নীলমাধব (ওড়িয়া : ନୀଳମାଧବ , সংস্কৃত : नीलमाधव) হল জগন্নাথদেবের আদিরূপ। হিন্দুদের ধর্মীয় সাহিত্যে বিষ্ণু তথা কৃষ্ণের আর একটি রূপের প্রকাশ, যেটি মূলত ওড়িশার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যই বহন করছে। [১] ঐতিহ্যগত বিবরণ অনুসারে, বৈষ্ণবধর্মের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের পূর্বে নীলকান্তমণি দিয়ে গড়া অপরূপ দেবমূর্তি যাকে শবর আদিবাসীদের রাজা বিশ্ববসু পূজা করতেন। [২]

কিংবদন্তি সম্পাদনা

 
নীলমাধব মন্দির, কান্তিলো, ভারত

হিন্দু পুরাণ অনুসারে কথিত আছে যে, প্রাচীন ভারতের অবন্তী রাজ্যের সূর্যবংশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন। এক সন্ন্যাসীর মাধ্যমে অবগত হন যে, তার উপাসক বিষ্ণু নীলমাধব রূপে পূজিত হচ্ছেন। তিনি সেই বিগ্রহ দর্শনে এবং পূজা নিবেদনর ইচ্ছা প্রকাশ করেন।  [৩] নীলমাধবের সন্ধানে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অনুচরদল নিয়োগ করেন এবং সেই অনুচর দলের একজন ছিলেন রাজ পুরোহিতের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিদ্যাপতি। সমস্ত জল জঙ্গল খুঁজে অনুচরেরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন, কিন্তু বিদ্যাপতি ঘন জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন। জঙ্গলে ছিল শবর জনজাতির বাস। শেষে শবরপ্রধান বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা তাকে উদ্ধার করে শবরপ্রধান বিশ্ববসুর কাছে নিয়ে যান। শবরপ্রধানের গৃহে আশ্রয় পান এবং তার কন্যা ললিতার প্রেমে পড়েন। কিছু কাল পর ললিতার সঙ্গেই বিবাহ হয় বিদ্যাপতির। তিনি লক্ষ্য করেন যে, শবরপ্রধান প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হন এবং পরের দিন দুপুরেই ফিরে আসেন। অনেক অনুরোধে স্ত্রী ললিতার কাছ থেকে বিদ্যাপতি জানতে পারেন, শবরপ্রধান জঙ্গলের গহীনে নীল পর্বতে গোপনে নীলমাধবের পূজা করতে যান। নীলমাধবের কথা জানতে পেরে বিদ্যাপতি তার স্ত্রীর মাধ্যমে বিশ্ববসুকে নীলমাধবের দর্শন করানোর সম্মতি আদায় করেন। [৪] কিন্তু শবররাজ বিদ্যাপতিকে সঙ্গে নিতে রাজি হন, এই শর্তে যে, যাত্রার সময় তার চোখ বেঁধে রাখা হবে যাতে মন্দিরের অবস্থানটি সে যেন সঠিক জানতে না পারে। বুদ্ধিমতী ললিতা এক পরিকল্পনা করে স্বামীকে সাহায্য করেন। [৫] যাত্রার সময় তিনি  বিদ্যাপতিকে এক ব্যাগ সরিষার বীজ দেন এবং যাওয়ার পথে বিদ্যাপতি সেগুলি ছড়িয়ে দেন। [৬][৭] বিগ্রহ দর্শনের পর বিদ্যাপতি অবন্তী রাজ্যে ফিরে এসে তিনি ইন্দ্রদ্যুম্নকে নীলমাধব মন্দির সন্ধানের কথা জানান। কয়েক মাস পরে, সরিষার বীজগুলি অঙ্কুরিত হলে সরিষার গাছ অনুসরণ রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এবং তার কর্মচারী মন্দিরে যাত্রা করেন, কিন্তু পৌঁছানোর পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দেখেন দেবমূর্তি অন্তর্হিত। মূর্তির অদর্শনে তিনি আমৃত্যু অনশন ব্রত গ্রহণ করলেন। তিন দিন ও তিন রাত ধরে বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করার পর, তার কানে আসে এক দৈববাণী। তার সর্বব্যাপীতার কথা জানিয়ে নির্দেশ আসে সমুদ্রের জলে যে কাষ্ঠ খন্ড ভেসে আসবে তাই দিয়েই যেন তৈরি করা তার বিগ্রহের মূর্তি এবং তাদের উপাসনার জন্য সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের উপরে একটি নতুন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। [৮]     

স্কন্দ পুরাণ অনুসারে, বিদ্যাপতি যখন ফিরে এসে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে মন্দিরের অবস্থানের কথা জানান, তখন প্রচণ্ড ঝড়ে নীলমাধবের মূর্তিটি বালির নীচে চাপা পড়ে যায়। অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মন্দিরে দেবমূর্তি সনাক্ত করতে অক্ষম হন। শেষে দেবর্ষি নারদের পরামর্শে, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন একটি নতুন মন্দির নির্মাণ করেন এবং সেই স্থানে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। ফলস্বরূপ দৈববাণী পেয়ে  সমুদ্রে ভাসমান একটি বড় গাছ কেটে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার তিনটি কাঠের মূর্তি তৈরি করা হয়। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মন্দির উদ্বোধন করার জন্য ব্রহ্মাকে আমন্ত্রণ জানাতে ব্রহ্মলোকে যাত্রা করেন। সময়ের সঙ্গে 'গালা' নামে একজন রাজা নিজেকে মন্দিরের প্রকৃত স্থপতি বলে দাবি করতে থাকেপ, কিন্তু ইন্দ্রদ্যুম্ন পৃথিবীতে ফিরে আসার পর তিনি তার দাবি প্রত্যাহার করে নেন। ব্রহ্মা মন্দির উদ্বোধন করার পর, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন গালা'কে জায়গাটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে ব্রহ্মলোকে ফিরে আসেন। [৯][১০]

ওড়িশার পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরে নীলমাধব কেন্দ্রপ্রাণ হিসাবে লক্ষ্মীদেবী মূর্তির ডানদিকে অবস্থান করছেন। এছাড়াও, ওড়িশার নয়াগড় জেলার কান্তিলো শহরে একটি নীলমাধব মন্দির রয়েছে ।[১১]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Dalal, Roshen (২০১৪-০৪-১৮)। Hinduism: An Alphabetical Guide (ইংরেজি ভাষায়)। Penguin UK। পৃষ্ঠা 580। আইএসবিএন 978-81-8475-277-9 
  2. Jain, Sandhya (২০২২-০৩-১৯)। Adi Deo Arya Devata: A Panoramic View oF Tribal-Hindu Cultural Interface (ইংরেজি ভাষায়)। Notion Press। পৃষ্ঠা 106। আইএসবিএন 979-8-88530-378-1 
  3. Books, Kausiki (২০২১-১০-২৪)। Skanda Purana: Vaishnava Khanda: Purushottama Kshetra Mahatmya: English Translation only without Slokas (ইংরেজি ভাষায়)। Kausiki Books। পৃষ্ঠা 4। 
  4. Knapp, Stephen (২০০৯-০১-০১)। Spiritual India Handbook (ইংরেজি ভাষায়)। Jaico Publishing House। পৃষ্ঠা 217। আইএসবিএন 978-81-8495-024-3 
  5. Rosen, Steven (১৯৯৪-১১-৩০)। Vaisnavism (ইংরেজি ভাষায়)। Motilal Banarsidass Publ.। পৃষ্ঠা 210। আইএসবিএন 978-81-208-1235-2 
  6. Choudhury, Pranab Chandra Roy (আগস্ট ১৯৯৯)। Best Loved Folk Tales of India (ইংরেজি ভাষায়)। Sterling Publishers Pvt. Ltd। পৃষ্ঠা 204। আইএসবিএন 978-81-207-1660-5 
  7. Knapp, Stephen (২০০৮-০৫-২৯)। Seeing Spiritual India: A Guide to Temples, Holy Sites, Festivals and Traditions (ইংরেজি ভাষায়)। iUniverse। পৃষ্ঠা 250। আইএসবিএন 978-0-595-61452-3 
  8. Urmi: The Journal of the Odisha Society of Americas 49th Convention: For Annual Convention Held in 2017 at Dearborn, Michigan (ইংরেজি ভাষায়)। Odisha Society of the Americas। পৃষ্ঠা 129–132। 
  9. Parmeshwaranand, Swami (২০০১)। Encyclopaedic Dictionary of Puranas (ইংরেজি ভাষায়)। Sarup & Sons। পৃষ্ঠা 322। আইএসবিএন 978-81-7625-226-3 
  10. Silva, Jose Carlos Gomes da (২০১০-০১-০১)। The Cult of Jagannatha: Myths and Rituals (ইংরেজি ভাষায়)। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 129। আইএসবিএন 978-81-208-3462-0 
  11. নীলমাধব মন্দির, ওড়িশা