বৈকুণ্ঠ একাদশী (সংস্কৃত: वैकुण्ठ एकादशी) হলো একটি হিন্দু উৎসব ও পবিত্র দিন । এটি মূলত বৈষ্ণবদের দ্বারা পালিত হয়। বৈষ্ণবরা এটিকে একটি বিশেষ একাদশী হিসাবে বিবেচনা করে । এটি মোক্ষদা একাদশী বা পুত্রদা একাদশীর সমানুপাতিক। এটি ধনু সৌর মাসের ১১তম চান্দ্র দিবসে পালন করা হয় যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৩ই জানুয়ারির মধ্যে পড়ে ।

বৈকুণ্ঠৈকাদশী
ইসকন্ ব্যাঙ্গালোরে পালিত বৈকুন্ঠ একাদশী।
পালনকারীবৈষ্ণব
ধরনহিন্দু পবিত্র দিন
তাৎপর্যমুরাসুরের উপর বিষ্ণুর বিজয়
বৈকুন্ঠের দ্বার উন্মুক্ত করা
উদযাপনমন্দির উদযাপন অনুষ্ঠান
পালনউপবাস
তারিখধনু মাস, শুক্ল পক্ষ, একাদশী তিথি
সংঘটনবার্ষিক

কিংবদন্তি সম্পাদনা

পদ্মপুরাণের এক কিংবদন্তিতে বৈকুণ্ঠ একাদশীর উৎপত্তি উল্লেখ করা হয়েছে । একসময় মুরাসুর নামে একজন অসুর ছিল। সে ব্রহ্মার কাছ থেকে প্রাপ্ত একটি বরের কারণে দেবগণের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো ছিল।

তাঁরা বিষ্ণুর সাহায্য চান। বিষ্ণু অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিন্তু তাঁকে পরাজিত করতে পারেননি । তিনি বদরিকাশ্রমের আশেপাশে সিংহবতী নামক একটি গুহায় গেলেন যেখানে মুরাসুর তাঁকে অনুসরণ করছিল । সেখানে বিষ্ণু যোগমায়া নামে এক দেবীকে ডেকে পাঠান। যোগমায়া তাঁর ঐশ্বরিক শক্তি থেকে সৃষ্টি হয়ে অসুরকে হত্যা করেন । বিষ্ণু দেবীকে ' একাদশী ' উপাধি প্রদান করেন এবং ঘোষণা করেন, তিনি পৃথিবীর সমস্ত মানুষের পাপ ক্ষয় করতে সক্ষম হবেন । [১] বৈষ্ণব ঐতিহ্যে এটি অনুষ্ঠিত হয়। তারা এই উপলক্ষে উপবাস পালন করে ও একাদশীর পূজা করে বৈকুণ্ঠ লাভ করে। এভাবে প্রথম একাদশীর আবির্ভাব হয় যা ছিল ধনুর্মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশী।[২]

পরবর্তী এক কাহিনী অনুসারে , একবার অযোধ্যায় অম্বরীষ নামে একজন বৈষ্ণব রাজা ছিলেন। তিনি সর্বদা এই একাদশী উপবাসের শপথ করেছিলেন । এই উপলক্ষে তিন দিনের উপবাসের পর তিনি যখন তাঁর উপবাস ভাঙতে যাচ্ছিলেন তখন ঋষি দুর্বাসা তাঁর প্রাসাদদ্বারে হাজির হন । রাজা মুনি সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেন ও তাঁকে খাবার প্রদান করেন যা পরে ঋষি গ্রহণ করবেন। কিন্তু মুনি প্রথমে তাঁর আনুষ্ঠানিক স্নান করতে গমন করেন । অম্বরীশ অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলেন।

কিন্তু তখনও ঋষি ফিরে আসেননি ও তাঁর উপবাস ভাঙার শুভ মুহূর্তটি এগিয়ে আসে ।

তিনি দ্বিধার সম্মুখীন হলেনঃ যদি তিনি দিন শেষ হওয়ার আগে তাঁর উপবাস না ভাঙেন তবে তাঁর উপবাস ব্রতটি ফলপ্রসূ হবে না - তবে তিনি যদি দুর্বাসা ফিরে আসার আগে এক টুকরো খাবার গ্রহণ করেন তবে তার প্রতি অসম্মান করা হবে । তিনি কেবল কিছু জল চুমুক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন যা তাঁর উপবাস ভেঙে দেয় তবে আশা করেছিলেন যে ঋষির কাছে তা অপমানজনক বলে মনে হবে না । তিনি যখন ফিরে আসেন তখন দুর্বাসা রেগে যান এবং তাঁর মাথা থেকে একগুচ্ছ চুল ছিঁড়ে ফেলে রাজাকে আক্রমণ করার জন্য তা নিক্ষেপ করেন । বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র সেই জটাগুচ্ছটিকে ধ্বংস করতে হস্তক্ষেপ করে ও পরে ঋষিকে তাড়া করতে এগিয়ে যায় । দুর্বাসা ব্রহ্মা ও শিবের কাছে সুরক্ষা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে এলেন কিন্তু দুই দেবতা তাঁকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেন । অবশেষে দুর্বাসা বিষ্ণুর কাছে নিজের জীবনের জন্য ভিক্ষা করেন। বিষ্ণু তাঁকে জানান যে ,তার সুরক্ষা তাঁর ভক্তের হাতে রয়েছে।

সেই অনুযায়ী , দুর্বাসা অম্বরীষের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে রক্ষা পান।[৩] আরেক কিংবদন্তি অনুসারে , বিষ্ণু বৈকুণ্ঠের (তাঁর বাসস্থান) দ্বারটি দুই অসুরের (অসুররা তাঁর বিরুদ্ধে থাকা সত্ত্বেও) জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন । তারা এই বরও প্রার্থনা করেছিল, যে তাদের গল্প শ্রবণ করবে এবং বৈকুণ্ঠ দ্বারম্ নামে বিখ্যাত দরজা থেকে বিষ্ণুর ছবি বহির্গত হতে দেখবে সেও বৈকুণ্ঠে পৌঁছে যাবে । সারা ভারতের মন্দিরগুলি এ দিন ভক্তদের হেঁটে যাওয়ার জন্য একটি দরজার মতো কাঠামো তৈরি করে ।

গুরুত্ব সম্পাদনা

বৈষ্ণববাদ সম্পাদনা

বৈষ্ণবরা (বিষ্ণুর ভক্ত) বিশ্বাস করেন , এই দিন বৈকুণ্ঠ দ্বারম্ (বৈকুণ্ঠের দ্বার) উন্মুক্ত করা হয় । চান্দ্র পঞ্জিকায় মার্গশীর্ষ শুক্ল পক্ষীয় একাদশীকে ' মোক্ষদা একাদশী ' বলা হয় । এই শুভ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন বিষ্ণু মন্দিরে বেদ, নালাইরা দিব্য প্রবন্ধম্, শ্রী বৈকুণ্ঠ গড়িয়ম থেকে বিশেষ প্রার্থনার পাশাপাশি বৈকুণ্ঠ দ্বার পূজা প্রকরোৎস্বম (শ্রী বেলি ওঞ্জাল সেবা) ও বক্তৃতার আয়োজন করা হয়।

বৈকুণ্ঠ বলতে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর বাসস্থানকে বোঝায় । বৈষ্ণবরা বিষ্ণুর চরণকে বিষ্ণুপদ বা পরম পদম্ (সর্বশ্রেষ্ঠ গন্তব্য) হিসাবে বিবেচনা করেন। কারণ বৈকুণ্ঠ বিষ্ণু ও তাঁর ভক্তদের জন্য শুদ্ধ - সত্ব বা পবিত্রতা ও মঙ্গলময় সর্বোচ্চ বসবাসের রাজ্য হিসাবে বিবেচিত হয়।[৪]

বিষ্ণু মন্দিরে বৈকুণ্ঠ একাদশী হল ধনুর্মাসম (মার্গালী ব্রত) ও তার পূজার অংশ । পুরো ধনুর্মাসম্ মাস জুড়ে উপবাসের পাশাপাশি শ্রী বৈষ্ণব মিতাচার ও খাদ্য বিধিনিষেধ আদি কর্তব্য বেশ কয়েকজন বৈষ্ণব অনুশীলন করেন।

বিষ্ণু পুরাণ অনুসারে, বৈকুণ্ঠ একাদশীর উপবাস হিন্দু বছরের অপর ২৩টি একাদশী উপোসের সমতুল্য। [৫] তবে বৈষ্ণব ঐতিহ্য অনুসারে, শুক্লকৃষ্ণ পক্ষীয় উভয় একাদশীর উপোস বাধ্যতামূলক। একাদশীকে অন্য যে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের চেয়ে পবিত্র বলে মনে করা হয় । শুক্লপক্ষের ১১তম দিনে একাদশীতে সম্পূর্ণ উপবাস পালন করতে হবে । এই কারণেই দ্বাদশীর (১২তম দিন) খাবারটি স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকরভাবে তৈরি করা হয়।

উপবাস সম্পাদনা

বৈকুণ্ঠ একাদশী উপবাস এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক । মানুষ সারা দিন উপবাস করে ও সতর্ক থাকে । বিষ্ণুর কাছে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। ভক্তগণ জপ (বিষ্ণুর নাম ও ধ্যানমন্ত্র) - এ নিবিষ্ট হন । ' দশমি ' - তে (একাদশীর আগের দিন) ভক্তগণ যারা বৈকুণ্ঠ একাদশী উপবাস গ্রহণ করেন, তাদের কেবল দুপুরের খাবার গ্রহণ করতে হয় । পরের দিন একাদশীতে তাদের সম্পূর্ণ উপবাস বজায় রাখতে হবে ও বিষ্ণুর প্রার্থনা, ধ্যানাদি কর্তব্য। তাদের চাল ভক্ষণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ । একাদশী রাতে মানুষ সারা রাত জেগে থাকে ও বেশিরভাগ সকালের দিকে বিষ্ণুমন্দিরে যায়।

শৈব সম্প্রদায় এই দিনটিকে ত্রিকোটি একাদশী হিসাবে পালন করে যেখানে এর অনুগামীরা হিন্দু দেবমণ্ডলীর সমস্ত দেবতা শিবকে প্রণাম করেন বলে বিশ্বাস করে।

অনুষ্ঠান সম্পাদনা

এই অনুষ্ঠানের উদ্‌যাপন সমস্ত বেঙ্কটেশ্বর মন্দির জুড়ে বিস্তৃত । এই বিশেষ উৎসবের জন্য শ্রীরঙ্গমকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় যা বিশেষভাবে স্বর্গ ভাসাল খোলার জন্য বিখ্যাত । পরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানটি তিরুমালা পাহাড়ের তিরুপতিতে উদযাপিত হয় বলে মনে করা হয় যেখানে বেঙ্কটেশ্বরের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় মন্দির রয়েছে।

শ্রীরঙ্গম সম্পাদনা

শ্রী রঙ্গনাথস্বামী মন্দির, শ্রীরঙ্গমে বৈকুণ্ঠ একাদশী উদযাপন ২০ দিন ধরে চলে। এটি দুটি ভাগে বিভক্তঃ পাগাল পাথু (সকালের অংশ ১০ দিন) ও ইরা পাথু (রাতের অংশ ১০ দিন ) । বিষ্ণুর মুলাভার (রঙ্গনাথ মন্দিরের কেন্দ্রীয় মূর্তি) রূপে তাঁর মুথাঙ্গি - মুক্তার বর্ম - ভক্তদের ২০ দিন ধরে আশীর্বাদ করে বলে মনে করা হয়। পাগাল পাথুর ১০ম দিনে (বৈকুণ্ঠ একাদশীর পূর্ববর্তী দিন) 'উৎসবর' (নামপেরুমল নামে একটি শোভাযাত্রার মূর্তি) ভক্তদের মোহিনী রূপে আশীর্বাদ করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

বৈকুণ্ঠ একাদশীতে ভোরের সময় নামপেরুমল হীরা ও রত্ন - বর্ম পরিহিতাবস্থায় ভক্তদের আশীর্বাদ করে বলে বিবেচনা করা হয় এবং তাকে পবিত্র স্থান থেকে হাজার স্তম্ভযুক্ত হলে নিয়ে আসা হয় যা বৈকুণ্ঠের প্রবেশদ্বার পরমপদ ভাসাল নামে পরিচিত। এই দ্বারটি শুধুমাত্র বৈকুণ্ঠ একাদশী উপলক্ষে একবার খোলা হয় । বলা হয়, যে ব্যক্তি পরমপদ বাসালের মধ্য দিয়ে যায় সে বৈকুণ্ঠ লাভ করে থাকে । এই কারণে এটি স্বর্গ ভাসাল নামেও পরিচিত।

তিরুপতি সম্পাদনা

তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দির সম্পর্কেও একই ধারণা রয়েছে যেখানে মুক্কোটির একাদশি উদযাপন করা হয়। এটি তেলেগু - ভাষী অঞ্চলে বিখ্যাত । তিরুমালা বৈকুণ্ঠ দ্বারম্ নামে একটি বিশেষ প্রবেশদ্বার রয়েছে যা গর্ভগৃহকে ঘিরে রেখেছে। দ্বারম্ (প্রবেশদ্বার) শুধুমাত্র বৈকুণ্ঠ একাদশীর দিন খোলা হয়। বিশ্বাস করা হয়, যে কোনও ব্যক্তি বৈকুন্ঠ একাদশীর এই বিশেষ দিনে ' বৈকুণ্ঠ দ্বারম্ ' - এর মধ্য দিয়ে গেলে বৈকুণ্ঠ লাভ করেন। [৬] মন্দিরে বৈকুণ্ঠ একাদশীর দিন তীর্থযাত্রী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রচুর ভিড় দেখা যায়।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. www.wisdomlib.org (২০১৫-০৮-১৮)। "Mura: 19 definitions"www.wisdomlib.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-০৪ 
  2. "Vaikuntha Ekadasi"The Hindu। ২০০৩-১২-২৯। Archived from the original on ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৪। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-১৯ 
  3. Verma, Manish (২০১৩)। Fasts and Festivals of India (ইংরেজি ভাষায়)। Diamond Pocket Books (P) Ltd.। পৃষ্ঠা 65। আইএসবিএন 978-81-7182-076-4 
  4. "What is Vaikuntha? - Definition from Yogapedia" 
  5. "Vaikuntha Ekadashi" (পিডিএফ)। ৫ মার্চ ২০০৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-১৯ 
  6. "Fervour marks Vaikunta Ekadasi"The Hindu। ২০০১-১২-২৭। Archived from the original on ১২ নভেম্বর ২০০৪। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-১৯