নূর উদ্দিন গহরপুরী
নূর উদ্দিন আহমদ গহরপুরী (১৯২৪-২০০৫) উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলীম শায়খুল হাদিস। ১৯৯৬ সালে তিনি দেশের সর্ববৃহৎ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং মৃত্যু অবধি তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তান আমলে রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা হিসেবে ১৯৭০ এর জাতীয় নির্বাচনে খেজুরগাছ প্রতীক নিয়ে অংশ গ্রহণ করেন। সিলেটের জামিয়া ইসলামিয়া হুসাইনিয়া গহরপুরের মোহতামিম (উপাচার্য) ও শায়খুল হাদিসের দ্বায়িত্ব পালন করেন তিনি। [১][২][৩][৪]
শায়খুল হাদিস আল্লামা নুর উদ্দিন আহমদ | |
---|---|
উপাধি | শাইখুল হাদীস, আল্লামা |
জন্ম | ১৯২৪ শিওরখাল মোল্লাপাড়া, বালাগঞ্জ, সিলেট, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ) |
মৃত্যু | ২ এপ্রিল ২০০৫ গহরপুর, বালাগঞ্জ, সিলেট। |
জাতিভুক্ত | ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত) পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে) বাংলাদেশ |
অঞ্চল | ইসলাম |
মাজহাব | হানাফি |
শাখা | সুন্নি |
মূল আগ্রহ | কুরআন,হাদীস, বুখারী শরীফ, রাজনীতি, ইসলামী আন্দোলন |
যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন | |
যাদেরকে প্রভাবিত করেছেন
| |
ওয়েবসাইট | http://gohorpurifoundation.com/ |
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
সম্পাদনাতিনি সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার শিওরখাল মোল্লাপাড়া গ্রামে ১৯২৪ সালে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা মাওলানা জহুর উদ্দিন এবং মাতা ছুরেতুন্নেসা। শিশু বয়েসেই পিতাকে হারিয়ে এতিম হন তিনি।[২]
শিক্ষা জীবন
সম্পাদনাধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নিজ পরিবারেই তার প্রাথমিক শিক্ষার শুরু। এক সময় তাকে স্থানীয় সুলতানীয়া মক্তবে ভর্তি করা হয়। এরপর তিনি ইছামতি মাদ্রাসা ও পূর্বভাগ জালালপুর মাদ্রাসায় কিছুদিন লেখাপড়া করেন। তৎকালিন সময়ে শায়খুল ইসলাম শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানীর খলিফা বৃহত্তর সিলেটের বিখ্যাত বুযুর্গ বাঘার শায়েখ মাওলানা বশির উদ্দিনের যাতায়াত ছিল গহরপুরে। আলেম ও দ্বীনদার পরিবার হিসেবে গহরপুরীর বাড়িতেই তিনি যাতায়াত করতেন। একবার তিনি গহরপুরীর বাড়িতে আসলে শিশু নুর উদ্দিনকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আবেগে আপ্লুত মুহতারামা ছুরতুন্নিসা শায়খে বাঘার কাছে অভিবাবকত্ব নেওয়ার জন্য দাবি জানান। শায়েখ মহিয়ষী জননীর আবেদনে সাড়া দিয়ে শিশু নুর উদ্দিনকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে বাঘা মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। এর পর থেকে শিশু নুর উদ্দিন লেখাপড়ার পাশাপাশি হযরত শায়খে বাঘার খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন। কিশোর বয়সেই বাঘার খাদিম হিসেবে তার পরিচয় ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তিনি হিফযুল কুরআন সমাপ্ত করেন। মনের ঐকান্তিকতা আর আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত প্রখর মেধাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ঘুমকে ত্যাগ করে শায়খ ঘুমানোর পর রাতে কুরআন মজীদ হিফজ করতেন। এক রাতে কি এক কারণে শায়খ সাহেব কিশোর নুর উদ্দিনকে শাসন করতে গিয়ে প্রহার করলেন। এরপর বিষয়টি শায়খের মনে দাগ কাটতে লাগল। তিনি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। নুর উদ্দিনকে ডেকে পাঠালে দেখতে পান তার মুখে মৃদু হাসি, মনে কোন দুঃখ নেই, ক্ষোভ নেই। শায়খে বাঘা গভীর মমতায় অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন বালক নুর উদ্দিনের দিকে। তার ভবিষ্যত কল্যাণ চিন্তায় তার মন দুমড়ে কেঁদে উঠে। তিনি মহান আল্লাহর দরবারে তার জন্য বিশেষ মোনাজাত করেন। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে গহরপুরীকে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ইসলামী বিদ্যাপিট দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। ইতিমধ্যে ভারত স্বাধীন হয়ে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তান। রেফারেন্ডারের মাধ্যমে সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। গহরপুরী ১৯৫০ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদিস ১ম বিভাগে ১ম স্থান অর্জন করেন। দেওবন্দ থাকাকালিন অবস্থায় তিনি তার আদব-আখলাক ও জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে উস্তাদগনের মন জয় করেন। বিশেষত,উপমহাদেশের প্রখ্যাত শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানীরনৈকট্য হাসিল করতে সক্ষম হন। ইলমে হাদিসের প্রতি ছিল তার বিশেষ অনুরাগ। ফলে দাওরা পাশ করে তিনি আরো এক বছর হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্র গবেষণায় অতিবাহিত করেন। শায়খুল ইসলাম মাদানী ছাড়াও তিনি দেওবন্দের যেসব জগৎ বিখ্যাত মনীষ দের শির্ষত্ব লাভ করেন তারা হলেন-ক্বারী তৈয়্যব, শায়খুল আদব মাওলানা এজাজ আলী আমরুহী, মাওলানা ইব্রাহিম বলিয়াভী, মাওলানা মেরাজুল হক, মাওলানা ফখরুল হাসান মুরাদাবাদী। লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষাজীবন ছাড়াই আজীবন তার গভীর মনোযোগ ছিল। দেওবন্দেই তিনি তার মেধার সাক্ষর রাখেন এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষনে সক্ষম হন। তিনি ফারিগ হওয়ার পরই মাদানী রহঃ এর হাতে বায়াত হন। আধ্যাত্বিক উন্নতি ও পরিশুদ্বি সাধনায় রত হন। [১]
কর্ম জীবন
সম্পাদনা১৯৫২ সালে স্থায়ী পীর ও উস্তাদ মাদানী ও শায়খুল আদব এজাজ আলী রহ. এর নির্দেশে মাওলানা গহরপুরীকে শায়খুল হাদীস পদে বরিশালের পাঙ্গাসিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় প্রেরণ করা হয়। এর পূর্বে বরিশাল আলিয়া মাদ্রাসা থেকে শায়খুল হাদীস ছেড়ে দেওবন্দ কর্তৃপক্ষের আবেদন প্রেক্ষিতে গহরপুরীকে প্রেরণ করা হয় বরিশালে। এ নিয়োগ ছিল এক বিরল ঘটনা। সরকারী শায়খুল হাদীস পদের জন্য প্রেরনের ঘটনায় ইলমে হাদীসের পরিলক্ষতার বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি নিজে নিজে কোরআন শরীফ হিফজ করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন। শায়খে বাঘা রমজানের খতমে তারাবির জন্য হাফিজ সাহেব তালাশের কথা বলেন। তিনি জানান যে ত্রিশ পারা তিনি মুখস্থ করেছেন। বাকি সাত পারা তিনি সাত দিনেই মুখস্থ করে নামাজ পড়িয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। একদা আল্লামা গহরপুরী হাদীস পড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ উটে গিয়ে পার্শ্ববর্তী জমিতে দুটি সাপকে বেদম প্রহার করলেন। পরে সাপ মারার কারণ জানতে চাইলে বললেন, ওরা দুটি জ্বীন, প্রতিদিন আমার কাছে পড়তে আসে। প্রায়ই ওরা পরস্পরে ঝগড়া করে। আজ কিছু বেশি ঝগড়া করেছে তাই তাদের বিচার করলাম। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পাঙ্গাসিয়ায় সুনামের সাথে শায়খুল হাদিসের দ্বায়িত্ব পালনের পর ২বছর বালিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তিনি তার নিজ গ্রামে চলে আসেন। এবং গহরপুর জামেয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল ব্যতিক্রম ধারার। প্রথমে দাওরাইয়ে হাদিস এরপর মিশকাত বা ফজিলত জামাত এমনি করে অন্যান্য শ্রেণী খোলা হয়। প্রতিষ্ঠা কাল থেকেই তিনি মাদ্রাসার মোহতামিম ও শায়খুল হাদিসের দ্বায়িত্ব পালন করেন। তার এই প্রতিষ্টিত মাদ্রাসা থেকে হাজার হাজার আলেমে দ্বীন যোগ্যতার সাথে দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করায় তার সুনাম ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ হতে দেশান্তরে। ১৯৯৬ সালে দেশের সর্ববৃহৎ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসীল আরাবিয়ার চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয় এবং মৃত্যু অবধি তিনি এ গুরু দায়িত্ব সফল সাথে পালন করেন।[৫]
রাজনীতি
সম্পাদনা১৯৬৮ সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষ থেকে আয়োজিত ‘ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব পাকিস্তান’-এর কনফারেন্সে প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা হিসেবে তিনি খেজুরগাছ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।[৬][৫]
মৃত্যু
সম্পাদনা৬ এপ্রিল ২০০৫ সালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি চার স্ত্রী, একমাত্র ছেলে মুসলেহুদ্দীন রাজু ও ৪ মেয়েসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।
২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি তার একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।[৭]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "(.) | কালের কণ্ঠ"। Kalerkantho। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-২৮।
- ↑ ক খ "আল্লামা নুর উদ্দিন আহমদ গহরপুরীর মৃত্যু বার্ষিকী আজ"। sylhetreport.com। ২০১৯-০৮-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-১৬।
- ↑ BanglaNews24.com। "গহরপুর জামিয়ার কওমি গ্র্যাজুয়েশন থেকে সনদ নিলেন তরুণ আলেমরা"। banglanews24.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-১৭।
- ↑ "সিলেট গহরপুর জামিয়ার বার্ষিক মাহফিল বৃহস্পতিবার"। Barta24। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-১৭।
- ↑ ক খ "আল্লামা গহরপুরী পরিচিতি"। গহরপুর হোসাইনিয়া মাদ্রাসা। ১৭ আগস্ট ২০১৯। ১৭ আগস্ট ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ আগস্ট ২০১৯।
- ↑ মাহবুবুর রহমান (৬ ডিসেম্বর ২০১৯)। "আটচল্লিশ বছর আগে, এই ডিসেম্বরে"। দৈনিক প্রথম আলো। ৬ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ জানুয়ারি ২০২২।
- ↑ "এক মলাটে আল্লামা গহরপুরী (রহ.) এর বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম"। alokitobangladesh। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-২৬।
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- খালিদ হোসেন, আ ফ ম (২০২২)। নিভে যাওয়া দীপশিখা ১। বাংলাদেশ: আকাবিব স্টাডিজ অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস। পৃষ্ঠা ২২২–২২৬। আইএসবিএন 9789849591405।
- মাযহারুল ইসলাম ওসমান কাসেমী, মুফতি (২০১৫)। বিখ্যাত ১০০ ওলামা-মাশায়েখের ছাত্রজীবন (৩য় সংস্করণ)। ইসলামী টাওয়ার, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০: বাড কম্প্রিন্ট এন্ড পাবলিকেশন্স। পৃষ্ঠা ১৭০–১৭৫। আইএসবিএন 98483916605।
- হাবিবুর রহমান, মুহাম্মদ (২০০৯)। আমরা যাদের উত্তরসূরী (শতাধিক পীর-মাশায়েখ ও উলামায়ে কেরাম এর জীবন ও কর্ম)। ঢাকা, বাংলাদেশ: আর কাউসার প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৪০০।
- মোহাম্মদ কাওছার, আলী ফজল (২০১৯)। সিলেটি পীর আউলিয়ার জীবনী। ঢাকা: বাংলাদেশ রাইটার্স গিল্ড। পৃষ্ঠা ৮৭। আইএসবিএন 9789849356417।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- নূর উদ্দিন গহরপুরী - গহরপুর হোসাইনিয়া মাদ্রাসা