পাগলা কানাই বা কানাই শেখ (জন্ম: ১৮০৩-মৃত্যু: ১৮৯২) আধ্যাত্নিক চিন্তা চেতনার সাধক-অসংখ্য দেহতত্ত্ব, জারি, বাউল, মারফতি, ধূয়া, মুর্শিদি গানের স্রষ্টা।[১][২][৩]

পাগলা কানাই
জন্ম
কানাই শেখ

২৫ শে ফাল্গুন ১২০৯ (১০ মার্চ ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দ)
লেবুতলা, ঝিনাইদহ মহকুমার, যশোর জেলা বর্তমানে বাংলাদেশ
মৃত্যু২৮ শে আষাঢ় ১২৯৯ (১২ জুলাই ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দ)
জাতীয়তাবৃটিশ ভারতীয়
পেশাবাউল
পরিচিতির কারণগীতিকবি, ধুয়া জারী

জীবনী সম্পাদনা

পাগলা কানাই ১৮০৩ সালে তৎকালীন যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার, বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার, বেড়বাড়ি গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম কুড়ন শেখ, মায়ের নাম মোমেনা খাতুন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে কানাই সবার বড়। ভাইয়ের নাম উজোল শেখ, বোন স্বরনারী। বাল্যকালেই তার বাবা কুড়ন শেখ মারা যান। পিতৃহারা হয়ে কানাই ভবঘুরে হয়ে যান। জীবনের তাগিদে মোমেনা খাতুন কোনো উপায়ান্তর না দেখে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চেউনে ভাটপাড়া গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তিনিও মারা গেলে বোন স্বরনারী দুই ভাইকে নিজের আশ্রয়ে বেড়বাড়ি নিয়ে আসেন। বোনের শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো হওয়াতে কানাইয়ের গান চর্চার রাস্তা আরও সহজ হয়। কানাই বোনের বাড়ির গরুর পাল চরাতেন আর গান বাঁধতেন, তাতে সুর দিতেন।[৪] [৫]ছোটবেলা থেকেই পাগলাকানাই দুরন্ত প্রকৃতির, পাগলাটে স্বভাবের এবং আধ্যাত্ম প্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। এ খেয়ালীপনার জন্যে শৈশবে স্নেহবশতঃ লোকে তার নামের সাথে "পাগলা' অভিধাটি (উপনাম) যুক্ত করে। তার কর্মকীর্তির সাথে এ পাগলা উপাধিটি অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত হয়েছে।[৬]

কর্ম জীবন সম্পাদনা

সুর দেওয়া হয়ে গেলে আপন মনে গলা ছেড়ে তা গাইতেন। অস্থির পাগল এই স্বভাবকবির কোনো জায়গায় বেশি দিন ভালো লাগত না। গরু চরানো রেখে কাজ নেন মাগুরা জেলার আঠারখাদার জমিদার চক্রবর্তী পরিবারের বেড়বাড়ির নীলকুঠিতে। দুই টাকা বেতনের সেই খালাসির চাকরি বেশি দিন করা হয়ে ওঠেনি। গানের টানে চাকরি ছেড়ে পথে বের হন আবারও।[৭]

গরু চরাতে গিয়ে ধুয়ো জারীগান গাইতেন এবং উপস্থিত সবাই তার সঙ্গীত মুগ্ধ হয়ে শুনত। এভাবে ধুয়োজারীতে তার হাতে খড়ি হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তার কোন সঙ্গীত শিক্ষা না থাকলেও এখানকার তৎকালীন আউল-বাউল, সাধু-ফকির প্রভৃতি গুণীজনের পদচারণা সর্বোপরি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির আত্মার আত্ম-জিজ্ঞাসা ও আত্ম-অন্বেষণ তাকে প্রখর অধ্যাত্মজ্ঞানে পরিপূর্ণ করে তোলে। তার গানে ইসলাম ও আল্লাহর প্রিয় নবীর, মুহাম্মাদ , প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ পায়। পাগলা কানাই নিরক্ষর হলেও তার স্মৃতি ও মেধা ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে একের পর এক গান রচনা করতে পারতেন।[৬] তিনি যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা রাজশাহী, বগুড়া প্রভৃতি স্থানে আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ গান গেয়ে বেড়াতেন।[৮]

এ পর্যন্ত পাগলা কানাই রচিত গানের মধ্য মাত্র শ'তিনেক সংগৃহীত হয়েছে। মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, ড, মাযহারুল ইসলাম, আবু তালিব, আমিন উদ্দিন শাহ, দুর্গাদাস লাহিড়ী, উপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্য প্রমুখ মনীষীগণ পাগলা কানাইয়ের গানের সংগ্রহ ও গবেষণা করেছেন।

শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

গ্রামের মক্তবে তিনি কিছুদিন পড়াশোনা করলেও চঞ্চল স্বভাবের জন্যে তার লেখাপড়া বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে তার রচিত একটি গানের মধ্যেই তার স্বভাবসুলভ অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়।[৯]

বাউলজীবন সম্পাদনা

তৎকালীন সময়ে কবিত্ব প্রতিভায় লালনের পরেই তার স্থান নিরূপণ করা যায়। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও আধ্যাত্নিক চেতনায় জ্ঞানান্বিত হয়ে অপরূপ সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে দোতারা হাতে ঘুরে ফিরেছেন তিনি। তার কণ্ঠের একটি গান আজও উচ্চারিত হয় মানুষের মুখে মুখে।

পাগলা কানাই ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণ অনুসারী ছিলেন এবং ইসলাম ধর্মের বিধি বিধানগুলি সঠিকভাবে মেনে চলতেন। তার বিভিন্ন গানের মধ্য দিয়ে তার এই অভিব্যক্তি পরিস্ফুটিত হয়েছে।

যশোর জেলার কেশবপুরের রসুলপুর গ্রামের নয়ন ফকিরকে তার ওস্তাদ বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এই স্বভাব কবির সর্বাপেক্ষা পদচারণা ছিল ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। পরবর্তীতে তিনি ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফিরে পাবনা ও সিরাজগঞ্জে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। পাবনার বিখ্যাত ভাবুক কবি ফকির আলীমুদ্দীনের সাথে তার আন্তরিক সখ্যতা গড়ে ওঠে।

এ সকল অঞ্চলের বিভিন্ন আসরে গান বেঁধে বিভিন্ন ভঙ্গীতে পরিবেশন করে হাজার হাজার শ্রোতাকুলকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সম্মোহিত করে রাখতেন পাগলা কানাই। তার কন্ঠস্বর ছিল অত্যন্ত জোরালো মধুর। ৩০/৩৫ হাজার স্রোতা তার গান মাইক ছাড়াই শুনতে পেত। তার জনপ্রিয় আধ্যাত্নিক গানের কয়েকটি লাইন।[৯]

পরলোক গমন সম্পাদনা

বাংলার পথে, দোতারা হাতে, গান গেয়ে ফেরা মরমী গীতিকবি পাগলা কানাই ১৮৮৯ (বাংলা ১২৯৬ সালের ২৮ আষাঢ়) সালে মৃত্যুবরণ করেন।[১০]

পাগলা কানাইয়ের চর্চা সম্পাদনা

বর্তমানে ঝিনাইদহে পাগলা কানাই "স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ" পাগলা কানাইয়ের সৃষ্টির গবেষণা এবং প্রচারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পাগলা কানাই সঙ্গীত একাডেমী অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও পাগলা কানাইয়ের গানের নিয়মিত চর্চা করে যাচ্ছে।

মুলতঃ আল্লাহ ও তার রাসুল পাক (সাঃ) কে নিয়ে পাগলা কানাই একাধিক গান রচনা করেছেন। তার গানে ছিল মুসলিম জাগরণের আহবান। সঠিক নিয়মে নামাজ পড়ে শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এঁর দ্বীনকে আকড়ে ধরার মধ্যে দিয়ে শ্রষ্ঠার মহত্ব প্রচার করেছেন তিনি। তাইতো তিনি গেয়েছেন-

“নবীজির এই ভাঙ্গা তরী

শরিয়তে বোঝাই ভারি গো,

ইমাম হাসান হোসাইন,

দুই ভাই মিলে, তরী খুলে ভিড়াই কিনারায়

কি ফুল ফুটিল রে মক্কায়”

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "পাগলা কানাই"। সংগ্রহের তারিখ ৭ জুন ২০২০ 
  2. Rahman, Azibor (১৩ মার্চ ২০০২)। "Pagla Kanai's 202nd birth anniversary observed"The Daily Star। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ 
  3. মিন্টু, মুহ.মু'তাছিম বিল্লাহ (২০১৭)। চারণ কবি পাগলা কানাই। ঝিনাইদহ: বেগবতী প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৭২। আইএসবিএন 978-984-8965-64-1 
  4. খেয়ালি বাউল পাগলা কানাই ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১০ জুন ২০২০ তারিখে, প্রথম আলো পত্রিকা, লেখক : ইমরান উজ-জামান, সংগ্রহের তারিখ ৩রা মার্চ ২০১২।
  5. মিন্টু, মুহ.মু'তাছিম বিল্লাহ (২০১৭)। চারণ কবি পাগলা কানাই। ঝিনাইদহ: বেগবতী প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ২২–৩৩। আইএসবিএন 978-984-8965-64-1 
  6. ঝিনাইদহের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে, কবি পাগলা কানাই।
  7. Debnath, Bipul (২২ জুলাই ২০১৬)। "Pagla Kanai: Pioneer of mystical songs"The Independent। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ 
  8. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ১১৭, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  9. যশোর.ইনফো ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ জুন ২০১৩ তারিখে, কবি পাগলা কানাই, লেখক : কাজী শওকত শাহী, সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ২০১২।
  10. Hossain, Zahid (১০ মার্চ ২০১৬)। "Pagla Kanai remembered"Daily Sun। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা