পরিপাক
পরিপাক (ইংরেজি: Digestion) হচ্ছে একটা জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া, এ প্রক্রিয়ায় জটিল খাদ্যবস্তু উৎসেচকের সহায়তায় ভেঙে জীব দেহের বিপাকক্রিয়ার ব্যবহারযোগ্য সরল, দ্রবণীয় ও শোষণযোগ্য অবস্থায় পরিবর্তিত করে। পরিপাকের দ্বারা খাদ্য বস্তু ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খাদ্য বস্তুতে পরিনত হয় এবং তরল আকারে রক্ত ও প্লাজার মধ্যে শোষিত হতে পারে। কিছু প্রাণীর মধ্যে, এই ক্ষুদ্র পদার্থগুলি ছোট ছোট অণুর আকারে রক্ত প্রবাহে শোষিত হয়। পরিপাক একটি ভাঙ্গন মূলক পদ্ধতি যা প্রায়ই খাদ্যের ভাগাভাগির উপর ভিত্তি করে দুটি প্রক্রিয়াতে বিভক্ত হয়: যান্ত্রিক এবং রাসায়নিক পরিপাক। যান্ত্রিক পরিপাক হল বৃহৎ খাদ্য কণাকে ছোট আকারে খাদ্যের কণায় পরিণত করা যা পরবর্তীতে পাচক উৎসেচক দ্বারা অ্যাক্সেস করতে পারে। রাসায়নিক পরিপাক হল উৎসেচকের দ্বারা খাদ্য বস্তুকে ছোট অণুতে পরিণত করা এবং তা দেহে শোষিত হয়।
পরিপাক ব্যবস্থা | |
---|---|
![]() | |
বিস্তারিত | |
শনাক্তকারী | |
লাতিন | systema digestorium |
মে-এসএইচ | D004063 |
শারীরস্থান পরিভাষা |
মানুষের পাচনতন্ত্রের মধ্যে, খাদ্য মুখের মাধ্যমে প্রবেশ করে এবং মুখবিবরে যান্ত্রিক পরিপাক শুরু হয় মুখবিবরে থাকা লালাগন্থীর লালার দ্বারা। স্যালিভারি লালা তরল আকারে নির্গত হয় স্যালিভারি গন্থি থেকে। এই লালায় স্যালিভারি আমাইলেজ থাকে যা খাবারে শর্করা পরিপাক শুরু করে; লালা এছাড়াও মিউকাস রয়েছে, যা খাদ্য পিচ্ছিল করে এবং হাইড্রোজেন কার্বোনেট, যা অ্যামাইলেজের কাজের জন্য আদর্শ পিএইচ (alkaline) অবস্থার প্রদান করে। দন্ত দ্বারা খাদ্য চূর্ন এবং শর্করা পরিপাকের পর, খাদ্য দ্রব্য ছোট, গোলাকার বলের আকারে থাকবে যাকে বোলাস বলা হয়। এটি তারপর গ্রাসনালি দ্বারা পাকস্থলিতে পৌচ্ছায় পেরেস্টোলেসিসের দ্বারা। পাকস্থলির মধ্যে পাকরস প্রোটিনের পরিপাক শুরু করে। পাকরসে প্রধানত হাইড্রোক্লোরিক এসিড (HCL) এবং পেপসিন থাকে। যেহেতু এই দুই রাসায়নিকগুলি পাকস্থলির ত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে ত্বকের দ্বারা শ্লেষ্মা ক্ষরিত হয়, যা একটি পাতলা স্তর প্রদান করে এবং রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাবগুলির বিরুদ্ধে একটি ঢাল হিসেবে কাজ করে। একই সময়ে প্রোটিন পরিপাক হয়, সঙ্গে যান্ত্রিক ভাবে খাদ্য দ্রব্য মিশ্রিত হয় যা পেরেস্টোলেসিসের দ্বারা ঘটে, এবং এই পেরেস্টোলেসিস ঘটে পেশী সংকোচনের দ্বারা। এটি খাদ্য কণাকে আরও পুষ্টিকর উৎসোচকের সাথে মিশ্রিত হতে সাহায্য করে।
কিছু সময় পরে (সাধারণত মানুষের মধ্যে ১-২ ঘণ্টা, কুকুরের মধ্যে ৪-৬ ঘণ্টা, বাড়ির বিড়ালের ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে), পুরু তরলকে বলা হয় পাকমণ্ড। যখন পাইলোরিক স্ফিংটার ভালভ প্রর্দশিত হয়, তখন পাকমণ্ডটি ডিওডিনামে প্রবেশ করে যেখানে এটি যকৃতে থেকে পিত্তরস এবং অগ্ন্যাশয় থেকে অগ্ন্যাশয়রসের পাচক এনজাইমের সাথে মিশে যায় এবং তারপর ক্ষুদ্রান্তের মধ্য দিয়ে যায়, যেখানে পরিপাক চলতে থাকে। যখন খাদ্য দ্রব্য সম্পূর্ণভাবে পরিপাক হয়ে যায়, তখন এটি রক্তে শোষিত হয়। পুষ্টি রস শোষণের ৯৫% ক্ষুদ্রান্তের মধ্যে ঘটে থাকে। জল এবং খনিজ দ্রব্য কোলনে (বৃহৎ অন্ত্র) শোষিত হয়। কিছু ভিটামিন, যেমন বায়োটিন এবং ভিটামিন কে (K2MK7) কোলন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা উৎপাদিত হয় এবং রক্তে শোষিত হয়। শেষে মলদ্বার থেকে বর্জ্য উপাদান বহিষ্কিত হয়।[১]
পৌষ্টিক তন্ত্রসম্পাদনা
যে তন্ত্রের মাধ্যমে পরিপাক ও শোষণ ক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাকে পৌষ্টিক তন্ত্র বলে। মানব দেহের পৌষ্টিক তন্ত্র পৌষ্টিকনালী ও সংশ্লিষ্ট পৌষ্টিক গ্রন্থিগুলো নিয়ে গঠিত।
পৌষ্টিক তন্ত্র নানা রূপে দেখা যায়। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক পরিপাকের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। বিবর্তনীয় ইতিহাসে বহিরাগত পরিপাক পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে, এবং অধিকাংশ ফুঙ্গ এখনও এটির উপর নির্ভর করে।[২] এই প্রক্রিয়াতে, উৎসেচকগুলি জীবের চারপাশে পরিবেশে ক্ষরন করে, যেখানে তারা জৈব পদার্থকে ভেঙে দেয়, এবং কিছু কিছু জীবে তা ফিরে যায়। এইসব জন্তুগুলির একটি নল (গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাফ্ট) থাকে যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ পরিনাক হয়, যা আরও কার্যকরী হয় কারণ ভাঙা পদার্থগুলি আরও অধিকৃত হয় এবং অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক পরিবেশ আরো দক্ষতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।[৩]
প্রায় সব মাকড়সা সহ কিছু জীব, কেবল উদ্ভিদ "স্যুপ" এর আহারের আগে জৈব এবং পাচক রাসায়নিকগুলি (যেমন, উৎসেচক) বহিরাগত পরিবেশে ক্ষরিত হয়। একবার সম্ভাব্য পুষ্টি বা খাদ্য জীবের পরিপাকের একটি নলের মাধ্যমে অথবা বিশেষ অঙ্গগুলি দ্বারা পুষ্টিরস শোষণ আরও দক্ষ করার লক্ষ্যে একটি ভাঁজ বা একটি শাখা মত গঠন পরিচালিত হতে পারে।
পৌষ্টিক নালীসম্পাদনা
মানুষের পৌষ্টিকনালী মুখ থেকে পায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত ৮-১০ মিটার লম্বা। এটি নিম্নলিখিত অংশ নিয়ে গঠিত।
- মুখ
- মুখবিবর
- গলবিল
- অন্ননালী
- পাকস্থলী
- ক্ষুদ্রান্ত্র
- বৃহদান্ত্র
- মলাশয়
- পায়ু
পৌষ্টিক গ্রন্থিসম্পাদনা
যেসব গ্রন্থির ক্ষরণ খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে, সে সব গ্রন্থিকে পৌষ্টিকগ্রন্থি বলে। মানবদেহের কয়েকটি পৌষ্টিকগ্রন্থি সুস্পষ্ট গঠন ও অবস্থান নিয়ে থাকলেও কিছু গ্রন্থি পৌষ্টিকনালীর বিভিন্ন অংশে বিক্ষিপ্ত থাকে। নির্দিষ্ট গঠন ও অবস্থানের পৌষ্টিকগ্রন্থি
কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্যের পরিপাকসম্পাদনা
কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্যের পরিপাকে যেসব এনজাইম অংশ নেয়, তা নিম্নরূপ।
- টায়ালিন
- মল্টেজ
- অ্যামাইলেজ
- সুক্রেজ
- ল্যাকটেজ
- আইসোমলটেজ
এসব এনজাইমের ক্রিয়ায় কার্বোহাইড্রেট ভেঙে সরল গ্লুকোজে পরিণত হয়।কার্বোহাইড্রেটের পরিপাক মূলত মুখগহ্বর থেকেই শুরু হয়। পরিপাক-কৃত ও অপরিপাক-কৃত কার্বহাইড্রেট পেরিস্টালসিস প্রক্রিয়ায় খাদ্যনালি দিয়ে পাকস্থলিতে পৌছায়। উল্লেখ্য যে,কার্বোহাইড্রেট পাকস্থলিতে পরিপাক হয় না। এগুলো পরিপাক হওয়ার জন্য যে এনজাইম প্রয়োজন তা পাকস্থলী থেকে হয় না। কার্বোহাইড্রেট সম্পূর্ণভাবে পরিপাক হয় ক্ষুদ্রান্তে।
পরিপাক স্থল | উৎসেচক | যার উপর ক্রিয়া করে | বিক্রিয়া লব্ধ পদার্থ |
---|---|---|---|
মুখবিবর | টায়ালিন | সিদ্ধ শ্বেতসার যেমন ভাত ও সিদ্ধ আলু | মলটোজ, আইসোমলটোজ, মলটোট্রায়োজ |
মলটেজ | মলটোজ | ২ অণু গ্লুকোজ | |
পাকস্থলী | হাইড্রোক্লোরিক এসিড(উৎসেচক নয়) | সুক্রোজ | গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ |
ক্ষুদ্রান্ত্র (অগ্ন্যাশয় রস) | প্যানক্রিয়াটিক অ্যামাইলেজ | শ্বেতসার ও ডেক্সট্রিন | মল্টোজ |
মলটেজ | |||
আন্ত্রিক রস | সুক্রেজ (চিনি,গুড় ) | সুক্রোজ | ১ অণু গ্লুকোজ ও ১ অণু ফ্রুক্টোজ |
ল্যাক্টেজ | ল্যাক্টোজ (দুগ্ধ শর্করা) | ১ অণু গ্লুকোজ ও ১ অণু গ্যালাকটোজ | |
ইনটেসটিনাল অ্যামাইলেজ | শ্বেতসার ও ডেক্সট্রিন | মল্টোজ | |
মলটেজ | মল্টোজ | ২ অণু গ্লুকোজ |
প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের পরিপাকসম্পাদনা
প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের পরিপাকে যেসব এনজাইম অংশ নেয়, তা নিম্নরূপ।
- পেপ্সিনোজেন (হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সংস্পর্শে সক্রিয় প্যাপইনেজ পরিণত হয়)
- ট্রিপসিন
- কার্বোক্সিপেপ্টাইডেজ
- ইলাস্টেজ
- কোলাজিনেজ
- অ্যামাইনোপেপ্টাইডেজ
- ট্রাইপেপ্টাইডেজ
- প্রোলিডেজ
এসব এনজাইমের ক্রিয়ায় প্রোটিন ভেঙে সরল অ্যামিনো এসিডে পরিণত হয়।
লিপিড জাতীয় খাদ্যের পরিপাকসম্পাদনা
লিপিড জাতীয় খাদ্যের পরিপাকে যেসব এনজাইম অংশ নেয়, তা নিম্নরূপ।
- লাইপেজ
- ফসফোলাইপেজ
- কোলেস্টেরলেজ
- লেসিথিনেজ
- মনোগ্লিসারিডেজ
এসব এনজাইমের ক্রিয়ায় লিপিড ভেঙে সরল ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলে পরিণত হয়।
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ Maton, Anthea; Jean Hopkins; Charles William McLaughlin; Susan Johnson; Maryanna Quon Warner; David LaHart; Jill D. Wright (১৯৯৩)। Human Biology and Health। Englewood Cliffs, New Jersey, USA: Prentice Hall। আইএসবিএন 0-13-981176-1। ওসিএলসি 32308337।
- ↑ Dusenbery, David B. (1996). “Life at Small Scale”, pp. 113-115. Scientific American Library, New York. আইএসবিএন ০-৭১৬৭-৫০৬০-০.
- ↑ Dusenbery, David B. (2009). Living at Micro Scale, p. 280. Harvard University Press, Cambridge, Mass. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৬৭৪-০৩১১৬-৬.