সাপলুডু, সাপ সিঁড়ি বা মোক্ষপথম হলো প্রাচীন ভারতীয় ছকের খেলা, যা দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে খেলতে হয়। এটিকে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ক্লাসিক খেলা হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি সংখ্যাযুক্ত ও দাগকাটা খেলার ছকে খেলতে হয়। ছকে বেশকিছু “সাপ” ও “মই” বা “সিঁড়ি” দেখা যায়, যা দুইটি আলাদা ঘরকে যুক্ত করে। খেলার মূল লক্ষ্য হলো ছক্কা ঘুরিয়ে প্রাপ্ত সংখ্যানুসারে ঘুঁটিকে পরিচালনা করে সর্বাগ্রে ছকের শুরু (নিচের ঘর) থেকে শেষ (উপরের ঘর) পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে মই বা সিঁড়ি দ্রুত উপরে উঠতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে; পক্ষান্তরে সাপ ঘুঁটিকে নিচে নামিয়ে অগ্রগমনকে বিঘ্নিত করে।

সাপলুডু
সাপ সিঁড়ি
সাপলুডু খেলা, কাপড়ে গুয়াশের কাজ, ভারত, ১৯শ শতক
কার্যকালপ্রাচীন ভারত ২য় শতক থেকে বর্তমান
ধরণছক (বোর্ড)
প্রতিদ্বন্দ্বিতা
ছক্কা
বয়সসীমা৫+
ঘুঁটি সাজানোর সময়কালউপেক্ষণীয়
খেলার সময়১৫–৪৫ মিনিট
দৈবসুযোগসম্পূর্ণ
প্রয়োজনীয় দক্ষতাগণনা, পর্যবেক্ষণ

সাপলুডু নিছক ভাগ্যের খেলা। এটি তরুণ ও যুবকদের বেশ জনপ্রিয়।[১] ঐতিহাসিকভাবে খেলাটির সাথে নৈতিকতা শিক্ষাদানের বিষয়টি জড়িত ছিল। ছকে একটি ঘুঁটির অগ্রগমনকে পাপ (সাপ) ও পুণ্যময় (মই বা সিঁড়ি) জীবনের জটিল প্রবাহের সাথে তুলনা করা হতো। আধুনিককালে খেলাটিকে বিভিন্ন নামে বাজারজাত করা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্ন্যাক্স অ্যান্ড ল্যাডার্স, শ্যুটস অ্যান্ড ল্যাডার্স, বাইবেল আপস অ্যান্ড ডাউনস ইত্যাদি; এর মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।[২] যেমন: ১৯৪৩ সাল থেকে মিল্টন ব্র‍্যাডলি কোম্পানি থেকে প্রকাশিত শ্যুটস অ্যান্ড ল্যাডার্স খেলায় নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হয়।

উপকরণ সম্পাদনা

 
সাপলুডু খেলার উপকরণ

খেলার ছকের আকার ব্যবহারভেদে বিভিন্ন হতে দেখা যায়। এর মধ্যে ৮×৮, ১০×১০ এবং ১২×১২ আকারের ছকই সবচেয়ে বেশি লভ্য। ছকে বেশ কিছু ঘরে সাপ ও মই বা সিঁড়ি থাকে, যা এক ঘর থেকে শুরু হয়ে অন্য ঘরে শেষ হয়। সাপ ও সিঁড়ির উপস্থিতি খেলার ব্যাপ্তিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ছকে প্রতিটি খেলোয়াড়ের পক্ষে একটিমাত্র ঘুঁটি থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে সাধারণত একটিমাত্র ছক্কা বা ডাইস গড়িয়ে খেলোয়াড়ের গতিবিধি নির্ধারণ করা হয়; তবে খেলার ব্যাপ্তি কমিয়ে আনতে একাধিক ছক্কা বা ডাইসও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

ইতিহাস সম্পাদনা

সাপলুডু জ্ঞান চৌপড়পচিশী (লুডুপরচিসি নামের পরিচিত) প্রভৃতি অন্যান্য ছক্কা ঘুরানোর খেলার মতোই ভারতীয় উপমহাদেশে উৎপন্ন হয়। ভারত থেকে খেলাটি ইংল্যান্ডে গিয়ে “স্ন্যাকস অ্যান্ড ল্যাডার্স” নামধারণ করে।[৩] পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালে মিল্টন ব্র‍্যাডলি কোম্পানি খেলাটিকে শ্যুটস অ্যান্ড ল্যাডার্স (“ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় অন্তর্দ্বার-ক্রীড়ার [ইনডোর স্পোর্ট] উন্নত নতুন সংস্করণ”[৪]) নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাজারজাত করে।[৫]

 
জ্ঞান চৌপড় (খেলার জৈন সংস্করণ), জাতীয় সংগ্রহালয়, নতুন দিল্লি

সাপলুডুর জৈন ধর্মীয় সংস্করণ জ্ঞান চৌপড় জৈন দর্শনের বিবিধ বিষয়, যেমন কর্মমোক্ষ ইত্যাদি বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল।[৬]

প্রাচীন ভারতে খেলাটি মোক্ষপথম নামে জনপ্রিয় ছিল। প্রথাগত হিন্দু দর্শনের কর্মকাম বা নিয়তিআকাঙ্ক্ষা-র পার্থক্য এই খেলার মূল উপলব্ধি ছিল। এই সংস্করণে নিয়তির প্রাধান্য ছিল। বিপরীতভাবে, পচিশী নামক সংস্করণে জীবনকে দক্ষতা ও ভাগ্যের সম্মিলিত রূপ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো।[৭] এই খেলার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য থেকে ১৮৯২ সালে ভিক্টোরীয় যুগে ইংল্যান্ডে সাপলুডুর অনুরূপ একটি সংস্করণ প্রচলিত হয়। এছাড়াও, এক সময় শুভকর্ম ও অপকর্মের পরিণামের শিক্ষাদানকারী হিসেবেও এই খেলাটিকে ব্যবহার করা হয়। খেলার ছকের ঘরগুলোতে নানা প্রতীকায়িত চিত্র অঙ্কিত ছিল। এর উপরের দিকে ঈশ্বর, দেবদূত এবং স্বার্গিক বস্তু এবং নিচের দিকে প্রাণী, ফুল ও মানুষের চিত্র অঙ্কিত ছিল।[৮] খেলার মই বা সিঁড়ি বিভিন্ন সদগুণাবলি, বিশেষত ঔদার্য, আস্থা ও বিনয় প্রভৃতি এবং সাপ অসদগুণাবলি, যেমন কামনা, ক্রোধ, হত্যা ও চৌর্যবৃত্তি প্রভৃতি প্রতীকায়িত করতো। ব্যক্তি ভালো কাজের মাধ্যমে মোক্ষ লাভ করে এবং খারাপ কাজের পরিণামস্বরূপ সমাজের নিচুস্তরে পুনর্জন্ম লাভ করে— এই শিক্ষাদানই ছিল এই খেলার মূল উদ্দেশ্য। খেলায় সিঁড়ির চেয়ে সাপের সংখ্যা বেশি থাকত, যা খেলোয়াড়দের স্মরণ করিয়ে দিত যে, অধর্মের পথ ছেড়ে ধর্মের পথে চলা অনেক বেশি কঠিন। সম্ভবত, সর্বশেষ ঘরে (১০০তম ঘর) পৌঁছার অর্থ ছিল মোক্ষলাভ বা আত্মিক মুক্তি।

ভারত থেকে ইংল্যান্ডে পৌঁছার পর সাপলুডুর ভারতীয় মূল্যবোধের স্থলে ইংরেজ মূল্যবোধ স্থান করে নেয়। ধারণা করা হয়েছিল যে, এতে ভিক্টোরীয় যুগের নীতিতত্ত্বের ভালো প্রতিফলন ঘটবে। পাশ্চাত্যের এই সংস্করণে মিতব্যয়িতা, অধ্যবসায় ও শ্রমশীলতার মই দিয়ে সিদ্ধি (পরিপূর্ণতা), অনুগ্রহ ও সফলতা লাভ করা যেত; পক্ষান্তরে সাপরূপী অসংযম, অবাধ্যতা ও শ্রমবিমুখতার ফলে লাভ করত অসুস্থতা, মর্যাদাহানী ও দারিদ্র‍্য। সাপলুডুর ভারতীয় সংস্করণে মইয়ের চেয়ে সাপের সংখ্যা বেশি থাকলেও, ইংরেজ সংস্করণে কিছুটা ছাড় দিয়ে উভয়ের সংখ্যা সমান রাখা হতো।[৯] পাপ-পুণ্যের এই সাম্যের ধারণায় ইংল্যান্ডের এই সাংস্কৃতিক আদর্শ প্রতিফলিত হয় যে, প্রতিটি পাপের বিনিময়ে প্রায়শ্চিত্তের অপর একটি সুযোগ উন্মোচিত হয়।

তৎকালীন ব্রিটেনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ভারত থেকে ঔপনিবেশিক ব্যক্তিরা স্বদেশে ফেরার সাথে সাথে ব্রিটেনের স্ন্যাকস অ্যান্ড ল্যাডার্স এবং ভারত ও জ্ঞান চৌপড়-এর সংযোগ সাধিত হতে থাকে। ২০শ শতকের ব্রিটেনে সাপলুডুর ছকের নকশা ও সজ্জায় সেই সংযোগেরই প্রতিফলন দেখা যায়। ৪০-এর দশক নাগাদ যুদ্ধ এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পতনের মধ্যে অর্থনৈতিক কারণে সাপলুডুর ছক থেকে ভারতীয় চিত্রকলা ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি প্রায় মুছে যেতে থাকে।[১০] সাপলুডুর নৈতিক শিক্ষা প্রজন্মের সাথে সাথে বাহিত হয়েছে; এর বাহ্যিক কাঠামো থেকে শুরু করে ধর্মীয় ও দার্শনিক মতাদর্শ এখনও বাহিত হলেও, তা বর্তমানে অতি ক্ষীণ। ভারতের পাল-সেন শাসনামলে সাপলুডুর সম্ভাব্য বৌদ্ধধর্মীয় সংস্করণ ছিল বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়।

ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে তেলুগু ভাষায় খেলাটি বৈকুণ্ঠপলি বা পরমপদ সোপান পথম নামে জনপ্রিয়।[৫][১০] হিন্দিতে খেলাটি সাপ ঔর সিঁড়ি, সাপ সিঁড়ি বা মোক্ষপত নামে পরিচিত। তামিলনাড়ুতে সাপলুডু পরমপদম নামে পরিচিত। তামিলনাড়ুতে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর ভক্তরা বৈকুণ্ঠ একাশীতে রাত জেগে এই খেলাটি খেলে। বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গে এটি যথাক্রমে সাপলুডুসাপসিঁড়ি নামে পরিচিত।[১১]

মূল খেলায় সদগুণের ঘরগুলো হলো: আস্থা (১২), বিশ্বস্ততা (৫১), ঔদার্য (৫৭), জ্ঞান (৭৬) এবং তপস্যা (৭৮)। পক্ষান্তরে অসদগুণের ঘরগুলো হলো: অবাধ্যতা (৪১), অহমিকা (৪৪), অভদ্রতা (৪৯), চৌর্যবৃত্তি (৫২), মিথ্যাবাদিতা (৫৮), মদ্যপান (৬২), ঋণগ্রস্ততা (৬৯), হত্যা (৭৩), ক্রোধ (৮৪), লোভ (৯২), অহঙ্কার (৯৫) এবং কামনা (৯৯)।[৮]

খেলার নিয়ম সম্পাদনা

 
মিল্টন ব্র‍্যাডলি কোম্পানির শ্যুটস অ্যান্ড ল্যাডার্স খেলার ছক, আনু. ১৯৫২। এর নকশায় ভালো কর্ম ও এর ফল এবং খারাপ কর্ম ও এর পরিণাম প্রদর্শিত হয়েছে।

প্রতি খেলোয়াড় একটি ঘুঁটি নিয়ে ছকের একটি ঘর থেকে (সাধারণ “১” নির্দেশিত ঘর অথবা “১” নির্দেশিত ঘরের পূর্ব ঘর) খেলা আরম্ভ করে। একটি চালে খেলোয়াড়েরা একটি ছক্কা নিক্ষেপ করে, তাতে নির্দেশিত সংখ্যা অনুযায়ী ঘুঁটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলে। ঘুঁটিগুলো ছকের নিচ থেকে উপরের দিকে নির্দেশিত একটি নির্দিষ্ট পথ (সাধারণত বুস্ট্রফেডন পদ্ধতিতে) ধরে প্রতিটি ঘর অন্তত একবার অতিক্রম করে এগিয়ে চলে। চালের শেষে ঘুঁটিটি যদি “মই” বা “সিঁড়ি”-এর নিচের অংশ চিহ্নিত কোনো ঘরে এসে থামে, তাহলে ঘুঁটিটি মই বেয়ে অপর প্রান্তের ঘরে (উপরে) পৌঁছে যায়। পক্ষান্তরে, কোনো ঘুঁটি “সাপ”-এর মুখ চিহ্নিত ঘরে এসে থামলে, ঘুঁটি সাপের লেজ চিহ্নিত ঘরে (নিচের দিকে) নেমে যায়।

ছক্কায় যদি সংখ্যাটি ওঠে, তাহলে খেলোয়াড় প্রথম চালের পর দ্বিতীয় আরেকটি চালের সুযোগ পায়; অন্যথায় খেলা খেলোয়াড় থেকে খেলোয়াড়ে চলতে থাকে। যেই খেলোয়াড় সর্বাগ্রে ছকের সর্বশেষ ঘরে পৌঁছাবে, সেই হবে খেলার বিজয়ী।

নিয়মে মতভেদ সম্পাদনা

খেলা কীভাবে শেষ হবে, জিততে যত প্রয়োজন তত উঠিয়েই খেলা শেষ করতে হবে কিনা, তা নিয়ে বেশ কিছু মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো খেলায় শেষ ঘরে যেতে যত প্রয়োজন, ছক্কায় তত তুলে তবেই শেষ ঘরে যেতে হয়। এছাড়াও, ছক্কায় প্রয়োজনীয় সংখ্যার চেয়ে বেশি উঠলে কী করা হবে, তারও রকমফের রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ঘুঁটি তার অবস্থানে স্থির থাকে। আরেকটি ক্ষেত্রে ঘুঁটি সর্বশেষ ঘরে গিয়ে পেছনের দিকে ফিরে আসে। (যেমন: খেলায় জিততে লাগলে এবং ছক্কায় উঠলে, ঘুঁটি তিন ঘর এগিয়ে গিয়ে আবার দুই ঘর পিছিয়ে আসবে।) এভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে খেলোয়াড় তার পূর্বের অবস্থান থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়েও যেতে পারে। (যেমন: খেলা জিততে দরকার হলে এবং ছক্কায় আসলে, খেলোয়াড় তার পূর্বের অবস্থান থেকে পিছিয়ে যায়।)

উইনিং ওয়েস ফর ইয়োর ম্যাথমেটিক্যাল প্লেস বইয়ের লেখকেরা একটি ভিন্ন রূপভেদের প্রস্তাব করেন (যাকে তারা অ্যাডার্স-অ্যান্ড-ল্যাডার্স নামে অভিহিত করেন), যেখানে ভাগ্যের পরিবর্তে দক্ষতা দিয়ে খেলায় জিততে হবে। তারা এখানে প্রতি খেলোয়াড়ের জন্য আলাদা ঘুঁটির পরিবর্তে, সকলের জন্য অপৃথকযোগ্য ঘুঁটির একটি ভাণ্ডারের প্রস্তাব করে। এরূপ খেলায় পাঁচটি ঘুঁটি এবং একটি ৫×৫ আকারের ছক থাকবে। এক্ষেত্রে নিক্ষেপ করার মতো কোনো ছক্কা থাকবে না। খেলোয়াড়রাই যেকোনো ঘুঁটি নিয়ে এক থেকে চার ঘর পর্যন্ত চালবে। যে ঘুঁটি সবার শেষে “হোম” নামের ঘরে (ছকের সর্বশেষ ঘর) পৌঁছাবে, সে-ই খেলায় জয়ী হবে।[১২]

বিশেষ সংস্করণ সম্পাদনা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাপলুডুর সবচেয়ে প্রচলিত সংস্করণ হলো ১৯৪৩ সালে মিল্টন ব্র‍্যাডলি কোম্পানি কর্তৃক প্রকাশিত শ্যুটস অ্যান্ড ল্যাডার্স[১৩] ছকের সাপ সেসময়কার শিশুদের অপছন্দের হওয়ায় ছক থেকে সাপকে বাদ দেওয়া হয়।[১৩] এটি ১০×১০ আকারের ছকে খেলা হয় এবং ছক্কার বদলে স্পিনার ঘুরিয়ে ঘুঁটি এগিয়ে নিতে হয়। এর ছকের নকশা অনেকটা খেলার মাঠের আদলে তৈরি এবং সাপের বদলে স্লাইডের মতো শ্যুটস ব্যবহার করা হয়।

ছকের নকশায় শিশুদের নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার জন্য ছবি আঁকা থাকে। মইয়ের নিচের ঘরে আঁকা হয় একটি শিশু ভালো কাজ করছে এবং মইয়ের অন্য প্রান্তে থাকে তার জন্য পুরস্কার। অপরদিকে শ্যুটস-এর উপরের অংশে থাকে একটি শিশু খারাপ কাজ করছে আর নিচের দিকে থাকে আঁকা থাকে তার খারাপ পরিণামের চিত্র।

মিল্টন ব্র‍্যাডলি কোম্পানি ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো সাপলুডুর ছকে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের ছবি আঁকে।[১৩] এছাড়া পপ সংস্কৃতির সাথে মানানসই করে সাপলুডুর বেশ কিছু সংস্করণ বের করা হয়েছে, যাতে শিশুতোষ নানান চরিত্র, যেমন ডোরা দি এক্সপ্লোরার এবং সিসেমি স্ট্রিট কার্টুনের চরিত্র আঁকা হয়েছে। এগুলো “দ্য ক্লাসিক আপ অ্যান্ড ডাউন গেম ফর প্রিস্কুলার্স” নামে বাজারজাত করা হয়। ১৯৯৯ সালে হ্যাসব্রো ব্যক্তিগত কম্পিউটারের জন্য সাপলুডুর একটি সংস্করণ প্রকাশ করে।

কানাডায় ঐতিহাসিকভাবে খেলাটি “স্ন্যাক্স অ্যান্ড ল্যাডার্স” নামে বিক্রয় করা হয়ে আসছে। কানাডা গেমস কোম্পানি সে দেশে এই খেলাটি বাজারজাত করে থাকে। এছাড়া কানাডার জন্য বিশেষায়িত বেশ কিছু সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে। এদের একটিতে সাপের বদলে টোবোগান ব্যবহৃত হয়েছে।[১৪]

ব্রিটেনের একটি পুরনো সংস্করণে দেখা যায়, একজন বালক ও বালিকা কার্টুন রেলপথে ট্রেনের মাধ্যমে এগিয়ে চলে।[১৪] ১৯৯০ এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রচারণার জন্য ডিমের বাক্সের নিচে কার্ডবোর্ডের তৈরি শ্যুটস অ্যান্ড ল্যাডার্স-এর ছক সেঁটে দেওয়া হতো।[১৫]

সাপলুডুর মূল সংস্করণের পাপ-পুণ্য ও প্রাচ্যের আধ্যাত্মবাদ পাশ্চাত্যের আধুনিক সাপলুডুতে প্রতিফলিত হয়নি। তবুও এর মূল কাঠামো শিশুদের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষাদানের জন্য অনেক কার্যকরী। ইন্দোনেশিয়ার দুইটি ভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সাপলুডুর একটি বিশেষ সংস্করণ অন্তর্ভুক্ত করার পর দেখা যায় এটি শিশুদের শব্দভাণ্ডারই শুধু সমৃদ্ধ করছে না, পাশাপাশি শিক্ষার বিষয়ে তাদের আগ্রহ ও উৎসাহও বৃদ্ধি পেয়েছে।[১৬][১৭] কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা গবেষণার মাধ্যমে দেখান যে, নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসা শিশুরা, যারা অন্তত এক ঘণ্টা সাপলুডুর মতো গণনার খেলা খেললে, তারা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শিশুদের তুলনায় হিসাব-নিকাশে অধিক পারদর্শিতা প্রদর্শন করে।[১৮] জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই পরিবেশ সম্পর্কে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে পরিবেশকে উপজীব্য করে নির্মিত সাপলুডুর আরেকটি ভিন্ন সংস্করণ ব্যবহৃত হয়েছিল।[১৯]

২০২০ সালে বিজ্ঞানী মায়ার ও তার সঙ্গীরা মুক্ত ও অভিযোজনশীল ক্রীড়া প্রকল্পের আওতায় শ্যুটস অ্যান্ড ল্যাডার্স-এর ভিত্তি নিয়ে গবেষণা করেন।[২০][২১][২২] তাদের মতে, একদম শুরু থেকে খেলোয়াড় এবং শিক্ষকেরাই সাপলুডুকে তৈরি করেছে এবং এর নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছে। মনজা প্রকল্পের আরেকটি দিক হলো গাণিতিকীকরণ। বছরের পর বছর ধরে এই খেলার অভিজ্ঞতাকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গাণিতিক দক্ষতায় রূপান্তরিত করে।

গাণিতিক উপস্থাপন সম্পাদনা

 
প্রতি চাল N এর বিপরীতে সাপলুডু খেলা সমাপ্তির সামগ্রিক সম্ভাবনা

সাপলুডুর যেকোনো সংস্করণকে মার্কভের শোষণ শৃঙ্খল দ্বারা বর্ণনা করা যায়। কেননা, এক ঘর থেকে ঘুঁটির অন্য ঘরে যাওয়ার পথ নির্ধারিত এবং পূর্ববর্তী খেলার থেকে স্বতন্ত্র।[৪] মিল্টন ব্র‍্যাডলি কোম্পানির শ্যুটস অ্যান্ড ল্যাডার্স-এর ছকে ১৯টি স্লাইড-সদৃশ চুট এবং মই রয়েছে। খেলার শুরু থেকে ১০০ ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে একজন খেলোয়াড়ের গড়ে ৩৯.২ বার চালতে হয়। দুইজনে খেললে গড়ে ৪৭.৭৬ চালে খেলাটি শেষ হয়, যেখানে প্রথমে চালা খেলোয়াড়ের জেতার সম্ভাবনা ৫০.৯%।[২৩] এই সমস্ত সম্ভাবনার হিসাবের ক্ষেত্রে শর্ত হিসেবে নেওয়া হয়েছিল যে, একজন খেলোয়াড় ছক্কায় তুললে অতিরিক্ত একবার ছক্কা চালার সুযোগ পাবে এবং ১০০ ঘরে যেতে যত প্রয়োজন, ঠিক তত তুলেই জিততে হবে কিন্তু বেশি পেলেও ঘুঁটি তার ঘর থেকে নড়বে না।

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে সম্পাদনা

  • ইংরেজি ভাষায় “ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান” (Back to square one) বাগধারাটি সাপলুডু খেলার থেকে উৎপত্তি হয়েছে, কিংবা অন্তত এই খেলার থেকে প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে। এই বাগধারার সর্বপ্রথম উদ্ধৃতিতে সাপলুডুর উল্লেখ পাওয়া যায়: “Withal he has the problem of maintaining the interest of the reader who is always being sent back to square one in a sort of intellectual game of snakes and ladders.”[২৪][২৫]
  • সাপলুডু খেলাটি ব্রিটিশ-ভারতীয় লেখক সালমান রুশদির উপন্যাস মিডনাইট'স চিলড্রেন-এর মূল রূপক।[২৬]
  • “সেইলর মাউথ” নামে স্পঞ্জবব স্কোয়্যারপ্যান্টস কার্টুনের একটি পর্বে সাপলুডুর অনুরূপ “ইলস অ্যানড এস্কেলেটর্স” নামের খেলা দেখা যায়।
  • কানাডায় স্ন্যাক্স অ্যান্ড ল্যাটস নামে একটি বোর্ডগেম ক্যাফে চেইন রয়েছে, যাদের প্রধান কার্যালয় টরন্টো শহরে অবস্থিত।[২৭]
  • কানাডীয় টেলিভিশন সিরিজ অ্যাবি হ্যাচার-এর একটি পর্ব গেম টাইম উইথ মো অ্যান্ড বো-তে দেখা যায়, মো এবং বো একটি হোটেলে কম্পিউটার ট্যাবলেটে সাপলুডু খেলে। খেলতে খেলতে তারা হোটেলময় ঘুরে বেড়ায় এবং তাদের অজান্তে হোটেলে নানান সমস্যার সৃষ্টি করে। এরপর অ্যাবির নির্দেশনা অনুসারে তারা তাদের শরীরকে সাপ ও মই কল্পনা করে হোটেলের সদস্যদের সাহায্য করে।[২৮]
  • অস্ট্রেলীয় রক ব্যান্ড এসি/ডিসির একটি গান, সিন সিটিতে সাপলুডুর উল্লেখ পাওয়া যায়।
  • ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত জনি মিশেলের অ্যালবাম “চক মার্ক ইন অ্যা রেইন স্টর্ম”-এর অষ্টম ট্র‍্যাকের শিরোনাম ছিল “স্ন্যাক্স অ্যান্ড ল্যাডার্স”।
  • ১৯৫৮ সালের ভৌতিক চলচ্চিত্র নাইট অব দ্য ডেমন-এ দেখা যায়, খলনায়ক কার্সওয়েল একটি হ্যালোউইন পার্টির আয়োজন করছে, যেখানে নায়কও উপস্থিত থাকে। তারা দুইজন নারীর সংস্পর্শে আসে, যারা সাপলুডু খেলছিল। কার্সওয়েল খেলাটির ব্যাখ্যা দেয়। সে আরও বলে যে, সে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার চেয়ে সাপ হয়ে নিচে নামা বেশি পছন্দ করে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Pritchard, D. B. (১৯৯৪), "Snakes and Ladders", The Family Book of Games, Brockhampton Press, পৃষ্ঠা 162, আইএসবিএন 1-86019-021-9 
  2. "Chutes and Ladders"boardgamegeek। সংগ্রহের তারিখ ১ জুন ২০২০ 
  3. Coopee, Todd। "Chutes and Ladders from Milton Bradley (1943)"ToyTales.ca 
  4. Althoen, S. C.; King, L.; Schilling, K. (মার্চ ১৯৯৩)। "How Long Is a Game of Snakes and Ladders?"The Mathematical Gazette। The Mathematical Association। 77 (478): 71–76। জেস্টোর 3619261ডিওআই:10.2307/3619261 
  5. Augustyn (2004), pp. 27–28
  6. Bornet, Philippe; Burger, Maya (২০১২)। Religions in Play: Games, Rituals, and Virtual Worlds। Theologischer Verlag Zürich। পৃষ্ঠা 94। আইএসবিএন 9783290220105 
  7. "Playing with fate and free will"। Devdutt Pattanaik। সেপ্টেম্বর ১৭, ২০০৭। ডিসেম্বর ২, ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ২৮, ২০১৮ 
  8. Bell, R. C. (১৯৮৩)। "Snakes and Ladders"। The Boardgame Book। Exeter Books। পৃষ্ঠা 134–35। আইএসবিএন 0-671-06030-9 
  9. Masters, James. "Moksha-Patamu (Snakes and Ladders)." The Online Guide to Traditional Games. N.p., n.d. Web.
  10. Topsfield, Andrew (২০০৬)। The art of play. Board and card games of India। Marg Publications। আইএসবিএন 9788185026763 
  11. Alimuzzaman (৬ মে ২০২০)। "সাপলুডুর মক্সা বোর্ড"Kishore Alo। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুন ২০২১ 
  12. "BoardGameGeek"boardgamegeek.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-২৪ 
  13. Slesin, Suzanne. At 50, Still Climbing, Still Sliding New York Times 15 July 1993
  14. "Snakes and Ladders"। Elliott Avedon Museum & Archive of Games। ২০০৮-০২-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  15. Hinebaugh, Jeffrey P. (২০০৯)। A Board Game Education। R&L Education। পৃষ্ঠা 35আইএসবিএন 9781607092612 
  16. Sari, Candrika Citra, and Siti Muniroh. "Developing snake and ladder game board as a media to teach english vocabulary to elementary school students". SKRIPSI Jurusan Sastra Inggris-Fakultas Sastra UM (2012). Web.
  17. Yuliana, Ita. "The Implementation of Snakes And Ladders Game to Improve Students' Vocabulary Among the Fifth Grade Students of SD N Bapangsari in the Academic Year 2012/2013." SCRIPTA – Pendidikan Bahasa Inggris 1.2 (2013). Web.
  18. Siegler, Robert S., and Geetha B. Ramani. "Playing Linear Numerical Board Games Promotes Low-income Children’s Numerical Development." Developmental Science 11.5 (2008): 655-61. Web.
  19. Morrison, Sarah. "Battling climate-change: How snakes and ladders could save the planet." The Independent, 14 Apr. 2013. Web.
  20. Meyer, S. L., Rickenbacher, L. & Zürcher, E. (2020).Monza - Parlor Game. HfHnews, (25) / Zurich. available under: https://www.researchgate.net/publication/347654229_Monza_-_parlor_game
  21. Heimlich, U. (2015).: Einführung in die Spielpädagogik (3., aktualisierte und erweiterte Auflage.). Bad Heilbrunn: Verlag Julius Klinkhard, ISBN 978-3825241995
  22. Singer, D. G., Michnick Golinkoff, R. & Hirsh-Pasek, K. (2006).: Play = Learning : How Play Motivates and Enhances Children’s Cognitive and Social-Emotional Growth. New York: Oxford University Press, ISBN 0-19-530438-1.
  23. Audet, Daniel (ডিসে ২০১২)। "Probabilités et espérances dans le jeu de serpents et échelles à deux joueurs" (পিডিএফ)। Bulletin AMQ। 
  24. "Back to square one", The Phrase Finder, Gary Martin.
  25. Hugh-Jones, E. M. (জুন ১৯৫২)। "The American Economy, 1860–1940. by A. J. Youngson Brown"The Economic Journal। Wiley। 62 (246): 411–414। জেস্টোর 2227038ডিওআই:10.2307/2227038 
  26. Rushdie, Salman (২০০৬)। Midnight's Children । Random House। পৃষ্ঠা 160 
  27. Freehill-Maye, Lynn (২০১৬-০১-২৬)। "In Toronto Cafes, Board Games Rule"The New York Times (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 0362-4331। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-২৪ 
  28. "Game Time with Mo and Bo"। Abby Hatcher। 2 মৌসুম। পর্ব 2 (ইংরেজি ভাষায়)। এপ্রিল ২০২০। Nick Jr.। 

গ্রন্থপঞ্জি

আরও পড়ুন সম্পাদনা

  • Berlekamp, Elwyn R; Conway, John H; Guy, Richard K (১৯৮২)। Winning Ways for your Mathematical Plays । Academic Press। আইএসবিএন 0-12-091150-7 
  • Parlett, David (১৯৯৯)। "Snakes & Ladders"। The Oxford History of Board Games Oxford University Press Inc। পৃষ্ঠা 91–94আইএসবিএন 0-19-212998-8 
  • Shimkhada, Deepak (1983) "A Preliminary Study of the Game of Karma in India, Nepal, and Tibet" in Artibus Asiae 44:4, pp. 308–22.
  • Topsfield, Andrew (1985) "The Indian Game of Snakes and Ladders" in Artibus Asiae 46:3, pp. 203–26.
  • Topsfield, Andrew (2006) "Snakes and Ladders in India: Some Further Discoveries" in Artibus Asiae 66:1, pp. 143–79.

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা