নূর হোসেন

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ বাংলাদেশী
(শহীদ নূর হোসেন থেকে পুনর্নির্দেশিত)

নূর হোসেন (১৯৬১ - ১০ নভেম্বর ১৯৮৭) বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, যিনি ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগঠিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।[১]

নূর হোসেন
১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত, দিনু আলম এর তোলা "স্বৈরাচার নীপাত যাক" বুকে লেখা ছবিতে মৃত্যুর মিনিট দশেক আগে আন্দোলনরত নূর হোসেন ।
জন্ম১৯৬১
মৃত্যু১০ নভেম্বর ১৯৮৭ (বয়স ২৫–২৬)
জিরো পয়েন্ট (বর্তমান নূর হোসেন চত্বর), ঢাকা
মৃত্যুর কারণপুলিশের গুলি
জাতীয়তাবাংলাদেশি
পেশাবাংলাদেশি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী
পরিচিতির কারণস্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন
আন্দোলনস্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন
পিতা-মাতামুজিবুর রহমান (পিতা)
মরিয়ম বিবি (মাতা)

প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা

নূর হোসেনের পৈতৃক বাড়ি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ঝাটিবুনিয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তাঁর পরিবার স্থান পরিবর্তন করে ঢাকার ৭৯/১ বনগ্রাম রোডে আসে। পিতা মুজিবুর রহমান ছিলেন পেশায় অটোরিকশা চালক। তাঁর মায়ের নাম মরিয়ম বিবি।[১] অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর নূর হোসেন পড়াশোনা বন্ধ করে গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নূর হোসেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী মটর চালক লীগের বনগ্রাম শাখার প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।[১]

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সম্পাদনা

 
১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বরের গণ আন্দোলন।

১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর দেশের দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একত্র হয়ে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের লক্ষ্যে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা করে। এর পূর্বে এরশাদ ১৯৮২ সালে একটি সেনা উত্থানের মধ্যদিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন, কিন্তু বিরোধী দলগুলো তাঁর এই নির্বাচনকে জালিয়াতি বলে অভিযুক্ত করে। তাঁদের একমাত্র দাবি ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা।

অবরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকায় একটি মিছিলে নূর হোসেন অংশ নেন এবং প্রতিবাদ হিসেবে বুকে পিঠে সাদা রঙে লিখিয়ে নেন: "স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক" । মিছিলটি ঢাকা জিপিওর সামনে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি আসলে স্বৈরশাসকের মদদপুষ্ট পুলিশবাহিনীর গুলিতে নূর হোসেনসহ মোট তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হন। এসময় বহু আন্দোলনকারী আহত হন। নিহত অপর দুই ব্যক্তি হলেন যুবলীগ নেতা নুরুল হূদা বাবুল এবং আমিনুল হূদা টিটু।[১][২][৩]

প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল সম্পাদনা

 
গুলিতে আহত অথবা নিহত একজনকে পুলিশ চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে।

এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিরোধী দলগুলো ১১ ও ১২ই নভেম্বর সারা দেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করে। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে; ফলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আরো ত্বরান্বিত হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।[৪]

এরশাদ পদত্যাগ করলে বাংলাদেশে দুটি হ্যাঁ-না ভোটের মধ্য দিয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এতে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এর এক বছর পর সরকারের পক্ষ থেকে নূর হোসেন এর মৃত্যুর দিনটি সরকারিভাবে উদযাপনে উদ্যোগ গৃহীত হয়। দিনটিকে প্রথমে ঐতিহাসিক ১০ই নভেম্বর দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলেও আওয়ামী লীগ এটিকে শহিদ নূর হোসেন দিবস করার জন্য সমর্থন প্রদান করে এবং এই নামটি এখন পর্যন্ত বহাল রয়েছে।[৪] পদত্যাগের পর এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে একত্রে মহাজোট গঠন করে। ১৯৯৬ সালে এরশাদ, নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য জাতীয় সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাঁর দল জাতীয় পার্টি এখন ১০ই নভেম্বরকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে।[৫]

নূর হোসেন সম্পর্কিত বিভিন্ন বক্তব্য সম্পাদনা

 
ঢাকার জিরো পয়েন্টকে পরবর্তীতে নূর হোসেন চত্বর নামকরণ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ই নভেম্বরের স্মৃতিচারণ করে বলেন:[৬]

আমরা যখন মিছিল শুরু করছিলাম তখন নূর হোসেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তাকে কাছে ডাকলাম এবং বললাম তার গায়ের এই লেখাগুলোর কারণে তাকে পুলিশ গুলি করবে। তখন সে তার মাথা আমার গাড়ির জানালার কাছে এনে বলল, "আপা আপনি আমাকে দোয়া করুন, আমি গণতন্ত্র রক্ষায় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত।"

২০০৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে নূর হোসেনের পিতা বলেন:[৭]

নূর হোসেন যা চেয়েছিল, তা তো হলো। স্বৈরতন্ত্র নিপাত হলো। এখনো দেশে এত হানাহানি, সন্ত্রাস। গণতন্ত্র তো মুক্তি পেল না।

সম্মাননা সম্পাদনা

 
ফুলার রোডের মোড়ে নূর হোসেন ভাস্কর্য।

নূর হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়েছে। ১৯৯১ সালে তার চতুর্থ মৃত্যুবাষির্কী উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রথম দুই টাকা মূল্যের স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়।[৪] প্রতি বছরের ১০ই নভেম্বর বাংলাদেশে "নূর হোসেন দিবস" হিসেবে পালন করা হয়। এছাড়া তিনি যে স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তাঁর নামানুসারে সেই জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয়েছে নূর হোসেন চত্বর[১] জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ নূর হোসেনের একটি মুরাল রয়েছে।[৪] ১০ই নভেম্বর তাঁর মৃত্যুর কিছু সময় পূর্বে তোলা তাঁর গায়ে লেখাযুক্ত আন্দোলনরত অবস্থার ছবিটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. রোজিনা কাদের (২০১২)। "হোসেন, শহীদ নূর"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  2. নিউ ইয়র্ক টাইমস
  3. কাদির (নভেম্বর ১১, ১৯৯১)। "Autocracy dethroned, but Bangladesh ponders future of democracy"। এজেন্সি ফ্রান্স-প্রেস।
  4. "শহীদ নূর হোসেন এখন শুধুই ইতিহাস"jagonews24.com। ৯ নভেম্বর ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ 
  5. "Ershad offers olive branch, calls for national reconciliation"। এজেন্সি ফ্রান্স-প্রেস। ২৮ আগস্ট ১৯৯৬।
  6. "নূর হোসেনের অপমান এভাবে মেনে নেব!"prothomalo.com। ১২ নভেম্বর ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ মে ৫, ২০২০ 
  7. ফারুক ওয়াসিফ (১২ নভেম্বর ২০১৯)। "নূর হোসেনের দ্বিতীয় মৃত্যু"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা