নেজামে ইসলাম পার্টি

বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, যার পূর্বনাম ছিলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টিবাংলাদেশের ও উপমাহদেশের একমাত্র প্রাচীনতম একটি ঐতিহ্যবাহী ইসলামী রাজনৈতিক দল।[১]

বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি
নেতাআলহাজ্ব মাওলানা ওবায়দুল হক[২][৩]
প্রেসিডেন্টআলহাজ্ব মাওলানা ওবায়দুল হক
প্রতিষ্ঠা২০ মার্চ, ১৯৫২ ইং
সদর দপ্তর৫১,৫১/এ, পুরানা পল্টন (৬ষ্ঠ তলা), রুম নং-৬০৮, ঢাকা-১০০০ ফ‌োন ০১৭১৫ ৩৪৭৮৩৭
ভাবাদর্শইসলামী শরিয়াহ
বাংলাদেশের রাজনীতি
রাজনৈতিক দল
নির্বাচন

ইতিহাস সম্পাদনা

প্রতিষ্ঠা সম্পাদনা

১৯৪৫ সালের ২৮ ও ২৯ অক্টোবর কলিকাতার মুহাম্মদ আলী পার্কে মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সমর্থনে একটি উলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় 'নিখিল ভারত জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম' নামে একটি নতুন সংগঠন। এই নতুন জমিয়ত পাকিস্তান প্রশ্নে মুসলিম লীগের পক্ষ নেয়।

কিন্তু দেশভাগের পর মুসলীম লীগ নেতৃবৃন্দের ওয়াদা ভঙ্গের ফলে নবগঠিত পাকিস্তানে 'নেজামে ইসলাম' তথা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়া সুদূর পরাহত দেখে তারা নিরাশ হয়ে পড়েন। এক প্রকার প্রতারিত হয়েই ১৯৫২ সালে নিখিল ভারত জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের সঙ্গ ত্যাগ করে 'নেজামে ইসলাম পাটি' নামে পৃথক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

এই লক্ষ্যে '৫২ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার হয়বতনগরে দলটির কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অধিবেশনেই মাওলানা আতহার আলী (রহ.) কে সভাপতি, মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন (রহ.) কে সাধারণ সম্পাদক এবং মাওলানা আশরাফ আলী ধর্মন্ডলীকে সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত করে 'নেজামে ইসলাম পার্টি'র কার্যক্রম শুরু হয়।

যেকোন মূল্যে পাকিস্তানে নেজামে ইসলাম তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে এই পার্টির প্রধান লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয়। মুসলিম লীগের তুলনায় এই দলের নেতৃতে বড় বড় উলামা থাকায় অল্পদিনেই নেজামে ইসলাম পার্টি একটি শক্তিশালী বৃহৎ দলে পরিণত হয়।

১৯৫৪ সালের জাতীয় নির্বাচন সম্পাদনা

১৯৫৪ সালে নেজামে ইসলাম পার্টি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়। এই নির্বাচনে তাদের এককালের পৃষ্ঠপোষক ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে অপরাপর বিরোধী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। এই ফ্রন্টে নেজামে ইসলাম পার্টি ছাড়া আরও যে সব দল ছিল সেগুলো হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টি।[৪]

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল 'নৌকা'। যা বর্তমানে আওয়ামী লীগের পরিচয় চিহ্নে পরিণত হয়েছে। ফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২১-দফা দাবি সংবলিত একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করা হয়। এর ভূমিকায় বলা হয় : 'কুরআন ও সুন্নাহ-বিরোধী কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না।'

যুক্তফ্রন্ট সরকারে নেজামে ইসলাম পার্টি অংশ নেয় এবং মন্ত্রিত্ব লাভের সুবাদে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারনী ভূমিকা পালন করে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে দলটির ৩৬ জন নেতা নির্বাচিত হন।

জাতীয় পরিষদে সংসদীয় দলের নেতা ছিলেন দলীয় সভাপতি মাওলানা আতহার আলী (রহ.), এডভোকেট মৌলভী ফরিদ ছিলেন কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রী। প্রাদেশিক পরিষদের স্পীকার ছিলেন আব্দুল ওহাব খান। এছাড়া আইন, ভূমি ও শিক্ষা মন্ত্রনালয়ও ছিল নেজামে ইসলাম পার্টির মন্ত্রীদের দায়িত্বে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মদ আলী পরবর্তীতে নেজামে ইসলাম পার্টিতে যোগ দিলে তাকে দলের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়।

নেজামে ইসলাম পার্টি সম্পাদনা

১৯৫২ সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের রাজনৈতিক সেল হিসাবে নেযামে ইসলামের প্রথম অস্তিত্ব। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এভিত্তিতেই নেযামে ইসলাম ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখে। কিন্তু ১৯৬৭ সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেযামে ইসলাম সংক্ষেপে নেযামে ইসলাম নামে একটি পৃথক দল হিসাবে এর কর্মতৎপরতা শুরু করে। ১৯৬৯ সালে নেযামে ইসলামের কেন্দ্রীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে মুফতী শফী কে প্রধান উপদেষ্টা, জফর আহমদ উসমানীকে সভাপতি, আতহার আলীকে কার্যকরী সভাপতি, আব্দুল ওয়াহহাব ও মুস্তফা আল মদনীকে সহ-সভাপতি, এহতেশামুল হক থানভীকে প্রধান কায়েদ বা নেতা ও সিদ্দিক আহমদ কে সেক্রেটারী জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে নেযামে ইসলাম পার্টি প্রতিবাদ জানায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের দাবী আদায়ের সংগ্রামে ভূমিকা পালন করে। এ পর্যায়ে তারা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানী ঢাকায় ও নৌবাহিনীর সদর দফতর চট্টগ্রামে স্থানান্তরের দাবী জানায়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে নেযামে ইসলাম অংশ গ্রহণ করে। তবে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে তারা জামাতে ইসলামের সাথে এ মর্মে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে, নেযামে ইসলাম যেখানে তাদের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিবে সেখানে জামাত প্রার্থী দিবে না, আর যেখানে জামাতে ইসলাম কোন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিবে সেখানে নেযামে ইসলাম প্রার্থী দিবে না। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টি এককভাবে বিজয়ী হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। ফলে সাংবিধানিকভাবে তারা সরকার গঠনের ক্ষমতা লাভ করে। ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়ায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। এ সময় নেযামে ইসলামের কর্মতৎপরতাও বন্ধ থাকে। ১৯৮১ সালে ছিদ্দিক আহমদের আহ্বানে এদলটি আবার সংগঠিত হয়। ছিদ্দিক আহমদকে সভাপতি, মঞ্জুরুল আহসানকে সেক্রেটারী ও আশরাফ আলীকে সহকারী সেক্রেটারী এবং সরওয়ার কামাল আজিজীকে প্রচার ও জনকল্যাণ সম্পাদক করে দলের নতুন অবকাঠামো ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচনে সিদ্দিক আহমদকে উপদেষ্টা, আব্দুল মালেক হালিমকে সভাপতি, আতাউর রহমান ও সরওয়ার কামালকে সহ-সভাপতি, আশরাফ আলীকে সাধারণ সম্পাদক ও নুরুল হক আরমানকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়। এ সময় দলটিতে আরেক বার নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল। তখন দলটি বেশ কিছু সমাজ সেবামূলক কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। ১৯৮৮ সালের দলীয় নির্বাচনে আশরাফ আলীকে সভাপতি ও আব্দুর রকীবকে সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৮৯ সালে আশরাফ আলী সভাপতি ও নুরুল হক আরমান সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৯৩ সালে দলীয় নির্বাচনে আশরাফ আলী পুনঃসভাপতি মনোনীত হন এবং এডভোকেট আব্দুর রকীবকে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত করা হয়। ১৯৯৭ এর নির্বাচনে এডভোকেট আব্দুর রকীবকে সভাপতি ও সাংবাদিক আব্দুল লতীফ নেযামীকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।[৫]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা