পান্নালাল ভট্টাচার্য
পান্নালাল ভট্টাচার্য (ইংরেজি: Pannalal Bhattacharya; ১৯৩০ – ২৭ মার্চ ১৯৬৬) বাংলা ভক্তিগীতির জগতে বিশেষকরে শ্যামাসঙ্গীতের এক প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। তার গাওয়া বেশিরভাগ শ্যামাসঙ্গীতের গীতিকার হলেন বাংলার শাক্ত কবি রামপ্রসাদ সেন, নয় তো কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি বাংলাগানের স্বর্ণযুগের স্বনামধন্য শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের অনুজ।[১]
পান্নালাল ভট্টাচার্য | |
---|---|
জন্ম | ১৯৩০ বালি, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ |
উদ্ভব | ভারত |
মৃত্যু | ২৭ মার্চ ১৯৬৬ কাকুলিয়া রোড, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ | (বয়স ৩৬)
ধরন | শ্যামা সঙ্গীত |
পেশা | সঙ্গীতশিল্পী |
কার্যকাল | ১৯৪৭–১৯৬৬ |
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনাপান্নালাল বৃটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বালির বারেন্দ্র পাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩৩৬ বঙ্গাব্দে) এক শাক্ত পরিবারে। তার পিতা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তার জন্মের আগেই মারা যান। মাতা অন্নপূর্ণা দেবী সুন্দর গান গাইতেন। এগারোজন জন ভাই বোনদের মধ্যে পান্নালাল ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তার অভিন্নহৃদয়ের বন্ধু ছিলেন হাওড়ার বালিরই জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী সনৎ সিংহ।
সঙ্গীতজীবন
সম্পাদনাপান্নালালের ইচ্ছা ছিল চলচ্চিত্রের নেপথ্য গায়ক হবেন, আধুনিক গান গাইবেন। সেসময় বাংলা আধুনিক গানে স্বর্ণযুগের খ্যতিমানরা হলেন শচীন দেববর্মণ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র প্রমুখেরা। পান্নালালের মধ্যে ভক্তিরসের সন্ধান পেয়ে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সতের বৎসর বয়সে তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রফুল্ল ভট্টাচার্য তাকে আর বন্ধু সনৎ সিংহ কে নিয়ে যান এইচ এম ভি'তে। 'আমার সাধ না মিটিল আশা না ফুরিল, সকলই ফুরায়ে যায় মা' শ্যামাসঙ্গীত দিয়ে তার প্রথম গান গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ড হয়। পান্নালাল ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কথামতো আধুনিক আর ছবিতে নেপথ্য সঙ্গীত ছেড়ে ভক্তিমূলক গানকে নিজের কণ্ঠে ঠাঁই দিলেন এবং প্রকৃত অর্থে সাধক -গায়ক হয়ে উঠলেন। পান্নালাল জীবদ্দশায় ৩৬ টি আধুনিক গান সমেত ১৮ টি রেকর্ড, ৩ টি বাংলা ছায়াছবির গান এবং চল্লিশটি শ্যামাসঙ্গীতের রেকর্ড করেছেন।"শ্রী অভয়" নাম দিয়ে তার লেখা ও সুর দেওয়া বেশ কিছু শ্যামাসঙ্গীত আছে।
তার জনপ্রিয় শ্যামাসঙ্গীত গুলি হল -
- আমার চেতনা চৈতন্য করে
- আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছু জানিনে মা
- আমি সকল কাজের পাই হে সময়
- অপার সংসার নাহি পারাপার
- ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়
- চাই না মা গো রাজা হতে
- আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়
- আমার মায়ের পায়ে জবা হয়ে
- তুই নাকি মা দয়াময়ী
- তুই যে কেমন দয়াময়ী
- সকলই তোমারি ইচ্ছা
- আমায় দে মা পাগল করে
- মুছিয়ে দে মা আমার এ দুটি নয়ন
- মনেরই বাসনা শ্যামা ইত্যাদি। [২]
ব্যক্তিগত জীবন
সম্পাদনাপান্নালাল বিবাহ করেছিলেন এবং স্ত্রী কন্যাদের সাথে পারিবারিক অবস্থা ও সম্পর্ক ভালই ছিল। কিন্তু তার অকাল প্রয়াণে তার পরিবারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গ্রহণ করেন।
জনপ্রিয়তার শিখরে
সম্পাদনাবাঙালি হিন্দুদের কাছে কালীপূজা বা শ্যামাপূজা ও পান্নালাল ভট্টাচার্যের গান সমার্থক। তার গানের মধ্য দিয়েই যেন নিবেদিত হয় হৃদয়ের সমস্ত আকুতি বিকুতি। তাই তার ভক্তিমূলক গানের চাহিদা অনেক - সবার উপরে। অনেকে অনেক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সঙ্গীতজ্ঞ অলক রায় চৌধুরীর মতে -
" পান্নালাল ভট্টাচার্যের সব থেকে বড় গুণ, তার গান শেষ হওয়ার পরেও একটা রেশ থেকে যায়।"
বিশিষ্ট নজরুলগীতি শিল্পী সুস্মিতা গোস্বামীর মাপকাঠিতে পান্নালাল হলেন -
নিজের মতো করে মাকে ডাকা, ওই নিবেদনের আর্তি আর কারও মধ্যে খুঁজে পাইনি"
পান্নালাল ভট্টাচার্যের শ্যামাসঙ্গীতের সাফল্যে সঙ্গীত গবেষক সর্বানন্দ চৌধুরীর বিশ্লেষণ-
" এক অদ্ভুত মায়া আছে তার উচ্চারণে। দ্বিতীয়ত, তার গায়কির মধ্যে রয়েছে সারল্য"
শেষ দিনগুলি ও জীবনাবসান
সম্পাদনাপান্নালাল কোনোদিন নিজেকে নিয়ে, নিজের গান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। তার ভ্রাতা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য মা ভবতারিণী দর্শন পেতেন, কিন্তু তার কোনদিন সেরকম মাতৃদর্শন হয়নি। সেকারণে শিশুর মতো তিনি কাঁদতে কাঁদতে মা কে ডাকতেন। দেবীদর্শন না করতে পাওয়ার অবসাদে, অতৃপ্তি নিয়ে তিনি আত্মহনন করেন ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মার্চ (১৩৭২ বঙ্গাব্দের ১৩ চৈত্র) কলকাতার কাকুলিয়া রোডের বাড়িতে ৩৬ বৎসর বয়সে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬ পৃষ্ঠা ৩৯১, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
- ↑ "কেন মাত্র ৩৬-এই আত্মহত্যা করেছিলেন 'ঘোরতর সংসারী' পান্নালাল ভট্টাচার্য?"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-২৬।
- ↑ "শ্যামামণ্ডপে আজও সুপারহিট পান্নালাল"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-২৬।