যোগেশ দত্ত (জন্ম ১৯৩৫) হলেন একজন ভারতীয় বাঙালি মূকাভিনেতা,[১] যিনি বিগত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে মূকাভিনয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে ভারতে মাইম একটি কলা হিসাবে দেশে এবং পরবর্তীতে ভারতীয় রীতির কলা হিসাবে বিদেশে প্রচারিত হয়।

যোগেশ দত্ত
কলকাতায় যোগেশ দত্ত, ফেব্রুয়ারি ২০১৮
জন্ম১৯৩৫ (বয়স ৮৮–৮৯)
অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরের হাটশিরুআইল গ্রামে
দাম্পত্য সঙ্গীশুচিতা দত্ত
সন্তানপ্রকৃতি দত্ত
পিতা-মাতাশশীভূষণ দত্ত (পিতা)
পুরস্কারশিরোমণি পুরস্কার (১৯৮৫)
সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার (১৯৯৫)

শুরুতে মঞ্চে  'নির্বাক কৌতুক' পরিবেশনের  অভিনয়ে তিনি মূক।  কিন্তু পরবর্তীতে  'বার্থ টু ডেথ', 'বেকার যুবক', 'এক্সপ্লয়টেশন অফ রবীন্দ্রনাথ', 'রিক্সাওয়ালা', 'স্ট্রাগল  ফর একজিসট্যান্স', 'জাত নিপাত যাক' , 'চোর' ইত্যাদি উপস্থাপনায় ব্যক্তি থেকে সমাজ সবাইকে পরিস্ফুট করলেন  সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তাধারায়। কথা নেই, কিন্তু আবেগ-অনুভূতি ও উপলব্ধির  প্রকাশ আছে উপস্থাপনায়, তাই তিনি  প্রকৃতই একজন "নৈশব্দের কবি" হিসাবে প্রতিভাত হলেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সূচনা হল ভারতীয় মাইমের তথা তাঁরই উদ্ভাবিত শব্দবন্ধ মূকাভিনয়-এর।     

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরের হাটশিরুআইল গ্রামে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন যোগেশ। তার ডাকনাম ছিল ভোলা। পিতামাতার এক কন্যা ও পাঁচ পুত্রের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। জন্মের পর এগারো বছর কাটান সে গ্রামে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট মধ্যরাতের সূর্যোদয়ে সপরিবারে জন্মভিটা ছেড়ে ছিন্নমূল মানুষদের সঙ্গে মিশে চলে আসেন কলকাতায়। পূর্বপাকিস্তানের উদ্বাস্তু বেশে কেবল জীবন নির্বাহের জন্য  হাওড়া, রামপুরহাট, ফরাক্কা নানা স্থানে, প্রথমে চায়ের দোকান, তারপর হোটেল, মুদির দোকান, নির্মাণ কর্মী ইত্যাদি কত বিচিত্র বৃত্তি ও পেশার জন্য ঘুরলেন। এর মধ্যেই ফরাক্কায় তার পরিচয় এক অধ্যাপকের সঙ্গে। তার পরামর্শে কাজের মধ্যে কিছু পড়াশোনা করলেন। শেষে তার এক দাদা কলকাতায় এনে ভর্তি করান এক স্কুলে। বিমল ঘোষ প্রতিষ্ঠিত 'মণিমালা'তে অল্পবিস্তর শিখলেন নাচ, গান, থিয়েটার, হাতের কাজ। আর এতেই যেন তার শিল্পীসত্তা জাগ্রত হয়। লেকের পাশে বসে থাকা যুগলের মুহূর্তের চিত্রণ চার্লি চ্যাপলিনের অঙ্গভঙ্গীতে মঞ্চে উপস্থাপনার পরিকল্পনা করলেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে অনুশীলনে প্রস্তুত করলেন।  ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইডেন উদ্যানের এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করলেন নিজস্ব নির্বাক কৌতুক। পরে জানলেন এ শিল্পকলা হলো ফরাসিদের মাইম। অনেক অনুশীলনে পারদর্শিতা অর্জন করে তিনিই এর ভারতীয় নাম দিলেন মূকাভিনয়। তবে শুরুতে  তিনি নিজে কৌতুক অভিনেতা হিসাবে  প্রতিষ্ঠা করেন সুন্দরম নামের এক নাট্যদল এবং মঞ্চস্থ করেন দুটি নাটক - পথের পাঁচালী এবং মৃত্যুর চোখে জল' [২] নিজের শেখা নির্বাক কৌতুক যে আসলে ফরাসির মাইম  বা প্রাচীন নাট্যশাস্ত্র তা তিনি জানতেন না। [৩] নিজে থেকে শিখে, যোগেশ মাইমের ঐতিহ্য বা প্রাচীন নাট্যশাস্ত্র সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। [২] ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালও তাঁকে বিশেষ পরিচিতি দেয় এবং দেশ বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ আসতে থাকে। [৪]

কর্মজীবন সম্পাদনা

ভারতীয় সংস্কৃতির প্রবক্তা হিসাবে বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং ভারতীয় মূকাভিনয়ের প্রশংসা কুড়িয়ে এনেছেন যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানি ফ্রান্স চেকোস্লোভাকিয়া রোমানিয়া বুলগেরিয়া হল্যান্ড আফগানিস্তান মধ্য প্রাচ্যের এবং  কানাডার মত দেশ থেকে।১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সোফিয়া বুলগেরিয়ায় আয়োজিত নবম বিশ্ব-যুব-ছাত্র উৎসবে যোগ দিতে বুলগেরিয়া যান এবং ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিকে আয়োজিত দশম বিশ্ব উৎসবে তিনি পুরস্কৃত হন।[৫] ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের তৎকালীন ফিল্ম ডিভিশন অব ইন্ডিয়ার উদ্যোগে নির্মিত হয় একটি তথ্যচিত্র - ‘সাইলেন্ট আর্ট অফ যোগেশ দত্ত’। এটি  অনূদিত হয়েছে ১৪টি ভারতীয় ভাষায়। এছাড়াও জার্মানি, ব্রিটেন ও ফ্রান্সেও তার ওপর নির্মিত হয়েছে তথ্যচিত্র।[৪]

যোগেশ মাইম আকাডেমি সম্পাদনা

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মূকাভিনয়ের জন্য তৈরি করেন নিজের দল পদাবলী। সেটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহায়তায় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে রূপান্তরিত হয় যোগেশ মাইম আকাডেমি তে। এটি সঙ্গীত নাটক অকাদেমি এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারা স্বীকৃত। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে অবসরের পর তিনি উদীয়মান শিল্পীদের প্রতিভা বিকাশে এবং কলা-কৌশলে প্রশিক্ষণ দেন।  ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, সুইজারল্যান্ডের শারীরিকভাবে অক্ষমদের ঐচ্ছিক পেশার জন্য মাইমের উপর চার বৎসরের এক কোর্সের ব্যবস্থা আছে  যোগেশ দত্তের সেই সাইলেন্ট ভিলেজ-এ।[২]

শেষ উপস্থাপনা সম্পাদনা

যোগেশ দত্ত ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের  ২১শে আগস্ট কলকাতার রবীন্দ্রসদনে প্রেক্ষাগৃহে তার শেষ শো করেন। উপস্থাপন করেন তাঁর অতি জনপ্রিয় "চোর"।[২]

অনুষ্ঠান শেষে  তিনি বলেন-

" আমি বুড়ো হয়েছি, শারীরিক অক্ষমতা এসেছে।  মূকাভিনয়ের শো'তে তৎপরতার সঙ্গে এবং মুক্তভাবে  শারীরিক চলাচলের প্রয়োজন এবং এটি এখন আমার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছে।"

পরমুহূর্তেনির্বাক কবি এতদিনের ব্যবহৃত  পোশাক মঞ্চে খুলে রেখে ভেঙে পড়েন কান্নায়। বাঁধনভাঙ্গা ভিড়ে পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের সবার চোখেও তখন জল। তারপরেও তিনি  নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন শিক্ষকতায়। বিশেষত প্রতিবন্ধী যুবক যুবতীদের বাঙময় উপস্থাপনায়। তাদের দিয়ে পরিবেশন করিয়েছেন ‘খোল দ্বার’ নামক উপস্থাপনা যা আসলে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র রূপান্তর।[৪]

পুরস্কার ও সম্মাননা সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Times of India retrieved 12 January 2011
  2. Sarkar, Sebanti (আগস্ট ২৩, ২০০৯)। "Silence takes a bow - Mime artist Jogesh Dutta retires from stage"The Telegraph (Kolkata)। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ৮, ২০১৭ 
  3. Sarkar, Sebanti (ডিসেম্বর ২৭, ২০০৯)। "Banchharam's day"The Telegraph (Kolkata)। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ৮, ২০১৭ 
  4. Mazumdar, Jaideep (আগস্ট ২৯, ২০০৯)। "The Life and Mime of Jogesh Dutta"OPEN Magazine। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ১১, ২০১৭ 
  5. "About Jogesh Dutta"। Jogesh Mime Academy। জানুয়ারি ৬, ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ১১, ২০১৭