সায়েবা আখতার

একুশে পদকে ভূষিত চিকিৎসক

সায়েবা আক্তার (জন্ম ১৯৫৩) একজন বাংলাদেশী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা সার্জনসের একজন নির্বাহী সদস্য এবং এর আগে বাংলাদেশের অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গাইনোকোলজি সোসাইটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা এবং গাইবান্ধায় দুটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যা সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করে।

সায়েবা আক্তার
জন্ম১৯৫৩
জাতীয়তাবাংলাদেশি
পরিচিতির কারণচিকিৎসক
পুরস্কারএকুশে পদক (২০২০)

তিনি ‘সায়েবা'স মেথড’ (সায়েবার পদ্ধতি) নামে ‘অত্যন্ত অল্প খরচে প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায়’ (ইউবিটি) সম্পর্কিত একটি বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যা মাতৃমৃত্যুহার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে।[১]

প্রাথমিক ও শিক্ষা জীবন সম্পাদনা

সায়েবা ১৯৫৩ সালে চট্টগ্রামে এম এ মালেক ও মাহমুদা খাতুনের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বলেছিলেন যে চিকিৎসা প্রশিক্ষণ চলাকালীন তিনি যে ডাক্তারদের যেসব চিকিৎসকদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তাদের কাছ থেকেই তিনি যুবতী মায়েদের সহায়তা করার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। [২][৩][৪]

গবেষণা ও কর্মজীবন সম্পাদনা

সায়েবা ২০০০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান হিসাবে কর্মরত থাকাবস্থায় তিনি ‘অত্যন্ত অল্প খরচে প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায়’ (ইউবিটি) সম্পর্কিত একটি বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেন এবং সফল হন।[৫][৬][৭] তিনি যখন ইউবিটি তৈরি করেছিলেন, তখন বাংলাদেশে প্রায় ৪০% মাতৃমৃত্যু প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণের কারণে ঘটতো।[৮] রক্তক্ষরণ রোধে তার এই বিকল্প পদ্ধতিটির মূল্য ৫০০ টাকারও কম। ২০০৩ সালের পর থেকে এই পদ্ধতির উপর তার গবেষণা পত্রটি বিশ্বের বিভিন্ন মেডিকেল সাময়িকীতে স্থান পায়। ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ জার্নাল অব অবসটেট্রিকস অ্যান্ড গাইনোকোলজিতে তার গবেষণাটিকে ‘সায়েবা'স মেথড’ (সায়েবার পদ্ধতি) নামে উল্লেখ করে, এর উপর একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১১ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব অবসটেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্ট থেকে তার উদ্ভাবনের জন্য সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন।[৫]

সায়েবা'স মেথড অনুসারে, প্রসূতির জরায়ুতে ক্যাথেটার দিয়ে বেলুনের মাধ্যমে বাতাস প্রবাহিত করে সাধারণত রক্ত বন্ধ করা যায়। তার উদ্ভাবিত এই বিকল্প পদ্ধতি বেশ কিছু দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে।[৫] বিশ্বব্যাপী নারীদের স্বাস্থ্যের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে ও মাতৃমৃত্যহার কমাতে সহায্য করেছে। এই পদ্ধতিটি সায়েবার পদ্ধতি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির চিকিৎসক এবং মিডওয়াইফদের (সেবিকা) শেখানো হয়েছে।[৯][১০]

বাংলাদেশে প্রসূতি ফিস্টুলা সাধারণত শারীরিকভাবে শিশুর জন্মের জন্য প্রস্তুত নয় এমন কিশোরী নারীদের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। শারীরিকভাবে অপ্রস্তুত হওয়ার পাশাপাশি কিশোরী নারীরা সাহায্যের জন্য জিজ্ঞাসা করার সময় সামাজিক কলঙ্কে ভোগেন। এছাড়া এ বিষয়টি পরিচালনা করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।[১১] ২০০৫ সালে সায়েবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একটি জাতীয় কেন্দ্র চালু করেন যেখানে তিনি ফিস্টুলা চিকিৎসা করতে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেন। তিনি ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা ফিস্টুলা হাসপাতালে গবেষণা করে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের সহযোগিতায় ‘ইন্ড ফিস্টুলা‘ (ফিস্টুলা রোগের পরিসমাপ্তি) ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। প্রোগ্রামটি এক মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং এটি ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক থেকে অর্থায়ন পেয়েছিলো।[১২] ২০০৫ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে কেন্দ্রটি প্রায় চার শতাধিক রোগীর চিকিৎসা করেছিল এবং একইসাথে এখানে রোগীদের স্বাধীনভাবে আয়ের জন্য বিভিন্ন উত্পাদনমূলক কর্মকাণ্ড শেখানো হয়েছিলো যাতে তারা হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার পরে স্বাধীনভাবে চলতে পারেন। ২০১২ সালে সায়েবার মাধ্যমে এমএএমএমের ফিস্টুলা এবং মহিলা স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (এমএফডব্লুওএইচ), আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[১৩][১৪]

২০০৮ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রসূতি ও গাইনোকোলজি সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন।[১৫] তিনি তখন থেকেই আন্তর্জাতিক স্ত্রীরোগ ও প্রসেসট্রিক্স ফেডারেশনের (এফআইজিও) সাথে জড়িত ছিলেন, যৌনাঙ্গে ট্রমা কমিটিতে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা একসাথে ফিস্টুলা সার্জারি প্রশিক্ষণ উদ্যোগ এবং বৈশ্বিক সক্ষমতা ভিত্তিক ফিস্টুলা সার্জারি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল তৈরি করে।  বাংলাদেশের চিকিৎসক ও সার্জনদের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আখতার বাংলাদেশে স্ত্রীরোগ প্রবণতা হ্রাস করতে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করেছেন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার বিয়ের আইনি বয়স বাড়িয়ে ১৮ করে। ২০১২ সালে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, সায়েবা এবং এফআইজি যৌথভাবে আফ্রিকা ও এশিয়ায় ৫০ জনেরও বেশি সার্জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো যারা ৭ হাজার ৫শ’র বেশি এ ধরনের চিকিৎসা কার্যক্রমে অংশ নেন।[১৬][১৭][১৮]

সম্প্রতি সায়েবা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে কাজ করেছেন।[১৯] রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েদের স্বাস্থ্যবিধি, পরিবার পরিকল্পনা এবং মাতৃস্বাস্থ্যের বিষয়ে অসচেতনতা ও সীমিত প্রবেশাধিকার রয়েছে।[১৯]

পুরস্কার ও সম্মাননা সম্পাদনা

সায়েবা অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার (২০১৮), মহিলা সুপার অ্যাচিভার অ্যাওয়ার্ড, মাদার তেরেসা পুরস্কার এবং লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার এবং সম্মান অর্জন করেছেন। তিনি রয়েল কলেজ অব অবেস্টেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস, ভারতে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কলেজ, পাকিস্তানের চিকিৎসক ও সার্জন কলেজ এবং ইন্ডিয়ান অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গাইনোকোলজির সম্মানিত ফেলো। চিকিৎসায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক প্রদান করে ।[২০][২১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "একুশে পদক পাচ্ছেন কিংবদন্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. সায়েবা"যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ 
  2. News; Consulting, Bravemarshal। "International Society of Obstetric Fistula Surgeons"ISOFS (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  3. "Ending obstetric fistula"FIGO। ২০১৯-১০-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  4. "Bangladesh: Fistula Surgery Camp Offers Treatment And Training"FORWARD (ইংরেজি ভাষায়)। ২০০৮-০৬-২৫। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  5. "প্রসূতি মৃত্যু বন্ধে বাংলাদেশি ডাক্তারের অভিনব পদ্ধতি"বিবিসি বাংলা। ১০ আগস্ট ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ 
  6. Vanderbilt, Tom (২০১৯-০২-০৪)। ""Reverse Innovation" Could Save Lives. Why Aren't We Embracing It?" (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 0028-792X। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  7. "কেনিয়া নয়, প্রসূতির রক্তপাত বন্ধের পদ্ধতির আবিষ্কারক বাংলাদেশ | banglatribune.com"বাংলা ট্রিবিউন। ২০১৯-১০-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  8. Akhter, Sayeba; Begum, Mosammat Rashida; Kabir, Zakia; Rashid, Maliha; Laila, Tarafder Runa; Zabeen, Fahmida (২০০৩-০৯-১১)। "Use of a condom to control massive postpartum hemorrhage"। MedGenMed: Medscape General Medicine5 (3): 38। আইএসএসএন 1531-0132পিএমআইডি 14600674 
  9. Jabbar, Abdul। "Modern method can reduce maternal mortality | Bangladesh Sangbad Sangstha (BSS)" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  10. Nation, The New। "The Adventures of Supergirls Vol. 2 and Her Stories App launched at DLF"The New Nation (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৯-১০-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  11. "Fistula Afflicts Child Brides in Bangladesh"BenarNews (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  12. "Vesicovaginal fistulae in Bangladesh"Royal College of Obstetricians & Gynaecologists (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৯-১০-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  13. "Fistula Repair Facility Brings Hope to the Outcast"www.unfpa.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  14. "MAMM's Institute of Fistula and Women's Health"www.mifwoh.org। ২০১৮-০১-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  15. "FIGO Constituent Societies May 2010"। International Journal of Gynecology & Obstetrics (ইংরেজি ভাষায়)। 109 (2): 171–179। ২০১০। আইএসএসএন 1879-3479ডিওআই:10.1016/j.ijgo.2010.03.002 
  16. "PMNCH | Obstetrical and Gynaecological Society of Bangladesh"WHO। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  17. "More surgeons for a fistula-free world"FIGO। ২০১৯-১০-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  18. Method of Bangladeshi physian Sayeba is saving hundreds of thousands lives throughout the world (ইংরেজি ভাষায়), সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  19. "Dressing wounds and restoring dignity"FIGO। ২০১৯-১০-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  20. "Sayeba Akhter"FIGO 2018 | World Congress of Gynecology and Obstetrics (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৮-০৫-২১। ২০১৯-১০-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০৬ 
  21. "20 individuals, one organisation to receive Ekushey Padak 2020"The Daily Star (ইংরেজি ভাষায়)। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা