রায়চৌধুরী সমীকরণ

রায়চৌধুরী সমীকরণ বা ল্যান্ডাউ-রায়চৌধুরী সমীকরণ[১] হলো সাধারণ আপেক্ষিকতার একটি মৌলিক ফলাফলভিত্তিক এমন এক সমীকরণ যা বস্তুর কাছাকাছি কণাসমূহের গতির বর্ণনা দেয়।

সাধারণ আপেক্ষিকতার সঠিক সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এবং পেনরোজ-হকিংয়ের সিঙ্গুলারিটি তত্ত্বের ক্ষেত্রে এই সমীকরণটি একটি মৌলিক লেমা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি স্বতন্ত্র একটি আগ্রহেরও উদ্রেক ঘটায়। এর কারণ হলো, নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বে যেমনটা হয়, তেমনইভাবে সাধারণ আপেক্ষিকতার ক্ষেত্রেও মহাকর্ষ বলকে ভর-শক্তিযুক্ত যেকোনো দুটি বস্তুর মধ্যকার একটি সর্বজনীন আকর্ষণ বল হওয়া উচিত বলে আমাদের যে একটি স্বতঃস্ফূর্ত-স্বজ্ঞাত প্রত্যাশা থাকে তার একটি সহজ ও সাধারণ বৈধতা দেয় এই সমীকরণ।

ভারতীয় পদার্থবিদ অমল কুমার রায়চৌধুরী[২] এবং সোভিয়েত পদার্থবিদ লেভ ল্যান্ডাউ দুজনেই স্বতন্ত্রভাবে এই সমীকরণটি আবিষ্কার করেন।[৩]

গাণিতিক বিবৃতি সম্পাদনা

বিবেচ্য কণাসমূহের জন্য বিশ্বরেখাসমূকে সময়-সদৃশ এবং চতুর্মাত্রিক একটি একক ভেক্টর ক্ষেত্র   দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যাক, যেখানে এই ভেক্টর ক্ষেত্রটিকে পরস্পর অছেদ্য বিশ্বরেখাসমূহের একটি পরিবাররূপে অথবা এদের কংগ্রুয়েন্স হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। বিশ্বরেখাসমূহ পারস্পরিক অছেদ্য হওয়ায় কণাসমূহের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে না এবং এদের জিওডেসিক ধর্ম থাকার বাধ্যবাধ্যকতা না থাকায় এই সমীকরণটি বাহ্যিক বল ক্ষেত্রের জন্যও প্রযোজ্য।

মেট্রিক টেন্সর   এবং ভেক্টর ক্ষেত্র   থেকে নিচের টেন্সরটি পাওয়া যায়:

 

এখানে,   হলো ভেক্টর ক্ষেত্রটির লম্ব হাইপারফেসগুলোর অভিক্ষেপ টেন্সর।

এখন, নিচের লম্ব হাইপারফেসগুলোর ওপর ভেক্টরক্ষেত্রটির কোভ্যারিয়েন্ট অন্তরজের অভিক্ষেপই হচ্ছে রায়চৌধুরী সমীকরণের আলোচনার মূল বিষয়:

 

সম্পসারণ স্কেলার   এর জন্য এই টেন্সরটিকে এর প্রতিসাম্যিক অংশে বিভাজন করলে পাওয়া যাবে:

 

এবং টেন্সরটিকে স্কিউ-প্রতিসাম্যিক অংশে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে:

 

যেখানে,   এবং   হচ্ছে যথাক্রমে সম্প্রসারণ টেন্সর এবং ভর্টিসিটি টেন্সর।

আবার,  -এর জন্য শিয়ার টেন্সরটি হবে:

 

এখন শিয়ার টেন্সর   ও ভর্টিসিটি টেন্সর  -এর অঋণাত্মক দ্বিঘাত ইনভ্যারিয়েন্ট হচ্ছে যথাক্রমে:    যেখানে,

 
 

 -কে  -এর ট্রেসও বলা হয়।   হলো বিশ্বরেখা বরাবর গণনাকৃত প্রকৃত সময়ের সাপেক্ষে  -এর ব্যবকলন এবং   হলো কণার ত্বরণ ক্ষেত্র

উপরের সমীকরণগুলো ব্যবহার করলে রায়চৌধুরী সমীকরণটিকে নিম্নরূপভাবে পাওয়া যাবে:

 

এখানে,   হচ্ছে টাইডাল টেন্সর  -এর ট্রেস, যাকে রায়চৌধুরী স্কেলারও বলা হয়।

অতএব,

   -এর টাইডাল টেন্সর  

সুতরাং রায়চৌধুরী সমীকরণের আরেকটি রূপ হলো:

 

প্রতিপাদন সম্পাদনা

অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পাদনা

সম্প্রসারণ স্কেলার দিয়ে ভগ্নাংশের হার পরিমাপ করা হয়, যেখানে সমবগে চলমান (comoving) একটি কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকের গণনাকৃত সময়ের সাপেক্ষে পদার্থের একটি ছোট বলের আয়তনের পরিবর্তন ঘটে (আর তাই এর মান ঋণাত্মকও হতে পারে)। অন্যভাবে বলা যায়, সময়সদৃশ কংগ্রুয়েন্সের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত সমীকরণটি থেকে আমার বিবর্তন সমীকরণটি পাব। একটি নির্দিষ্ট ঘটনার পরে যদি প্রকৃত সময়ের সাপেক্ষে এই রাশিটির অন্তরজ কিছু বিশ্বরেখা বরাবর ঋণাত্মক হতে দেখা যায়, তাহলে পদার্থের একটি ছোট বলের (যে বলের ভরকেন্দ্র উল্লেখিত বিশ্বরেখাক অনুসরণ করে) যেকোনো সম্প্রসারণ অবশ্যই পুনঃপতনের (recollapse) ওপর নির্ভর করবে। আর এটা না ঘটলে তবেই চলমান সম্প্রসারণ সম্ভব।

পদার্থের তৈরি প্রাথমিকভাবে গোলাকার একটি বলের উপবৃত্তাকার কাঠামোয় বিকৃত হওয়ার যেকোনো প্রবণতার পরিমাপ করা হয় শিয়ার টেনসর দিয়ে। আর ভর্টিসিটি টেনসর দিয়ে পরিমাপ করা হয় কাছাকাছি বিশ্বরেখাগুলোর একে অপরের সাথে পেঁচিয়ে যাওয়ার যে কোনো প্রবণতাকে; এমনটা ঘটলে পদার্থের ছোট ব্লব ঘুরছে বলতে হবে, যেমনটা ঘটছে প্রবাহী পদার্থের একটি সাধারণ প্রবাহে (যে প্রবাহ অশূন্য ভর্টিসিটি প্রদর্শন করে) বিদ্যমান প্রবাহী উপাদানগুলোতে।

রায়চৌধুরী সমীকরণের ডানপক্ষ দু ধরনের পদ নিয়ে গঠিত:

১. সমীকরণের যে পদটি (পুনঃ)পতনের কথা তুলে ধরে

  • প্রাথমিকভাবে অশূন্য সম্প্রসারণ স্কেলার,
  • অশূন্য শিয়ারিং,
  • টাইডাল টেন্সরের ধনাত্মক ট্রেস; এটা হলো সেই যথাযথ অবস্থা যেখানে এটি শক্তিশালী শক্তির অবস্থা ধরে নিয়ে নিশ্চিতকরণ করা হয়েছে, যা ভৌতভাবে যুক্তিসঙ্গত প্রবাহিক সমাধানের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরনের সমাধানের জন্য প্রযোজ্য।

২. সমীকরণের যে পদটি (পুনঃ)পতনের বিপরীত

  • অশূন্য ভর্টিসিটি, যা নিউটনীয় কেন্দ্রবিমুখী বলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ,
  • ত্বরণ ভেক্টরের ধনাত্মক নতিমাত্রা (divergence); (উদাহরণস্বরূপ, একটি গোলাকীয় প্রতিসম বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট বহির্মুখী ত্বরণ, অথবা আরও খোলামেলাভাবে বলা যায়, প্রবাহী উপাদান দিয়ে গঠিত একটি গোলক যেখানে এই প্রবাহী পদার্থটি এর নিজস্ব মহাকর্ষের দরুণ আবদ্ধ রয়েছে, সেখানে এই প্রবাহী পদার্থের ওপর প্রযুক্ত বস্তু বলগুলোর দরুন সৃষ্ট বহির্মুখী ত্বরণ।

এ দুটি পদের মধ্যে সাধারণত একটি টিকে থাকে। যাইহোক, এমন কিছু পরিস্থিতি রয়েছে যেগুলোর কারণে ভারসাম্যের সৃষ্টি হতে পারে। এই ভারসাম্যগুলো হতে পারে:

  • স্থিতিশীল: আদর্শ প্রবাহী দিয়ে গঠিত একটি বলের হাইড্রোস্ট্যাটিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে (উদাহরণস্বরূপ, একটি নক্ষত্রের অভ্যন্তরীণ মডেলের ক্ষেত্রে) সম্প্রসারণ, শিয়ার এবং ভর্টিসিটির সবগুলোই অদৃশ্য হয়ে যায় এবং ত্বরণ ভেক্টরের একটি ব্যাসার্ধীয় নতিমাত্রা (ঐ প্রবাহী সহযোগে গঠিত প্রত্যেকটি ব্লবের ওপর প্রযুক্ত সেই প্রয়োজনীয় বস্তু-বল যা প্রবাহীটির চতুর্পাশ্বস্থ চাপ থেকে আসে) রায়চৌধুরী স্কেলারকে বাধা দেয়, যেখানে জ্যামিতিক এককে একটি আদর্শ প্রবাহীর ক্ষেত্রে এই রায়চৌধুরী স্কেলারটি হলো  । নিউটনীয় মহাকর্ষে, টাইডাল টেন্সরের ট্রেসটি হলো  ; সাধারণ আপেক্ষিকতায়, চাপের অভিকর্ষ-বিরোধী হওয়ার যে প্রবণতা, তা এই পদটির মাধ্যমে কিছুটা সরে যায় (অর্থাৎ, ঐ প্রবণতার আংশিক বিচ্যুতি ঘটে এই পদটির মাধ্যমে)। এই পদটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
  • অস্থিতিশীল: উদাহরণস্বরূপ, গোডেল সমাধানের বেলায় ধূলিকণার বিশ্বরেখাগুলো বিলীয়মান শিয়ার, সম্প্রসারণ এবং ত্বরণের অধিকারী হলেও, শুধুমাত্র অশূন্য ভ্যাকুয়াম শক্তির ("মহাজাগতিক ধ্রুবক") কারণে একটি ধ্রুব রায়চৌধুরী স্কেলারের ভারসাম্য রেখে এই বিশ্বরেখাগুলো ধ্রুব ভর্টিসিটিরও অধিকারী হয়।

ফোকাসিং উপপাদ্য সম্পাদনা

ধরা যাক, আমাদের বিবেচনাধীন স্থানকালের কিছু অঞ্চলে শক্তিশালী শক্তির অবস্থাটি সংঘটিত হয়েছে। উপরন্তু,  -কে বিলীয়মান ভর্টিসিটিযুক্ত একটি সময়-সদৃশ জিওডেসিক একক ভেক্টরক্ষেত্ররূপে অথবা অনুরূপ কোনো একক ভেক্টরক্ষেত্ররূপে বিবেচনা করা যাক, যেখানে এই ভেক্টরক্ষেত্রটি হাইপারসারফেস লম্ব। উদাহরণস্বরূপ, যে মহাজাগতিক মডেলগুলো আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণের সঠিক ধূলিকণা-সমাধান, সেই মহাজাগতিক মডেলগুলোতে ধূলিকণার বিশ্বরেখার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে; (আর এটা হবে এই শর্তে যে, এই বিশ্বরেখাগুলো একে অপরের সাথে প্যাঁচিয়ে যাবে না এবং যেক্ষেত্রে কংগ্রুয়েন্সটির অশূন্য ভর্টিসিটি থাকবে)।

তাহলে, রায়চৌধুরী সমীকরণ হবে:

 

এখন, সমীকরণটির ডান পক্ষটি সর্বদা ঋণাত্মক বা শূন্য হওয়ায় সম্প্রসারণ স্কেলারটি কখনোই সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাবে না।

যেহেতু শেষ দুটি পদ অ-ঋণাত্বক, অতএব আমরা যা পাব:

 

প্রকৃত সময়  -এর সাপেক্ষে এই অসমতাকে সমাকলন করে পাওয়া যাবে:

 

সম্প্রসারণ স্কেলারের প্রাথমিক মান   ঋণাত্মক হওয়ার মানে হলো, প্রাথমিক মান  -এর পরিমাপের পরে প্রকৃত সময় সর্বোচ্চ  -এর মধ্যে, জিওডেসিকসমূহ অবশ্যই একটি কস্টিকে মিলিয়ে যাবে, (  ঋণাত্মক অসীমের দিকে ধাবিত হবে)। একটি বক্রতা সিঙ্গুলারিটির সাথে মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে এর ইঙ্গিত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না, তবে মহাকাশীয় ধূলিকণার গতির ক্ষেত্রে আমাদের গাণিতিক বর্ণনায় এটি অবশ্যই ভাঙ্গনের একটি ইঙ্গিত দেয়।

আলোকীয় সমীকরণ সম্পাদনা

আলোক-সদৃশ জিওডেসিক তথা শূন্য জিওডেসিক কংগ্রুয়েন্সের জন্য রায়চৌধুরীর সমীকরণের একটি আলোকীয় (বা শূন্য) সংস্করণও রয়েছে, যাকে আলোক-সদৃশ ভেক্টর   দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়:

 

সম্প্রসারণ, শিয়ার এবং ভর্টিসিটি যে কেবল অনুপ্রস্থ দিকগুলোর ওপর নির্ভর করে, সমীকরণটিতে প্রতীকগুলোর ওপর দেওয়া টুপি চিহ্নগুলো সেই ইঙ্গিতই দেয়। যখন ভর্টিসিটি শূন্য হয়, তখন শূন্য শক্তির অবস্থা বিবেচনা করা হলে, অ্যাফাইন প্যারামিটার  -এ পৌঁছানোর আগেই কস্টিক গঠিত হবে।

প্রয়োগ সম্পাদনা

ঘটনা দিগন্তকে নাল অসীমতার কার্যকারণ অতীতের (causal past) সীমানারূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এই ধরনের সীমানা শূন্য (null) জিওডেসিকের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। শূন্য অসীমের যত কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে, অ্যাফাইন প্যারামিটার ততই অসীমের দিকে চলে যাবে এবং শূন্য অসীমে পৌঁছানোর পূর্বে কোনো কস্টিক গঠিত হবে না। সুতরাং, ঘটনা দিগন্তের সম্প্রসারণকে অ-ঋণাত্মক হতে হবে। যেহেতু এই সম্প্রসারণ থেকে ক্ষেত্র-ঘনত্বের লগারিদমের পরিবর্তনের হার পাওয়া যায়, এর মানে হলো ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রটি কখনই নিচে নেমে যেতে পারে না, অন্ততপক্ষে যদি তাত্ত্বিকভাবে শূন্য শক্তির অবস্থা ধরে নেওয়া হয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Spacetime as a deformable solid, M. O. Tahim, R. R. Landim, and C. A. S. Almeida, টেমপ্লেট:ArXiv.
  2. Dadhich, Naresh (আগস্ট ২০০৫)। "Amal Kumar Raychaudhuri (1923–2005)" (পিডিএফ)Current Science89: 569–570। 
  3. The large scale structure of space-time by Stephen W. Hawking and G. F. R. Ellis, Cambridge University Press, 1973, p. 84, আইএসবিএন ০-৫২১-০৯৯০৬-৪.

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

The Meaning of Einstein's Field Equation by John C. Baez and Emory F. Bunn. Raychaudhuri's equation takes center stage in this well known (and highly recommended) semi-technical exposition of what Einstein's equation says.