর স্থলে ভীম, মাঝখানে গণেশ এবং ডানে অর্জুন

এছাড়া সুকুহ্ মন্দিরে একটি মানবাকারপরিমিত পুরুষমূর্তি- যে নিজের লিঙ্গ ধরে আছে এবং তিনটি সমতলীয় খোলসবিশিষ্ট কচ্ছপ এর মূর্তি আছে। দুইটি বড় কচ্ছপ পিরামিডের প্রবেশদ্বারে রক্ষীর মত এবং তৃতীয়টি সম্মুখভাগ থেকে একটু দূরে স্থাপিত। সবগুলো কচ্ছপই পশ্চিমদিকে মুখ করে আছে। এদের সমতল খোলগুলো সম্ভবত পবিত্রতা আরাধনা ও পূর্বপুরুষপূজার জন্য বলির স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। [৩] হিন্দুপুরাণমতে কচ্ছপ পৃথিবীর ভিত্তিস্বরূপ এবং ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি" (পিডিএফ)। ৯ জুন ২০০৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ১৮, ২০০৭ 
  2. Miksic, John (১৯৯৭)। Oey, Eric, সম্পাদক। Java Indonesia। Singapore: Periplus। পৃষ্ঠা 223। আইএসবিএন 962-593-244-5 
  3. Ann Rasmussen Kinney, Marijke J. Klokke and Lydia Kieven (২০০৩)। Worshiping Siva and Buddha: The Temple Art of East Java। University of Hawaii Press। আইএসবিএন 0-8248-2779-1 
  4. Victor M Fic (২০০৩)। From Majapahit and Sukuh to Magawati Sukarnoputri: Continuity and change in pluralism of religion, culture and politics of Indonesia from the XV to the XXI century। New Delhi: Abhinav Publications। আইএসবিএন 81-7017-404-X 
  5. Stanley J. O'Connor (১৯৮৫)। "Metallurgy and Immortality at Caṇḍi Sukuh, Central Java"Indonesia39: 53–70। 
  6. "Candi Sukuh, Candi Unik Berbentuk Trapesium"। মার্চ ১২, ২০১২। এপ্রিল ২৪, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ৪, ২০১৬ 

টেমপ্লেট:ইন্দোনেশিয়ার হিন্দু মন্দির