প্রতিভা মুৎসুদ্দি

বাংলা ভাষা সংগ্রামী

প্রতিভা মুৎসুদ্দি (জন্মঃ ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৩৫) বাংলাদেশের একজন শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী। প্রতিভা মুৎসুদ্দি নির্যাতিত নিপীড়িত পিছিয়ে পড়া নারীদের নানা সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামেও বিভিন্ন ভাবে যুক্ত। নির্মোহ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি সবসময়ই নাম-যশ-খ্যাতি এবং প্রচার প্রপাগান্ডাকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।[১]

প্রতিভা মুৎসুদ্দি
২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ তে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে
জন্ম (1935-12-16) ১৬ ডিসেম্বর ১৯৩৫ (বয়স ৮৮)
জাতীয়তাবাংলাদেশী
পরিচিতির কারণশিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী
পুরস্কারএকুশে পদক, ২০০২
আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার, ২০১৫
বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, ২০১৭

জন্ম ও কর্মজীবন সম্পাদনা

প্রতিভা মুৎসুদ্দির জন্ম ১৯৩৫ সালে ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার মহামুনী পহাড়তলী গ্রামে। বাবা কিরণ বিকাশ মুৎসুদ্দি তার সময়ের একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। মা শৈলবালা মুৎসুদ্দি সহজ সরল অথচ সত্যাশ্রয়ী গৃহিণী। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, ভাষার দাবীতে আন্দোলিত সময়ে বেড়ে উঠেছেন প্রতিভা মুৎসুদ্দি। তার শিক্ষাজীবনের সময়টি ছিল সমাজের অবহেলিত ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠির অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ও তাত্ত্বিক ব্যঞ্জনাময় আন্দোলনের বেগবান সময়। তখনকার চট্টলা বিপ্লবী ও সত্যাগ্রহীদের সুতিকাগার এবং চারণক্ষেত্র হিসাবে বিশেষভাবে আন্দোলিত। পারিবারিক মূল্যবোধ ও সময়ের এ মহার্ঘ চালিকা শক্তি প্রতিভা মুৎসুদ্দির শিক্ষা ও মননের বিকাশকে প্রভাবিত করেছে। তার রাজনীতিতে হাতে খড়ি গ্রামের স্কুলে। কলেজ জীবনে ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছেন রাজনীতি তথা জীবন ঘনিষ্ঠ বামপন্থী রাজনীতিতে। জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন সেবা ও কল্যাণধর্মী কর্মকাণ্ডের সাথে। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধিকার আন্দোলন তখন বেগবান। ১৯৫৫ সালে স্বাধিকার আন্দোলনের এক মিছিল থেকে তিনি গ্রেফতার হন। দু সপ্তাহের কারাবাসের পর মুক্তি পান। তৎকালীন সবার প্রিয় এ বামপন্থী ছাত্রনেত্রী ১৯৫৫-৫৬ শিক্ষাবর্ষে ডাকসুতে মহিলা মিলনায়তন সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৬-১৯৫৭ শিক্ষাবর্ষে রোকেয়া হলের (তৎকালীন উইমেন্স হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) প্রথম নির্বাচিত সহ সভানেত্রী। রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও আন্দোলনের ঘাত প্রতিঘাত মাথায় নিয়ে ১৯৫৬ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান), ১৯৫৯ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ সালে ময়মনসিংহ মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রি লাভ করেন। এ ভাবেই মানবতার কল্যাণে নিবেদনের জন্য নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন।[২]

নারীশিক্ষায় অবদান সম্পাদনা

সেবাদাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ অধিকার বঞ্চিত নারীদের বৈষম্য শিক্ষার আলোকে বিদূরিত করায় ব্রতী হয়েছিলেন প্রতিভা মুৎসুদ্দি। তিনি নারী শিক্ষা ও স্বাবলম্বনে তথা নারী পুরুষ সমতায় মানুষ গড়ার বিশাল কর্মযজ্ঞে নিজেকে নিবেদন করেন। তিনি তার ১ম কর্মক্ষেত্র কক্সবাজার বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা পদে যোগ দেন ১৯৬০ সালে এবং ১৯৬২ সালে জয়দেবপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে গাজীপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়)-এ প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।[২]

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার আমন্ত্রণে প্রতিভা মুৎসুদ্দি ১৯৬৩ সালে ভারতেশ্বরী হোমসে অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষিকা হিসাবে কাজে যোগ দিলেন। প্রতিষ্ঠাতা শহীদ দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার একান্ত ইচ্ছায় ১৯৬৫ সালে ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৮ সালে অবসর নেন। ভারতেশ্বরী হোমসের সব থেকে বেশি সময়কালের অধ্যক্ষা তিনি। তার সময়ে ভারতেশ্বরী হোমস্ স্কুল হিসাবে এবং কলেজ হিসাবেও দেশ সেরার মর্যাদা পায়। তিনি নারী শিক্ষা প্রসারের এক কিংবাদন্তিতে পরিণত হন। বর্তমানে তিনি রণদা প্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বাংলাদেশ) লিঃ এর একজন পরিচালক। সংস্থাটি এখন কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ, ভারতেশ্বরী হোমস্ স্কুল ও কলেজ, কুমুদিনী নার্সিং স্কুল ও কলেজ এর মতো বিখ্যাত নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছে। বলাই বাহুল্য তিনি সার্বিক ভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর একজন অন্যতম কর্ণধার।[২]

পুরস্কারসমূহ সম্পাদনা

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত প্রতিভা মুৎসুদ্দি তার কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কৃত হয়েছেন একাধিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনন্যা শীর্ষ দশ পদক, বৌদ্ধ একাডেমী পুরস্কার, ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদার হুড মিশন কর্তৃক কর্মবীর পদক, ড. আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার, ২০১৫ ইত্যাদি। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সংগঠন থেকে ভাষা সৈনিক হিসেবে সম্মাননা লাভ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।[২] ২০১৭ সালে তিনি বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ লাভ করেন।[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ পেলেন যারা"দৈনিক যুগান্তর। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ 
  2. ড. আহমদ শরীফ স্মারক বক্তৃতা ও স্মারক পুরস্কার ২০১৫, স্বদেশ চিন্তা সঙ্ঘ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, পৃষ্ঠা ৪৭-৪৮
  3. "বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ পেলেন সাত বিশিষ্টজন"দৈনিক কালের কণ্ঠ। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা