পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন, ১৯৮২

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন, ১৯৮২ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভার সদস্যদের নির্বাচিত করার জন্য। পূর্ববর্তী বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভকারী বামফ্রন্ট এই নির্বাচনেও জয়লাভ করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আই) রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের স্থান অধিকার করে এবং জনতা পার্টি বিভিন্ন অংশে খণ্ডিত হতে শুরু করে।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন, ১৯৮২

← ১৯৭৭ মে ১৯৮২ ১৯৮৭ →

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ২৯৪ টি আসনে
সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য দরকার ১৪৮টি আসন
  সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিরোধী দল
 
নেতা/নেত্রী জ্যোতি বসু সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়
দল সিপিআই(এম) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আর)
জোট বামফ্রন্ট
গত নির্বাচন ১৭৮ ২০
আসন লাভ ১৭৪ ৪৯
আসন পরিবর্তন হ্রাস বৃদ্ধি ২৯
জনপ্রিয় ভোট ৮,৬৫৫,৩৭১ ৮,০৩৫,২৭২
শতকরা ৩৮.৪৯% ৩৫.৭৩%
সুইং বৃদ্ধি ৩.০৩% বৃদ্ধি ১২.৭১%

নির্বাচনের পূর্বে মুখ্যমন্ত্রী

জ্যোতি বসু
বামফ্রন্ট

নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী

জ্যোতি বসু
বামফ্রন্ট

প্রেক্ষাপট সম্পাদনা

১৯৮২ সালের ৬ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনুরোধ জানায় যে, এপ্রিল মাসে রাজ্যে বর্ষার আগমনের পূর্বেই ১৫ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।[১] যদিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল মে মাসে কেরল, হিমাচল প্রদেশহরিয়াণার বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।[২]

বামফ্রন্ট সম্পাদনা

১৯৮২ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে তিন নতুন সদস্য দল বামফ্রন্টে যোগ দেয়; ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই), পশ্চিমবঙ্গ সোশ্যালিস্ট পার্টি (ডব্লিবিএসপি) ও ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট পার্টি (ডিএসপি)।[৩] বামফ্রন্ট-সদস্য কয়েকটি পুরনো ও ছোটো দল জোটের এই প্রসারের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং দাবি করে যে সিপিআই(এম) জোটটিকে রাজনৈতিকভাবে তরলীকৃত করে ফেলছে।[৩] জোটের সম্প্রসারণের পর মন্ত্রিপদ বণ্টন নিয়েই মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল।[৩]

কংগ্রেস (আই)-কংগ্রেস (সমাজতান্ত্রিক) জোট সম্পাদনা

১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আই) ছিল বহুধা-বিভক্ত একটি দল। বিভাগগুলির অস্তিত্ব ছিল রাজ্য জুড়ে প্রতিটি নিয়োগকৃত অ্যাড হক জেলা কমিটিতে।[৪]

১৯৭৮ সালে শরদ পাওয়ার প্রাক্তন পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির নাম পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি (সমাজতান্ত্রিক)-এর সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করেন।[৫] যদিও কংগ্রেস (আই) ও কংগ্রেস (সমাজতান্ত্রিক) জোটবদ্ধ হয়ে ১৯৮২ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।[৬] এই নির্বাচনে কংগ্রেস (সমাজতান্ত্রিক)-এর ফল খারাপ হয় এবং নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই কংগ্রেস (সমাজতান্ত্রিক) ও কংগ্রেস (আই)-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখা দু’টি একাঙ্গীভূত হয়।[৫]

নির্বাচনের পর কংগ্রেস (আই) বৃহত্তম বিরোধী দলে পরিণত হয়। পূর্ববর্তী নির্বাচনে জনতা পার্টির জয় করা অধিকাংশ আসন জয় করে কংগ্রেস (আই)।[৬] বিধানসভা থেকে জনতা পার্টির অস্তিত্ব বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী বহু বছর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস (আই)-এর মধ্যে মেরুকৃত অবস্থায় ছিল।[৭]

ভারতীয় জনতা পার্টি সম্পাদনা

১৯৮২ সালেই প্রথম ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল।[৮] এই দলের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ভাবীকালের তৃতীয় শক্তির একটি কেন্দ্রবিন্দু সৃষ্টি করা।[৮] পশ্চিমবঙ্গ সরকার মার্চ মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার আবেদন জানালে বিজেপি সেই আবেদনকে সমর্থন জানিয়েছিল।[৯]

গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন সম্পাদনা

১৯৮০ সালে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের উত্থানের পর দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে ‘নো স্টেট, নো ভোট’ শ্লোগান তুলে নির্বাচন বয়কটের একটি কর্মসূচি গৃহীত হয়।[১০][১১] যে সংস্থাগুলি নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল প্রান্ত পরিষদ ও সুভাষ ঘিসিং-এর গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট[১২] দার্জিলিং অঞ্চলে ভোটদানের হার ছিল ৫৯.৪০ শতাংশ, যেখানে সমগ্র রাজ্যে ভোট পড়েছিল ৭৬.৯৬ শতাংশ।[১৩] পার্বত্য অঞ্চলে একমাত্র সিপিআই(এম)-ই ছিল একমাত্র প্রধান দল যারা পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের বিরোধিতা করে।[১২] সিপিআই(এম) নেপালি-অধ্যুষিত চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে তিনটিতে জয়লাভ করে, চতুর্থ আসনটিতে জয়লাভ করেন নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এক অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগ নেতা।[১১]

ফলাফল সম্পাদনা

১৯৮২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২৩৮টি আসন লাভ করে জয়ী হয়।[৭] বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোটের মোট সংখ্যা ছিল ১১,৮৬৯,০০৩ (মোট প্রদত্ত ভোটের ৫২.৭ শতাংশ)।[১৩]

ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় এই নির্বাচন প্রসঙ্গে উদ্ধৃত এক অনামা পাশ্চাত্য কূটনীতিবিদের মতে, “বাঙালি গণতন্ত্র প্রকৃত প্রস্তাবেই ‘গণপ্রজাতন্ত্র’-এর পূর্ব ইউরোপীয় রূপভেদটির কাছাকাছি চলে এসেছে, যেখানে কেউই অপ্রত্যাশিত জয় বা পরাজয়ের আশা করে না।”[৬] এই নির্বাচনে বামফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেও, কয়েকটি ক্ষেত্রে বাম দলগুলি বিশেষভাবে ধাক্কা খেয়েছিল।[৬] ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের ছয় জয় মন্ত্রী নিজ নিজ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে পরাজিত হয়েছিলেন।[১৩] তথ্যমন্ত্রী তথা সিপিআই(এম) নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ৭২৮ ভোটে কংগ্রেস (আই) প্রার্থী প্রফুল্লকান্তি ঘোষের কাছে পরাজিত হন।[৬][১৩] শিক্ষামন্ত্রী তথা সিপিআই(এম) নেতা পার্থ দে (যিনি প্রাথমিক পাঠ্যক্রম থেকে ইংরেজি ভাষা তুলে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছিলেন) বাঁকুড়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে পরাজিত হন।[৬] খাদ্যমন্ত্রী তথা ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (আরসিপিআই) নেতা সুধীন্দ্রনাথ কুমার হাওড়া মধ্য বিধানসভা কেন্দ্র থেকে পরাজিত হন।[১৪] অর্থমন্ত্রী তথা বিশিষ্ট সিপিআই(এম) নেতা অশোক মিত্র রাসবিহারী অ্যাভিনিউ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস (আই) প্রার্থী হৈমী বসুর কাছে পরাজিত হন।[৬] অশোক মিত্র অর্থমন্ত্রী হিসেবে সঞ্চয়িতা সেভিংস কোম্পানির বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। এই কোম্পানির ‘গেট-রিচ-কুইক’ স্কিমের প্রায় ৪,০০০ আমানতকারী ছিলেন তাঁর কেন্দ্রের ভোটার।[৬]

কলকাতার ২২টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ১১টিতে কংগ্রেস (আই) জয়লাভ করতে সমর্থ হয়।[৬] প্রভিশনাল সেন্ট্রাল কমিটি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী)-র সন্তোষ রাণা গোপীবল্লভপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সিপিআই(এম)-এর কাছে পরাজিত হন।[১৩]

১৯৮২ সালের ২৪ মে নবম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা গঠিত হয়।[১৫] সিপিআই(এম) নেতা জ্যোতি বসু দ্বিতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।[৬][১৬] সিপিআই(এম) নেতা হাসিম আব্দুল হালিম বিধানসভার অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন, এই পদটি তিনি ২০১১ সাল পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন।[১৭]

রাজনৈতিক দল প্রার্থীসংখ্যা প্রাপ্ত আসন প্রাপ্ত ভোট %
বামফ্রন্ট ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) ২০৯ ১৭৪ ৮,৬৫৫,৩৭১ ৩৮.৪৯
সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক ৩৪ ২৮ ১,৩২৭,৮৪৯ ৫.৯০
বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল ২৩ ১৯ ৯০১,৭২৩ ৪.০১
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১২ ৪০৭,৬৬০ ১.৮১
ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ১০৬,৯৭৩ ০.৪৮
মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক ৮০,৩০৭ ০.৩৬
বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস ৩৪,১৮৫ ০.১৫
পশ্চিমবঙ্গ সোশ্যালিস্ট পার্টি
ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট পার্টি
১০ ৩৫৪,৯৩৫ ১.৫৮
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আই) ২৫০ ৪৯ ৮,০৩৫,২৭২ ৩৫.৭৩
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (সমাজতান্ত্রিক) ২৮ ৮৮৫,৫৩৫ ৩.৯৪
সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়া ৩৪ ২৩২,৫৭৩ ১.০৩
জনতা পার্টি ৯৩ ১৮৭,৫১৩ ০.৮৩
ভারতীয় জনতা পার্টি ৫২ ১২৯,৯৯৪ ০.৫৮
ভারতীয় ইউনিয়ন মুসলিম লিগ ১২৯,১১৬ ০.৫৭
লোক দল ১৬ ২২,৩৬১ ০.১০
ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ১,২৬৮ ০.০১
নির্দল ৪৩২ ৯৯৪,৭০১ ৪.৪২
মোট ১,২০৪ ২৯৪ ২২,৪৮৭,৩৩৬ ১০০
সূত্র: ভারতের নির্বাচন কমিশন[১৮]

তথসূত্র সম্পাদনা

  1. Report on the Election to the Office of President of India, 1982 and Legislative Assemblies, Delhi Metropolitan Council, 1982–83: Narrative। Election Commission of India। ১৯৮৩। 
  2. The Commonwealth Yearbook। H.M. Stationery Office। ১৯৯১। পৃষ্ঠা 216। 
  3. Amrita Basu (১ অক্টোবর ১৯৯৪)। Two Faces of Protest: Contrasting Modes of Women's Activism in India। University of California Press। পৃষ্ঠা 44। আইএসবিএন 978-0-520-08919-8 
  4. India Today. Year of reckoning
  5. Stig Toft Madsen; Kenneth Bo Nielsen; Uwe Skoda (২০১১)। Trysts with Democracy: Political Practice in South Asia। Anthem Press। পৃষ্ঠা 165। আইএসবিএন 978-0-85728-773-1 
  6. India Today. West Bengal: Keeping to the Left
  7. N. Jose Chander (১ জানুয়ারি ২০০৪)। Coalition Politics: The Indian Experience। Concept Publishing Company। পৃষ্ঠা 106। আইএসবিএন 978-81-8069-092-1 
  8. Pratap Chandra Swain (২০০১)। Bharatiya Janata Party: Profile and Performance। APH Publishing। পৃষ্ঠা 194। আইএসবিএন 978-81-7648-257-8 
  9. The Annual Register of Indian Political Parties। Michiko & Panjathan। ১৯৮২। পৃষ্ঠা 108। 
  10. Amiya K. Samanta (২০০০)। Gorkhaland Movement: A Study in Ethnic Separatism। APH Publishing। পৃষ্ঠা 274। আইএসবিএন 978-81-7648-166-3 
  11. Snehamoy Chaklader (২০০৪)। Sub-regional movement in India: with reference to Bodoland and Gorkhaland। K.P. Bagchi & Co.। পৃষ্ঠা 85। আইএসবিএন 978-81-7074-266-1 
  12. India Today. Nepalis: Demanding a voice
  13. Election Commission of India. STATISTICAL REPORT ON GENERAL ELECTION, 1982 TO THE LEGISLATIVE ASSEMBLY OF WEST BENGAL
  14. India Today. West Bengal: Seating scrap
  15. State Legislative Assembly West Bengal. West Bengal Legislative Assembly Under the constitution of India
  16. PEU GHOSH (৩ সেপ্টেম্বর ২০১২)। Indian Government and Politics। PHI Learning Pvt. Ltd.। পৃষ্ঠা 331। আইএসবিএন 978-81-203-4649-9 
  17. Ganashakti. Lal Salam Comrade Halim ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২১ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে
  18. West Bengal (India). Legislature. Legislative Assembly (জুলাই ১৯৮৩)। List of Members। Superintendent, Government Print.। পৃষ্ঠা 9।