বৈদ্যনাথ বসাক (ইংরেজি: Baidyanath Basak)( জন্মঃ ১৯২৪—মৃত্যুঃ ৪ জুন,২০২০) বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে অন্যতম প্রতিভাবান সিনেমাটোগ্রাফার (চিত্রগ্রাহক)।[১][২]

বৈদ্যনাথ বসাক
জন্ম১৯২৪
মৃত্যু৪ জুন ২০২০ (বয়স ৯৬)
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাসিনেমাটোগ্রাফার
দাম্পত্য সঙ্গীসরস্বতী দেবী
সন্তানসঞ্জয় বসাক
পিতা-মাতারাধানাথ বসাক (পিতা)

সংক্ষিপ্ত জীবনী সম্পাদনা

বৈদ্যনাথ বসাকের জন্ম ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে। পিতার নাম রাধানাথ বসাক। পড়াশোনা শেষে জীবনের প্রথম দিকে বক্সিং খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু ফোটোগ্রাফিটা ভালই আয়ত্ত করেছিলেন। তারই উপর ভরসা করে বোম্বাই বর্তমানে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সহকারী ক্যামেরাম্যানের কাজ নিয়ে। সেসময়ে বাংলার চলচ্চিত্রে ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন অজয় কর, রামানন্দ সেনগুপ্ত, বিভূতি লাহা, দীনেন গুপ্ত, সুব্রত মিত্র, সৌম্যেন্দু রায় প্রমুখ দিকপালরা। বৈদ্যনাথ বসাক সফল হয়েছিলেন হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রে কেননা, তিনি চলচ্চিত্রের জন্য প্রয়োজনীয় শৈল্পিকগুণ ধারণ করতেন মেধা আর মননে। কথা ও কাহিনীর বৈচিত্র্যময় মুহূর্তগুলিকে এমনভাবে ক্যামেরা বন্দি করতেন দর্শকের কাছে তা জীবন্ত এবং নান্দনিকতায় ধরা দিত। সেকারণে তিনি হিন্দিতে রাজ কাপুরের আর বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমারের প্রিয় চিত্রগ্রাহক হতে পেরেছিলেন। অত্যন্ত সহজ সরল মানুষটি মহানায়কের সান্নিধ্য পেয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের আঙিনায় আজীবন বেঁধে রাখলেন নিজেকে, একটুও ভাবলেন না নিজের কথা। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাজ কাপুরের প্রযোজনায় 'বুটপালিশ' সিনেমায় চিত্রগ্রাহক হিসাবে প্রথম কাজ করেছিলেন তিনি। পরের বছরই রাজ কাপুর নিজেই পরিচালনা করেন "শ্রী৪২০"। সেই ছবিতেও বৈদ্যনাথকে ক্যামেরায় থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান রাজ কাপুর। কিন্তু ততদিনে তিনি বোম্বে থেকে কলকাতায় চলে এসেছেন, চুক্তি করেছেন অগ্রদূত পরিচালিত উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত "অগ্নিপরীক্ষা" ছবির জন্য। সিনেমাটোগ্রাফিতে বিভূতি লাহা এবং বিজয় ঘোষের সহকারী ক্যামেরার কাজ শুরু করেন বৈদ্যনাথ। বোম্বে যাওয়া আর হয়নি বাংলা ছবিতে কাজ করার স্বার্থে আর মহানায়ক উত্তম কুমারের সান্নিধ্য ভোগের আশায়। উত্তম কুমারের সঙ্গে ক্যামেরাম্যান হিসাবে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন। মহানায়কের ৭২ টি ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করার একমাত্র গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তারই। এছাড়া চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে এমনকি সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও সহায়তা করেছেন। বৈদ্যনাথ বসাক বাংলার অনেক গুণী শিল্পী ও কলাকুশলীদের সঙ্গে কাজ করেছেন চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে। তারা হলেন - মাধবী মুখোপাধ্যায়,সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার,সুচিত্রা সেন, তনুজা, মালা সিনহা মনোজ কুমার প্রমুখ। বাংলার বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা পিনাকী চৌধুরীর সাথেও বহু সিনেমা ও সিরিয়ালের চিত্রগ্রহণ করেছেন। টেলিফিল্ম 'অতিক্রম' বহু জনপ্রিয় হয়েছিল। দূরদর্শনে শতাধিক বার প্রদর্শিত হয়েছে। বৈদ্যনাথ বসাক ফটোগ্রাফিতে যেমন দক্ষ ছিলেন ঠিক তেমনই প্রতিটি কাজের সম্পূর্ণতার ও সফলতার লক্ষ্যে ঝুঁকি নিতেও পারতেন। খনির মধ্যে গিয়েও চিত্রগ্রহণে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। বিগত শতাব্দীর পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে সফল হয়েছিলেন কঠোর পরিশ্রম আর সৃজনশীলতা মাধ্যমে। তখনকার দিনে ফটোগ্রাফি এত উন্নত ছিল না, তবুও সেদিনের দামী বিদেশী 'মিচেল' ক্যামেরা দিয়ে তিনি অধীত তাত্বিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় ভর করে ধৈর্য সহকারে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে যা ক্যামেরা বন্দি করতেন, তা দর্শকের কাছে জীবন্তরূপ ফুটে উঠত। ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার হিসাবে তিনি কাজ করেছেন। নেপালের রাজা মহেন্দ্রর ব্যক্তিগত আলোকচিত্রী ছিলেন। কিন্তু সেখানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তেজনাময় থাকার কারণে কলকাতায় ফিরে আসেন। শেষের দিকে তার তেমন কাজ ছিল না।[৩][৪] সুদীর্ঘ নয়টি দশকের বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনের সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কলকাতার দূরদর্শনে। দূরদর্শন ৩১/০১/২০১৯ তারিখে 'বৈদ্যনাথ ইতিকথা' শীর্ষক তথ্যচিত্র সম্প্রচার করে।[৫]

নতুন প্রজন্মের উদীয়মান চলচ্চিত্র পরিচালক রাজ ব্যানার্জি মুখ্যতঃ তার মূল্যবান পরামর্শ এবং শিক্ষালাভের জন্যই দুটি ছবিতে নিয়েছিলেন। তিনি অশক্ত শরীরের যতটুকু সম্ভব তাঁকে সাহায্য করেন। তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজ ব্যানার্জি বলেন-

আমার জীবনে পরিচালক হিসেবে আমি যা পেয়েছি তার অনেকটাই বৈদ্যনাথ কাকুরই অবদান। আমার "পাড় - দ্য রিভার ব্যাঙ্ক " এবং "সীমাহীন আঁধার আর...." এই দুটি সিনেমাতে ক্যামেরার পেছনে ছিলেন কাকু।"পাড় দ্য রিভার ব্যাঙ্ক " সিনেমা কলকাতার গোর্কি সদনে দেখে খুব আশীর্বাদ করেছিলেন। বলেছিলেন "রাজ তুমি একদিন বড়ো পরিচালক হবেই হবে"। আমার অনেক আশীর্বাদ রইল। ......আমাকে পুত্রসম ভালোবাসতেন। সবসময় কাজের বিষয়ে সিরিয়াস থাকতে বলতেন। আর বলতেন "রাজ ধৈর্য ধরো দেখো সুদিন আসবেই"।

[৩]

বর্ষীয়ান এই সিনেমাটোগ্রাফারের ধৈর্য ছিল, কিন্তু সুদিন আসেনি। যেখানে যাঁর কাছে কাজ করে যা পেতেন,তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন, প্রকাশও তেমন করতেন না। নিজের কোন ব্যক্তিগত চাহিদা ছিল না, কারো প্রতি কোন রকমের অভিযোগ করে কাউকে কিছুই বলতেন না। সহকর্মীরা উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এলেও নীরব থেকেছেন। তাই বঞ্চিত হয়েছেন বহু ক্ষেত্রে।

মৃত্যু সম্পাদনা

দীর্ঘ দিনের কর্মজীবনে বাংলা চলচ্চিত্রে এত দিয়েছেন, কিন্তু শেষের দিকে তার জীবনটা ছিল বড়ো দুঃখের। শেষজীবনে ভিক্ষার অন্নেই দিন কাটিয়েছেন।[৬] ....দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে অবশেষে চলে গেলেনও নীরবে ২০২০ সালের ৪ ঠা জুন।

উল্লেখযোগ্য নির্বাচিত চলচ্চিত্রের তালিকা সম্পাদনা

  • ১৯৫৫ - 'সবার উপরে'
  • ১৯৫৬ - 'ত্রিযামা'
  • ১৯৫৬ - 'একটি রাত'
  • ১৯৫৬ - 'পুত্রবধূ'
  • ১৯৫৭ - 'পথে হোল দেরী'
  • ১৯৫৯ - 'লালুভুলু'
  • ১৯৬৩ - 'দেয়া নেয়া'
  • ১৯৬৩ - 'বাদশা'
  • ১৯৬৮ - 'কখনো মেঘ'
  • ১৯৭০ - 'মঞ্জরী অপেরা'
  • ১৯৭১ - 'ছদ্মবেশী'
  • ১৯৭৩ - 'সোনার খাঁচায়'
  • ১৯৮১ - 'সূর্য সাক্ষী'

চলচ্চিত্র নির্মাতা পিনাকী চৌধুরীর সাথে -

  • ১৯৮৩ - 'চেনা-অচেনা'
  • ১৯৮৭ - 'আপন ঘরে'
  • ১৯৯৫ - 'কাকাবাবু হেরে গেলেন'
  • 'টানাপোড়েন'
  • 'বলিদান'
  • 'একবার ফির'
  • 'ওয়াযুধ'
  • 'খোঁজ'
  • 'মুক্তি'

টেলিফিল্ম দুটি হল -

  • 'হঠাৎ বসন্ত'
  • 'অতিক্রম'

রাজ ব্যানার্জির সাথে -

  • 'সীমাহীন আঁধার আর...'
  • 'পাড় - দ্য রিভার ব্যাঙ্ক'

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "উত্তমের সেই সিনেমাটোগ্রাফার প্রয়াত"। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১২ 
  2. "Cinematographer Baidyanath Basak passes away"। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১২ 
  3. "নীরবে চলে গেলেন চিত্রগ্রাহক বৈদ্যনাথ বসাক, ..."The Wall। ২০২০-০৬-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১২ 
  4. "B N Basak Cinematography"Cinemaazi 
  5. D D News 28.01.2019
  6. "ভাত চেয়ে ঘুরেছেন থালা হাতে, চিরঘুমে উত্তম কুমারের সেই প্রিয় ক্যামেরাম্যান"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৪-০৯