রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম)

বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩) খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করে।[২] তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ১নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুর-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
Rafiqul Islam, Bangladeshi politician.jpg
জন্ম (1943-09-13) ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩ (বয়স ৭৯)
পেশালেখক ও রাজনীতিবিদ
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)
পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
বাংলাদেশ
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার

জন্ম ও শিক্ষাজীবনসম্পাদনা

রফিকুল ইসলাম ১৯৪৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার নাওড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। তার বাবার নাম আশরাফ উল্লাহ ও মায়ের নাম রহিমা বেগম। তাঁর স্ত্রী রুবি ইসলাম। দাম্পত্য জীবনে তিনি এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। ভাই ছয় বোনের মধ্যে রফিকুল ইসলাম ছিলেন সবার বড়। জন্মস্থান নাওড়া গ্রামেই প্রাথমিক স্কুলের পড়াশোনা শুরু। তবে পিতা সরকারি কর্মকর্তা (স্কুল ইন্সপেক্টর) হওয়ায়, বদলির সুবাদে পরিবারের সাথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকে লেখাপড়া করেন।তিনি। ১৯৫৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা মডেল হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশেন ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে রফিকুলইসলাম ছাত্র আন্দোলনে সরাসরি জড়িত হয়েপড়েন। [৩] ১৯৬৫ সালে কাকুল মিলিটারী একাডেমী থেকে বিএসসি পাস করেন। ১৯৮১ সালে তিনি আমেরিকার হার্ভাড বিজনেস স্কুলে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম কোর্স সম্পন্ন করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

কর্মজীবনসম্পাদনা

সাংবাদিকতাসম্পাদনা

রফিকুল ইসলাম ছাত্রাবস্থায় সাংবাদিকতার হাতেখড়ি পান। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়ে 'ইউপিপি' সংবাদসংস্থায় খন্ডকালিন সাংবাদিকতা করেন। স্বাধীনতার পর  ১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি  নিয়ে ইংরেজি দৈনিক 'দি পিপলস ভিউ'র সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[৪] এছাড়াও বিভিন্ন জার্নাল এবং জাতীয় দৈনিকে সমকালীন বিষয়ে অসংখ্য কলাম লিখেছেন।

সামরিকসম্পাদনা

রফিকুল ইসলাম ১৯৬৩ সালে অফিসার পদে নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।  ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন অর্জন করেন। একই সময়ে বিএসসি ডিগ্রি পরীক্ষায় উত্তীর্র্ন হন। ১৯৬৮ সালে লাহোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হন এবং তৎকালিন যশোর ক্যান্টনমেন্ট রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন দায়িত্ব পালন শেষে দিনাজপুরে ইপিআরের ৮ নম্বর উইংয়ের অ্যাসিসটেন্ট উইং কমান্ডার পদে বদলি হন। পরে ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে  ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের চট্টগ্রাম সেক্টর হেডকোয়ার্টারে অ্যাডজুট্যান্ট পদে নিয়োগ পান।  সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান। স্বাধীনতার পর  ১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পান।

রাজনৈতিক জীবনসম্পাদনা

সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতন হলে ১৯৯০ সালে দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার (মন্ত্রী পদমর্যাদায়) দায়িত্ব পান। [৫] তিনি ডিসেম্বর ১৯৯০ সাল থেকে ২০ মার্চ ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ওই সরকারের মন্ত্রী পদমর্যদায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। [৬] ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুর-৫ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাজিগঞ্জ শাহরাস্তি এলাকা থেকে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে একই আসন থেকে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। [৭] ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চতুর্থবারের মত নির্বাচিত হন এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ ও ‘পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়’ সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানসম্পাদনা

১৯৭১ সালে রফিকুল ইসলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে প্রেষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেনা মোতায়েন পরিস্থিতি দেখে এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি স্বাধীনতার প্রয়োজনে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তদনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি তার অধীনস্থ বাঙালি অফিসার ও সিপাহিদের সাথে আলোচনা করে কর্তব্য স্থির করেন, এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের সাথে গোপন বৈঠক করে প্রয়োজনে বিদ্রোহের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৭১ এর ২৪শে মার্চ রাতেই ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম কার্যত বিদ্রোহ শুরু করেন। তার আদেশ পেয়ে সীমান্ত ফাঁড়িতে বাঙালি সৈন্যরা অবাঙালি সিপাহিদের নিরস্ত্র ও নিষ্ক্রিয় করে চট্টগ্রামে এসে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদানের জন্যে প্রস্তুত হয়। এম. আর. চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমানের অনুরোধে সেদিন রফিকুল ইসলাম তাদের চট্টগ্রামে আসার নির্দেশ বাতিল করেন। কিন্তু পরদিন ২৫শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে সংঘর্ষ প্রায় অনিবার্য অনুধাবন করে ক্যাপ্টেন রফিক সক্রিয় বিদ্রোহ শুরু করেন এবং ইপিআরের অবাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের জীবিত অবস্থায় বন্দী করে রেলওয়ে হিলে তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। তার অধীনে ন্যস্ত সৈনিকরা এম. ভি. সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমান সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় ২০ বালুচ রেজিমেন্ট-এর সৈন্যরা চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার-এর সহস্রাধিক বাঙালি সৈনিক ও অফিসারকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে কালুরঘাট ব্রিজের দিকে অবস্থান নেয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে চট্টগ্রামের অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আগত ক্যাপ্টেন রফিকের অধীনস্থ ইপিআর সৈনিকদের মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকের বাহিনীর সাথে যোগদানে বাধা দেন এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের সাথে কালুরঘাট ব্রিজ এলাকায় অবস্থান নিতে বাধ্য করেন। এ কারণে ক্যাপ্টেন রফিক সেনাবলের অভাবে চট্টগ্রামে যথাযথ দখল বজায় রাখতে ব্যর্থ হন এবং এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষতি সাধন করে পশ্চাদপসরণ করেন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন রফিক তার বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করেন এবং ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তার হেডকোয়ার্টার সীমান্তের ওপারে হরিণায় স্থাপন করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে এখান থেকেই তিনি ১ নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে চট্টগ্রাম এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে ন্যস্ত হন।[৮] ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।[৯]

স্বীকৃতি ও সম্মাননাসম্পাদনা

গ্রন্থসম্পাদনা

  • এ টেল অফ মিলিয়ন্স [লক্ষ মানুষের গল্প] (১৯৭৪)
  • লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে (১৯৮১)
  • মুক্তির সোপান তলে (২০০১)[১০]

তথ্যসূত্রসম্পাদনা

  1. "বাংলা-একাডেমি-সাহিত্য-পুরস্কার-২০১৯-ঘোষণা"। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জানুয়ারি ২০২০ 
  2. "দৈনিক প্রথম আলো, "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না" | তারিখ: ২২-১১-২০১২"। ২০১৮-১২-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১০-০৬ 
  3. ইশতিয়াক, আহমাদ (২০২২-০১-২৪)। "খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম,বীর উত্তম"ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৮-০১ 
  4. মফিজুল্লাহ কবির-হাসান হাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র। নবম-দশম খণ্ড। বাংলাদেশ: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। 
  5. খালেদা হাবিব। বাংলাদেশঃ নির্বাচন, জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা ১৯৭০-৯১ 
  6. Syedur Rahman (২০১০)। Historical Dictionary of Bangladesh। Scarecrow Press। পৃষ্ঠা 303। 
  7. "১৫৩ আসনে জয়ী যারা"দৈনিক সমকাল। ৪ জানুয়ারি ২০১৪। ৬ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ ডিসেম্বর ২০১৮ 
  8. একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (দ্বিতীয় খন্ড)। প্রথমা প্রকাশন। মার্চ ২০১৩। পৃষ্ঠা ৬০। আইএসবিএন 9789849025375 
  9. রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম (২০০৬)। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। অনন্যা প্রকাশনী। আইএসবিএন 984-412-033-0 
  10. "Rafiqul Islam Bir Uttom Books - রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম এর বই"www.rokomari.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৮-০১