নাগলিঙ্গম বা হাতির জোলাপ এক প্রকার বৃক্ষ এবং এর ফুল। এই গাছের ইংরেজি নাম 'cannonball tree' এবং বৈজ্ঞানিক নাম Couroupita guianensis, যা Lecythidaceae পরিবারভুক্ত। এর আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চল। দুই তিন হাজার বছর ধরে ভারতে জন্মানোর কারণে অনেকে এ বৃক্ষটির উৎপত্তিস্থল ভারতকেও বিবেচনা করে থাকেন।

নাগ
নাগলিঙ্গম
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Plantae
বিভাগ: Magnoliophyta
শ্রেণী: Magnoliopsida
বর্গ: Ericales
পরিবার: Lecythidaceae
গণ: Couroupita
প্রজাতি: C. guianensis
দ্বিপদী নাম
Couroupita guianensis
Aubl.
জলটঙ্গীর পুকুর ঘাটের পাশে নাগলিঙ্গম গাছে ফোটা ফুল
Lecythidaceae(লিসাইথিডেসিয়া) গোত্রের দীর্ঘ চিরসবুজ আয়াহিনা বা ক্যানন বল নামক বৃক্ষটির আদি নিবাস উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ ক্যারাবিয়ান । আমেরিকা বা দক্ষিণ দ্বীপপুঞ্জে উৎপত্তি হলেও পৃথিবীর সর্বত্র এটি কম বেশি বিস্তৃত। উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম Couroupita guianensis, ১৭৫৫ সালে ফ্রান্সের উদ্ভিদবিদ জে.এফ আবলেট এর নামকরণ করেছিলেন। গত দুই তিন হাজার বছর ধরে ভারতে জন্মানোর কারনে অনেকে এর উৎপত্তিস্থল হিসেবে ভারতকেও বিবেচনা করে থাকেন। বিভিন্ন অঞ্চলে জন্মানোর কারণে এটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। ভারতের শিবা মন্দিরে জন্মানোর কারণে হিন্দিতে এটি শিব কামান, তামিল ভাষায় নাগলিঙ্গম এবং বাংলা ভাষায় নাগলিঙ্গম নামে পরিচিত। ফুটন্ত ফুলের পরাগ কেশর সাপের ফনার মত, আর এ কারণেই গাছটির নাম নাগলিঙ্গম হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। এ গাছের ফুল নাগ-নাগিনী পাহারা দেয় এমন ধারণা থেকেও এরুপ নামকরণ হতে পারে। শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য বৌদ্ধ মন্দিরে এটি রোপণ করতে দেখা যায়। ক্যানন বলের মত ফল ধারণকারী এই বৃক্ষ ২৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। অধিকাংশ এই গাছগুলোর দ্রুত বৃদ্ধি এবং আকর্ষণীয় ফুলের জন্য রোপণ করা হয়। ফুলগুলো কমলা,উজ্জ্বল লাল গোলাপি বর্ণের এবং তিন মিটার দীর্ঘ মঞ্জুরিতে ফুটে থাকে। ফুলগুলো ঊর্ধ্বমুখী স্থুল ডিস্কের সাথে যুক্ত থাকে। ফুলগুলোতে তীব্র সুগন্ধযুক্ত , কমলা লাল বর্ণের দীর্ঘ ছয়টি পাপড়ি বিদ্যমান। এর পরাগায়ণ বাতিক্রমধর্মী যেখানে মৌমাছি বাহক হিসেবে কাজ করে। উৎপন্ন ফল দীর্ঘ, গোলাকার যার সাথে মিল রেখেই গাছটির নামকরণ। পরিপক্ক ফল মাটিতে পড়লে ফেটে যায়, মৃদু শব্দ সৃষ্টি করে এবং বাতাসে ঝাঁঝালো গন্ধের সৃষ্টি করে। বীজগুলোতে আলাদা আলাদা চুলের মত আস্তরণ থাকে যা এদেরকে প্রতিকূল অবস্থা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। নারিকেল গাছের মত এটি রাস্তার পাশে রোপণ করা হয় না কারণ এর পরিপক্ক ভারী ফল যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনা সৃষ্টি করতে পারে। ফলগুলো ২০ সে.মি. পর্যন্ত হয় এবং নয় মাসের মধ্যে পরিপক্ক হয়। প্রাণীদের খাবার হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। আমাজান বনের সামান জনগোষ্ঠীর এটি একটি প্রিয় খাবার কিন্তু অন্যান্যদের জন্য এটি ক্ষতিকারও হতে পারে। শক্ত খোলস অলংকার বা বিভিন্ন দ্রব্য বহনে ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত এই উদ্ভিদটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক। এর ফুল, পাতা এবং বাকলের নির্যাস ঔষধ হিসেবে বহুল প্রচলিত। এটি এনটিবায়েটিক, এনটিফাঙ্গাল এবং এনটিসেপটিক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে থাকেন। পেটের পীড়া দূরীকরণে এর ভূমিকা ব্যাপক। পাতা থেকে উৎপন্ন জুস ত্বকের সমস্যা দূরীকরণে খুবই কার্যকর। দক্ষিণ আমেরিকার সামানরা এর পাতা ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করে থাকে। বহুল গুণ সম্পূর্ণ এই উদ্ভিদের সংখ্যা এখন পৃথিবীতে খুবই কম। বাংলাদেশে খুব কম সংখ্যক নাগলিঙ্গম গাছ বিদ্যমান। নাগলিঙ্গম দেখতে হলে অথবা এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, রমনা পার্ক, নটরডেম কলেজ, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেন।
নাগলিঙ্গম

নাগলিঙ্গমের বর্ণনা

সম্পাদনা

নাগলিঙ্গম ৩৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গুচ্ছ পাতাগুলো খুব লম্বা, সাধারণভাবে ৮-৩১ সেন্টিমিটার, কিন্তু ৫৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বায় পৌঁছতে পারে।[] পাতার রং সবুজ, প্রায় কালো, কিন্তু অত্যন্ত উজ্জ্বল। গ্রীষ্মকালে এদের পত্র মোচন হয়। উল্লেখ্য, নাগেশ্বর, নাগকেশরনাগলিঙ্গম তিনটি ভিন্ন প্রজাতি। এই গাছে ফুল ধরার পর বেলের মতো গোল গোল ফল ধরে। এগুলো হাতির খুবই প্রিয় খাবার। এজন্য এর অন্য নাম হাতির জোলাপ গাছ।[]

নাগলিঙ্গমের ফুল, বীজ ও জন্ম

সম্পাদনা

এ বৃক্ষ বহু শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট এবং বড় বড় ডালে ফুলের মঞ্জুরি ধরে। কখনো কখনো সরা বৃক্ষের কান্ড থেকেই ফুল বের হয়। ফুলগুলো কমলা, উজ্জ্বল লাল গোলাপি রঙের, ঊর্ধ্বমুখী, ছয়টি পাপড়িযুক্ত এবং তিন মিটার দীর্ঘ মঞ্জুরিতে ফুটে থাকে। একটি বৃক্ষে প্রায় এক হাজারটি ফুল ধরতে পারে। ফুল দৈর্ঘে ৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর পাপড়ি গোলাকৃতি, বাঁকানো, মাংসল এবং ভেতর ও বাইরে যথাক্রমে গাঢ় গোলাপী ও পান্ডুর হলুদ। নাগলিঙ্গমের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর পরাগচক্র সাপের ফণারমত বাঁকানো এবং উদ্যত ভঙ্গি। রাতের বেলায় ফুল থেকে তীব্র সুগন্ধ বের হয় যা সকাল পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। সারা গ্রীষ্মকাল ধরেই নাগলিঙ্গম ফুল ফোটে। ফল ক্যানন বলের মত অর্থাৎ দীর্ঘ, গোলাকার, ভারি এবং ২৫ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। নয় মাসের মধ্যে ফল পরিপক্ক হয়। ফল মাটিতে পড়লে মৃদু শব্দে ফল ফেটে যায়, এবং বাতাসে ঝাঁঝালো গন্ধের সৃষ্টি করে। ফলগুলো কখনো কখনো পরিপক্ক হতে ১৮ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ফলগুলো গাছের মত শক্ত। প্রতিটি ফল থেকে প্রায় ৬৫টি বীজ পাওয়া যায়। বীজগুলোতে আলাদা আলাদা ফুলের মত আস্তরণ থাকে যা এদেরকে প্রতিকূল অবস্থা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। পঁচা ফলের গন্ধ অত্যন্ত উগ্র, কুৎসিত। বীজ থেকে সহজেই এ বৃক্ষেও চারা জন্মে।

কোথায় পাওয়া যায়

সম্পাদনা

এর ফল ফুটবল আকারের এবং বাদামি-খয়েরি বর্ণের।[] এটি পৃথিবীর অনেক জায়গায় চাষ করা হয়।[]

বাংলাদেশে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় (সেগুনবাগিচা, ঢাকা), পি.জি হসপিটাল সি ব্লগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বলধা গার্ডেন, রমনা পার্ক, তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, নটর ডেম কলেজ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মহাখালী ডিওএইচএস, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর রায়সাহেব বাড়ি লোকনাথ বাবা মন্দির, বিক্রমপুর অর্থাৎ মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল ইউনিয়নের জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে জমিদার সাহেব বাবুর দীঘির পাশে, বোটানিক্যাল গার্ডেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, টঙ্গী, শ্রীমঙ্গলের বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (BMTTI) গাজীপুর, ঢাকা।বরিশালের বিএম কলেজ, ময়মনসিংহের মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, গফরগাঁও সরকারি কলেজ, নওগাঁ জেলার হাট নওগাঁ ঈদগা মাঠ,চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এণ্ড কলেজ, শাহ্ মখদুম কলেজ, রাজশাহী, গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, অযাচক আশ্রম-বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কার্য্যালয় রহিমপুর মুরাদনগর কুমিল্লা, চাঁদপুর জেলা প্রশাষকের বাসভবন,শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বগুড়া, কুমিল্লা,জাতীয় ঈদগাঁ, গাজীপুরের ভাওয়াল রাজার বাড়ি(বর্তমানে ডি সি অফিস), একমি ল্যাবরেটরি, নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলাস্থ জয়াগ নামক গ্রামের গান্ধী আশ্রমে এবং ধামরাইসহ সারাদেশে অনধিক ১০০টি গাছ রয়েছে।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

সম্পাদনা

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত এই উদ্ভিদটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক। দক্ষিণ আমেরিকায় এ বৃক্ষেও কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। তবে সুগন্ধী ফুলের গাছ হিসেবে বাগানে বা বাড়ীর আঙ্গিণায় রোপন করা হয়।

ঔষুধী গুনাগুন

সম্পাদনা

ওষুধ হিসেবে এ বৃক্ষের ফুল, পাতা এবং বাকলের নির্যাস এন্টিবায়োটিক, এন্টিফাঙ্গাল এবং এন্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহূত হয়। পেটের পীড়া দূরীকরণে এর জুঁড়ি নেই। পাতা থেকে উত্পন্ন জুস ত্বকের সমস্যা দূরীকরণে খুবই কার্যকর। দক্ষিণ আমেরিকার সামানরা এর পাতা ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করে থাকে।

চিত্রশালা

সম্পাদনা

Notre Dame College

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Prance, G. T. & S. A. Mori. Couroupita guianensis Aubl. New York Botanical Garden. 2013.
  2. দ্বিজেন শর্মা লেখক; বাংলা একাডেমী ; ফুলগুলি যেন কথা; মে, ১৯৮৮; পৃষ্ঠা-২৭, আইএসবিএন ৯৮৪-০৭-৪৪১২-৭
  3. Mitré, M. 1998. Couroupita guianensis. In: IUCN 2012. IUCN Red List of Threatened Species. Version 2012.2. Downloaded on 30 May 2013.
  4. Couroupita guianensis. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২২ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে Germplasm Resources Information Network.

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা