নৃসিংহ জয়ন্তী

নৃসিংহ চতুর্দশী, হিন্দু পবিত্র দিন

নৃসিংহ জয়ন্তী (সংস্কৃত: नरसिंहजयंती) একটি হিন্দু উৎসব, যা হিন্দু পঞ্জিকার বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে উদযাপিত হয়।[২] বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার নৃসিংহ শক্তি ও পরাক্রমের প্রতীক। এই দিনে ভগবান বিষ্ণু তাঁর ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করার জন্য অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক সিংহের দেহ ধারণ করেন এবং রাক্ষস রাজা হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন।[৩][৪][৫][২] যা অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির জয় নির্দেশ করে।[৫] এটি নৃসিংহ চতুর্দশী, নরসিংহ চতুর্দশী বা নরসিংহ জয়ন্তী নামেও পরিচিত।

নৃসিংহ জয়ন্তী
নরসিংহের হিরণ্যকশিপুকে বধ করার ১৮শ শতাব্দীর চিত্র
অন্য নামনরসিংহ জয়ন্তী, নরসিংহ চতুর্দশী, নৃসিংহ চতুর্দশী
পালনকারীহিন্দু, বিশেষ করে বৈষ্ণব
তাৎপর্যঅশুভর উপর শুভর জয়
পালনপূজা, উপবাস, মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠান, দান, প্রহ্লাদ চরিত্র পাঠ
তারিখবৈশাখী শুক্লা চতুর্দশী[১]
সংঘটনবার্ষিক

কিংবদন্তী সম্পাদনা

ঋষি কাশ্যপের পুত্র হিরণ্যকশিপু। তিনি কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করেছিলেন এবং বর পেয়েছিলেন যে দেবতা, দেবী, পুরুষ, নারী, অসুর, যক্ষ বা অন্য কোন প্রাণী তাকে হত্যা করতে পারবে না, না দিনে, না রাতে, না বিকেলে, না ঘরে, না বাইরে, না আকাশে, না পাতালে, না অস্ত্র দিয়ে। এই বর পেয়ে দাম্ভিকতায় তিনি নিজেকে ভগবান মনে করতে শুরু করলেন। হিরণ্যকশিপু তাঁর প্রজাদের নির্যাতন ও শোষণ করতেন শুরু করে। তিনি বিশেষভাবে ভগবান বিষ্ণুর ভক্তদের উপর ক্রুদ্ধ হতেন। তবে তার পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। হিরণ্যকশিপু বিষয়টি জানতে পেরে প্রহ্লাদকে নানাভাবে বুঝিয়ে যে, তার পিতা হলেন ঈশ্বর, তাকেই পুজো করা উচিত। কিন্তু প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুর প্রতি তাঁর ভক্তি ত্যাগ করেননি। হিরণ্যকশ্যপ এটাকে অপমান মনে করে প্রহ্লাদকে হত্যা করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন বহুবার, কিন্তু শ্রীহরি বিষ্ণুর কৃপায় তিনি রক্ষা পান বারবার। হিরণ্যকশ্যপ তার বোন হোলিকার সাহায্যে প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন।

অবশেষে ক্ষিপ্ত হয়ে হিরণ্যকশ্যপ তার ছেলে প্রহ্লাদকে একটি স্তম্ভের সাথে বেঁধে তাকে হত্যা করার জন্য তার তলোয়ার বের করে বললেন, বল তোমার ভগবান কোথায়, প্রহ্লাদ বললেন ভগবান ঠিক এই স্তম্ভে, যেখানে তুমি আমাকে বেঁধে রেখেছ। হিরণ্যকশ্যপ প্রহ্লাদকে বধ করতে চাইলেই বিষ্ণু নরসিংহ রূপে অবতীর্ণ হয়ে স্তম্ভ থেকে বেরিয়ে এসে হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করেন।

ইতিহাস সম্পাদনা

নরসিংহ জয়ন্তীকে পদ্মপুরাণ এবং স্কন্দপুরাণে নরসিংহ চতুর্দশী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।[৬] নরসিংহের উপাসনা সহস্রাব্দ ধরে দক্ষিণ ভারতে বিদ্যমান রয়েছে। পল্লব রাজবংশ সময়কালে এটি অধিক জনপ্রিয় ও চর্চা করা হতো।[৭] বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সময়কালের অনেক শিলালিপিও পাওয়া গেছে।[৮]

ধর্মীয় রীতি ও ঐতিহ্য সম্পাদনা

নৃসিংহ জয়ন্তী বৈষ্ণবদের দ্বারা অভিক পালিত হয়। দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং উত্তর তামিলনাড়ুতে, নরসিংহের পূজা খুবেই জনপ্রিয়।[৯] উল্লিখিত অঞ্চল জুড়ে নৃসিংহ এবং লক্ষ্মী নরসিংহ মন্দিরগুলিতে বিভিন্ন সময়কালে দেবতার সম্মানে বিশেষ পূজার আয়োজন করে।[১০] গৃহস্থে, ষোড়শপচার পূজা সকালে করা হয়, এবং পঞ্চোপচার পূজা সন্ধ্যায় করা হয়।[১১]

শ্রী বৈষ্ণব ঐতিহ্যের সদস্যরা ঐতিহ্যগতভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস পালন করে এবং প্রার্থনার পর খাদ্য গ্রহণ করে। গুড় এবং জল দিয়েপানকাম নামে একটি পানীয় তৈরি করা হয়, যা উৎসবের সময় ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।[১২]

কর্ণাটকে, উপলক্ষ উদযাপনের জন্য নির্দিষ্ট মন্দির দ্বারা সম্প্রদায়ের ভোজের আয়োজন করা হয়।[১৩]

ভাগবত মেলা সম্পাদনা

প্রতি বছর নরসিংহ জয়ন্তীতে, ভাগবত মেলা নামে পরিচিত একটি ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য তামিলনাড়ুর একটি গ্রাম মেলাত্তুরে প্রকাশ্যে পরিবেশিত হয়।[১৪][১৫] " ভাগবত " শব্দটি বৈষ্ণব ঐতিহ্যের একটি বিশিষ্ট হিন্দু গ্রন্থ ভাগবত পুরাণকে নির্দেশ করে। যেখানে " মেলা " ঐতিহ্যবাহী নর্তক বা গায়ককে বোঝায়। এইভাবে, এই লোকনৃত্যটি নির্দিষ্ট নৃত্য কৌশল এবং কর্ণাটক সঙ্গীত শৈলী ব্যবহার করে ভাগবত পুরাণ থেকে গল্পগুলি রচনা করে।[১৫] একটি বিশেষ অভিনয় যা "এর নাটকীয় প্রভাব এবং আচারের তাৎপর্যের জন্য উল্লেখযোগ্য" তা হল প্রহ্লাদ এবং নৃসিংহদেবের গল্প।[১৬]

আরো দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Trust, Vishwamaitri (২৪ মার্চ ২০২০)। "Vishwamaitri Panchanga: Shri Sharvari" 
  2. Lochtefeld, James G. (২০০২)। The Illustrated Encyclopedia of Hinduism: N-Z (ইংরেজি ভাষায়)। Rosen। পৃষ্ঠা 462। আইএসবিএন 978-0-8239-3180-4 
  3. "রাত পোহালেই নরসিংহ জয়ন্তী! জানুন নেপথ্যের পৌরাণিক কাহিনী, পুজো পদ্ধতি"Hindustantimes Bangla। ২০২৩-০৫-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-০৪ 
  4. www.wisdomlib.org (২০১৮-০৫-২৩)। "Narasimhajayanti, Narasiṃhajayantī, Narasimhajayamti: 3 definitions"www.wisdomlib.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-১৫ 
  5. Verma, Manish (২০১৩)। Fasts and Festivals of India (ইংরেজি ভাষায়)। Diamond Pocket Books (P) Ltd.। পৃষ্ঠা 24। আইএসবিএন 978-81-7182-076-4 
  6. Vemsani, Lavanya (২০২২-১০-০৬)। Hinduism in Middle India: Narasimha, The Lord of the Middle (ইংরেজি ভাষায়)। Bloomsbury Publishing। পৃষ্ঠা 198। আইএসবিএন 978-1-350-13852-0 
  7. Sircar, Dineschandra (১৯৭১)। Studies in the Religious Life of Ancient and Medieval India (ইংরেজি ভাষায়)। Motilal Banarsidass Publ.। পৃষ্ঠা 267। আইএসবিএন 978-81-208-2790-5 
  8. Verghese, Anila (১৯৯৫)। Religious Traditions at Vijayanagara, as Revealed Through Its Monuments (ইংরেজি ভাষায়)। Manohar। পৃষ্ঠা 104। আইএসবিএন 978-81-7304-086-3 
  9. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; The Book of Avatars and Divinities - Google Books নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  10. Vemsani, Lavanya (২০২২-১০-০৬)। Hinduism in Middle India: Narasimha, The Lord of the Middle (ইংরেজি ভাষায়)। Bloomsbury Publishing। পৃষ্ঠা 189। আইএসবিএন 978-1-350-13852-0 
  11. Rao, Jaishri P. (২০১৯-০৪-২৯)। Classic Cuisine and Celebrations of the Thanjavur Maharashtrians (ইংরেজি ভাষায়)। Notion Press। আইএসবিএন 978-1-68466-649-2 
  12. Bahadur), L. Krishna Anantha Krishna Iyer (Diwan (১৯২৮)। The Mysore Tribes and Castes (ইংরেজি ভাষায়)। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 341। 
  13. General, India (Republic) Office of the Registrar (১৯৭০)। Census of India, 1961 (ইংরেজি ভাষায়)। Manager of Publications। 
  14. Massey, Reginald (২০০৪)। India's Dances: Their History, Technique, and Repertoire (ইংরেজি ভাষায়)। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 89। আইএসবিএন 978-81-7017-434-9 
  15. Rubin, Don (২০০১)। The World Encyclopedia of Contemporary Theatre: Asia/Pacific (ইংরেজি ভাষায়)। Taylor & Francis। পৃষ্ঠা 139–140। আইএসবিএন 978-0-415-26087-9 
  16. Brandon, James R.; Banham, Martin (১৯৯৭-০১-২৮)। The Cambridge Guide to Asian Theatre (ইংরেজি ভাষায়)। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 79–80। আইএসবিএন 978-0-521-58822-5 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা