ম্যালেরিয়া
ম্যালেরিয়া (ইংরেজি: Malaria) হলো একটি মশাবাহিত সংক্রামক রোগ যা মেরুদণ্ডী প্রাণিদের প্রভাবিত করে।[৫][৬][২] মানব ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণগুলি হল জ্বর, ক্লান্তি, বমি এবং মাথাব্যথা।[১][৭] গুরুতর ক্ষেত্রে, এটি জন্ডিস, খিঁচুনি, কোমা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।[১][৮] সংক্রামিত অ্যানোফিলিস মশা কামড়ানোর ১০ থেকে ১৫ দিন পরে লক্ষণগুলি প্রকাশ হতে শুরু করে।[৯][৩] এই রোগের মূলে রয়েছে প্লাজমোডিয়াম গোত্রের প্রোটিস্টা (এক ধরনের অণুজীব)। ম্যলেরিয়া শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন টর্টি (Torti) ১৭৫১ সালে। ইতালিয় শব্দ Mal (অর্থ- দূষিত) ও aria (অর্থ- বায়ু) হতে Malaria (ম্যালেরিয়া) শব্দটি এসেছে। তখন মানুষ মনে করতো দূষিত বায়ু সেবনে এ রোগ হয়। এটি একটি সংক্রমিত স্ত্রী মশার (আনোফেলিস মশা) কামড় সাথে শুরু হয়, যা তার লালা মাধ্যমে প্রোটিস্টর সংবহন তন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে এবং শেষে যকৃতেতে পৌঁছায়, যেখানে তারা পরিপক্ব হয় এবং বংশবৃদ্ধি করে। রোগটি ক্রান্তীয় অঞ্চল, উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং অনেক সাহারা-নিম্ন আফ্রিকা, এশিয়া এবং আমেরিকা অঞ্চলসহ বিষুবরেখা ঘিরে ব্যাপক বিস্তৃত।
ম্যালেরিয়া | |
---|---|
লোহিত রক্তকণিকার সাথে সংযুক্ত একটি ম্যালেরিয়া পরজীবী | |
উচ্চারণ | |
বিশেষত্ব | সংক্রামক রোগ |
লক্ষণ | জ্বর, বমি হওয়া ,মাথা ব্যাথা ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া [১] |
জটিলতা | Seizures, কোমা[১] |
রোগের সূত্রপাত | আক্রমণের ১০-১৫ দিন পর [২] |
কারণ | অ্যানোফিলিস মশা দ্বারা মানুষের মধ্যে ছড়ানো প্লাসমোডিয়াম জীবাণু[১][৩] |
রোগনির্ণয়ের পদ্ধতি | রক্ত পরীক্ষা , এন্টিজেন সনাক্তকরণ পরীক্ষা [১] |
প্রতিরোধ | মশারি , মশা নিধন , মশা নিয়ন্ত্রণ , পূর্ব সতর্কতা [১] |
ঔষধ | ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ [২] |
সংঘটনের হার | ২২৮ মিলিয়ন (২০১৮)[৪] |
মৃতের সংখ্যা | ২০১৮ সালে ৪০৫,০০০ জন[৪] |
মানুষে ১৭৫৩ সালে পাঁচটি প্রজাতির প্লাজমোডিয়াম প্রেরণ এবং সংক্রমণ ঘটতে পারে। বেশিভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হল প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম, প্লাজমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স, প্লাজমোডিয়াম ওভাল এবং প্লাজমোড,এর সাধারণত এটি ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ঘটায় যা খুব কম ক্ষেত্রেই মারাত্মক হয়ে থাকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে লক্ষণীয়ভাবে জুনটিক প্রজাতি প্লাজমোডিয়াম নলসাই নামক জীবাণু একজাতের ছোটো লেজওয়ালা বাঁদরদের মধ্যে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে এবং এটি মানুষের মধ্যেও তীব্র সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। ম্যালেরিয়া ক্রান্তীয় অঞ্চল, উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায় কারণ বৃষ্টিপাত, উষ্ণ তাপমাত্রা, এবং স্থির জল হল মশার ডিমের জন্য আদর্শ আবাসস্থল। মশারি এবং পোকা তাড়ানোর ঔষধ ব্যবহার করে মশার কামড় থেকে বাচাঁ যায় অথবা কীটনাশক স্প্রে ব্যবহার এবং স্থায়ী জল নিঃশেষিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগের বিস্তার থেকে বাচাঁ যায়।
ম্যালেরিয়া সাধারণত ব্লাড ফিল্মস ব্যবহার করে রক্তের দূরবীক্ষণ পরীক্ষা অথবা অ্যান্টিজেন-ভিত্তিক দ্রুত ডায়গনস্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তিতে প্যারাসাইটের ডিএনএ শনাক্ত করার জন্য পলিমারেজ শৃঙ্খল বিক্রিয়ার ব্যবহার উন্নত করা হয়েছে, কিন্তু এর খরচ ও জটিলতার জন্য ব্যাপকভাবে ম্যালেরিয়া-কবলিত এলাকায় ব্যবহার করা হয় না। ২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আনুমানিক ২১৯ মিলিয়ন ম্যালেরিয়ার ঘটনার স্থলসমূহ নথিভুক্ত করেছে। সেই বছরই, ৬,৬০,০০০ থেকে ১.২ মিলিয়ন মানুষ ম্যালেরিয়ার রোগে মারা যায়,[১০] যাদের অধিকাংশই ছিল আফ্রিকার শিশুরা। প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা নিশ্চিতভাবে জানা যায় নি, কারণ অনেক গ্রামীণ এলাকায় উপলব্ধ সঠিক তথ্য নেই, এবং অনেক ক্ষেত্রে অনথিভুক্ত হয়ে থাকে। ২০১১ সালের, ৯৯টি দেশের একটি রিপোর্ট অনুসারে ম্যালেরিয়া সংক্রমণের কারণে ১,০৬,৮২০ জনের মৃত্যু হয়।[১১] ম্যালেরিয়া সাধারণত দারিদ্রতার সাথে সম্পর্ক যুক্ত এবং এছাড়াও অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি প্রধান বাধা হতে পারে।
প্রত্যেক বছর, প্রায় ৫১.৫ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় দশ থেকে ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান যাদের মধ্যে বেশিরভাগই আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের শিশু। ম্যালেরিয়া খুবই পরিচিত একটি সংক্রামক রোগ এবং এটি একটি বৃহৎ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। রোগটি প্লাজমোডিয়াম বর্গের এককোষীয় পরজীবীর দ্বারা ঘটিত হয়। কেবল চার ধরনের প্লাজমোডিয়াম পরজীবী মানুষের মধ্যে সংক্রমন ঘটায়,এদের মধ্যে সবথেকে বেশি প্রভাবিত করে প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম এবং প্লাজমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স। [১২] কিন্তু বাকি দুটি প্রজাতি (প্লাজমোডিয়াম ওভেল, প্লাজমোডিয়াম ম্যালেরি) ও মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে।
ম্যালেরিয়া স্ত্রী-অ্যানোফিলিস মশার কামড়ের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়। ম্যালেরিয়ার পরজীবী লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে, ফলে রোগীর শরীরে রক্তসল্পতার লক্ষণ দেখা যায়। অন্যান্য সাধারণ লক্ষণসমূহ হল কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, শীতশীত ভাব এবং বমি-বমি ভাব। এই রোগের মারাত্মক দশায় রোগীর কোমা এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
মশারি বা কীটনাশকে ডোবানো মশারি [১২] কিংবা অন্যান্য মশা প্রতিরোধক ব্যবহার করে, মশার কামড় প্রতিরোধ করার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ হ্রাস করা সম্ভব। মশা নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য উপায় হল কীটনাষক প্রয়োগ এবং জমা জল বের করা দেওয়া,যেখানে সাধারণত মশা ডিম পাড়ে।জমা পানিতে মশা ডিম পারলে,সেখানে কীটনাষক বা কেরোসিন ছিটিয়ে দিতে হবে।
কুইনাইন অথবা আর্টিমেসিনিন গ্রুপের ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়।
ব্যুৎপত্তি
সম্পাদনাম্যালেরিয়া শব্দটি মধ্যযুগীয় ইতালীয় শব্দ mala aria থেকে এসেছে যার অর্থ হলো 'খারাপ বায়ু'। জলাভূমি এবং জলাভূমির সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে রোগটিকে আগে অ্যাগ বা মার্শ ফিভার বলা হত।[১৩] ইংরেজিতে ম্যালেরিয়া শব্দটি ১৭৬৮ সালের প্রথম দিকে দেখা যায়।[১৪] ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের বিষয়টি একসময় অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার ছিল।[১৫] যেখানে এটি আর স্থানীয় দেশগত রোগ নয়।[১৬] যদিও বাইরে থেকে আসা মানুষদের মধ্যে এখনও দেখা যায়।
ইতিহাস
সম্পাদনাপ্রাচীন গ্রীসের ফিজিসিয়ান হিপোক্রেটিস, যাকে "ঔষধের জনক" বলা হয়, তিনি প্রথম এই রোগের লক্ষণসমূহের বর্ণনা দেন এবং বছরের কোন সময় এটা হয় ও কোন জায়গায় রোগীরা বাস করে সেই তথ্যের সঙ্গে একটা সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন।
ম্যালেরিয়ার প্রথম নথিবদ্ধ চিকিৎসা পদ্ধতির সময়কাল ১৬০০ সাল, যখন [পেরু|পেরুর] আদিবাসীরা চিনচোনা গাছের তিক্ত ছাল ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করত। ১৬৪৯ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডে এটাই "জেসুইট পাউডার" হিসেবে পাওয়া যেত।
১৮৮০ সাল নাগাদ 'চার্লস ল্যাভেরন' লোহিত রক্ত কণিকা থেকে ম্যালেরিয়ার কারণ হিসেবে একটিমাত্র কোষবিশিষ্ট পরজীবী প্রোটোজোয়াকে চিহ্নিত করেন। ফলে শত বছর ধরে চলা দূষিত বায়ু সেবনের ফলে রোগ সৃষ্টির ভুল ধারণার অবসান ঘটে। ১৮৯৭ সালে ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ ডাক্তার 'স্যার রোনাল্ড রস' প্রমাণ করেন যে 'Anopheles' (অ্যানোফিলিস) মশা এই রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের কারণে তাকে ১৯০২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। [১৭]
ম্যালেরিয়া পরজীবী
সম্পাদনাখুব বেশীদিন আগের কথা নয় যখন ম্যালেরিয়া রোগ মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করতো। গ্রাম বাংলার কতশত মানুষকে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। দীর্ঘদিন যাবৎ ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসা প্রায় অসম্ভবের পর্যায় ছিল, কেননা চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ম্যালেরিয়া জীবাণুর সন্ধান পেলেও, কিভাবে এই জীবাণু মানুষের দেহে সংক্রমিত হয় তার হদিশ পাননি। লাভেরান (Laveran) নামে ফরাসী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ১৮০৮ খ্রীষ্টাব্দে জানতে পারেন যে প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স (Plasmodium vivax) নামে প্রোটোজোয়া ম্যালেরিয়া সৃষ্টির জন্য দায়ী। অতঃপর ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে স্যার রোনাল্ড রস (Ronald Ross) নামে একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ভারতীয় রোগব্যাধি নিয়ে গবেষণার কাজ চালানোকালে প্রথম অ্যানোফিলিস মশার সঙ্গে এই রোগ পরিবহনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আবিষ্কার করেন। জানা যায় যে, স্ত্রী-অ্যানোফিলিস মশা মানুষের রক্ত শোষণের সময় মানুষের রক্তে এই রোগজীবাণু সংক্রমিত করে এবং অ্যানোফিলিস জাতের মশা ছাড়া এর জীবন- চক্রও সম্পূর্ণ হয়না। এই মূল্যবান আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ স্যার রোনাল্ড রসকে ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। কিভাবে মশার দেহমধ্যে প্লাসমোডিয়াম জীবাণুর পরিবর্তন ঘটে বা এ মশাই বা কেমন করে মানুষের দেহে রোগজীবাণু সংক্রমিত করে দেয় এ সব তথ্য জানার জন্যে অবশ্যই প্রাণীবিদদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছিল। রক্তপান ব্যাপারে মশার বিচিত্র অভ্যাসই এই সংক্রমণ ব্যাপারটির জন্য দায়ী। মশা একটানা রক্তপান করে না, কিছুটা রক্ত শোষণের পর তারা লালরস মেশানো ঐ রক্ত ক্ষতস্থানে উগরে দেয় এবং তারপর আবার রক্ত শোষণ করতে থাকে। এর ফলেই লালারসের সঙ্গে অপরিণত প্লাসমোডিয়াম মানুষের রক্তস্রোতে প্রবেশের সুযোগ পায়।
ম্যালেরিয়া পরজীবীর বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনাম্যালেরিয়া পরজীবী অপকারী অন্তঃপরজীবী আদ্যপ্রাণী ও প্লাজমোডিয়াম গণভুক্ত। এদের জীবনচক্রের একটি অংশ মানুষ বা অন্যান্য মেরুদন্ডী প্রাণী এবং পরবর্তী অংশ স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার দেহে সম্পন্ন হয়। কেবল স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা এই রোগ (ম্যালেরিয়া) ছড়ায়।
ম্যালেরিয়া পরজীবীর জীবনচক্র
সম্পাদনাইংরেজ বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস এবং ইটালীয় বিজ্ঞানী গিডভ্যানী ব্যাটিস্তা গ্র্যাসী এই দু'জনের গবেষণার ফলে প্রমাণিত হয় যে, অ্যানোফিলিস মশকীর সাহায্যেই রোগগ্রস্ত মানুষের দেহ থেকে সুস্থ মানুষের দেহে ম্যালেরিয়ার জীবাণু (প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স) সংক্রামিত হয়। মশকীর কামড়ের ফলে যে প্লাসমোডিয়াম মানবদেহে প্রবেশ করে, তার নাম স্পোরোজয়েট (Sporozoite) দেখতে তর্কু বা টাকু (Spindle)-এর মতো। এরা সাময়িকভাবে যকৃতের কোষে আশ্রয় নেয়। এরা বৃদ্ধি পেয়ে প্রাক-বিভাজন সিজোন্ট-রূপ গ্রহণ করে, এবং অবশেষে বিভাজিত হয়ে অনেকগুলি মেরোজয়েট সৃষ্টি করে। এইভাবে প্রতিটি সিজোন্ট থেকে প্রায় ১২০০০ মেরোজয়েট উৎপন্ন হয়। এরা যকৃতের অন্য কোষে, অথবা রক্তের লাল কণিকায় প্রবেশ করে। রক্তের লাল কণিকায় প্রবেশ করে মেরোজয়েট প্রথমে টোফোজয়েটে পরিণত হয়। তা ক্রমশ গোলাকার ধারণ করে। তা আবার সিজোল্ট রূপ ধারণ করে, এবং সিজোগণি-পদ্ধতিতে বিভক্ত হয়ে অনেকগুলি (প্রায় ১৬ টি) মেরোজয়েট উৎপন্ন করে। মেরোজয়েট হল প্লাসমোডিয়ামের অযৌন রূপ। এগুলি লাল কণিকা বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসে এবং আবার রক্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় একপ্রকার বিষ (Toxic substance) রক্তে নির্গত হয়। তাই কাঁপুনি দিয়ে প্রবল জ্বর আসে। নবজাত মেরোজয়েটগুলি নতুন নতুন লাল কণিকাকে আক্রমণ করে। তাই এই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এজন্য প্লাসমোডিয়ামের প্রজাতি অনুযায়ী, ৪৮ ঘণ্টা বা ৭২ ঘণ্টা পরপর, এক সঙ্গে অনেকগুলি করে মেরোজয়েটের সৃষ্টি হয় কাজেই ৪৮ বা ৭২ ঘণ্টা পরপর জ্বরের পালা। এই কারণেই ম্যালেরিয়াকে পালাজ্বর বলা হয়।
উল্লেখ্য যে, লাল কণিকায় প্রবেশ ক'রে কতকগুলি মেরোজয়েট আবার অন্যরকম হয়ে যায়। ট্রোফিক দশার শেষে এরা বিভাজিত হয় না, কিন্তু লাল কণিকা বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসে রক্ত-স্রোতে। এদের মধ্যে কতকগুলি পুরুষ-রূপ এবং অন্যগুলি স্ত্রী-রূপ ধারণ করে। এগুলি প্লাসমোডিয়ামের যৌন-রূপ। এদের গ্যামেটোসাইট বলা হয়।
গ্যামেটোসাইটগুলি মানুষের রক্ত-স্রোতে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এরা কুমার-কুমারী অবস্থায় থাকে, পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না। রোগীকে মশা কামড়ালে, এরা মশার পেটে চলে যায়, এবং সেখানে এদের যৌন-মিলনের ফলে সৃষ্টি হয় জাইগোট। জাইগোট মশার পাকস্থলীর কোষ আশ্রয় ক'রে থাকে। এ থেকে যথাক্রমে উওসিস্ট এবং স্পোরোজয়েটের সৃষ্টি হয়। এগুলি মশার পাকস্থলী থেকে এসে তার লালা গ্রন্থিতে জমা হয়। এই প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগে প্রায় দশ দিন। জীবাণুবাহী এই মশা কোন সুস্থ মানুষকে কামড়ালে জীবাণুগুলি তার রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। এর ফলে তার দেহে ম্যালেরিয়া রোগ সংক্রামিত হয়। এই আলোচনা থেকে বোঝা গেল, ম্যালেরিয়া রোগী, অ্যানোফিলিস মশকী এবং সুস্থ মানুষ এই তিনের যোগাযোগ ছাড়া ম্যালেরিয়া রোগ ছড়াতে পারে না।
পুরুষ-মশার চোষক-নল ভোঁতা, কিন্তু স্ত্রী-মশার নল বেশ সরু। এজন্য স্ত্রী-মশাই শুধু মানুষের রক্ত পান করতে পারে। পুরুষ-মশাকে নানাপ্রকার গাছের রস পান করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। রক্ত চুষে নেবার সময়, রক্ত যাতে জমে না যায়, সেজন্য মশকী রক্তের সঙ্গে ক্রমাগত লালা মিশিয়ে তরল ক'রে নেয়। এই কারণে, মশা যখন কামড়ায়, তখন লালার সঙ্গে রোগ-জীবাণু এসে সুস্থ মানুষের রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, এর ফলে ম্যালেরিয়া-রোগ সংক্রামিত হয়। [১৮]
রোগের লক্ষণ
সম্পাদনা১. প্রথম দিকে মাথাধরা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিদ্রা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। ২. দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগীর শীত শীত অনুভূত হয় এবং কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। জ্বর ১০৫°-১০৬° ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। কয়েক ঘণ্টা পর জ্বর কমে যায়। পরে আবার আসে। ৪৮ ঘণ্টা পর পর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা Plasmodium vivax দ্বারা সৃষ্ট ম্যালেরিয়ার প্রধান লক্ষণ। ৩. তৃতীয় পর্যায়ে রোগীর দেহে জীবাণুর সংখ্যা অসম্ভব ভাবে বেড়ে গেলে দ্রুত রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা ভাঙতে থাকে, ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। যকৃত বড় হয় ও সংক্রমিত হয়। প্লীহা, মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ Caraballo H, King K (মে ২০১৪)। "Emergency department management of mosquito-borne illness: malaria, dengue, and West Nile virus"। Emergency Medicine Practice। 16 (5): 1–23; quiz 23–24। এসটুসিআইডি 23716674। পিএমআইডি 25207355। ২০১৬-০৮-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ক খ গ "Malaria Fact sheet N°94"। WHO। মার্চ ২০১৪। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ আগস্ট ২০১৪।
- ↑ ক খ "CDC - Malaria - FAQs"। ২৮ জুন ২০২৩। ১৩ মে ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- ↑ ক খ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;who2019
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ "Vector-borne diseases"। www.who.int। ২০২৩-০১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৪-২৪।
- ↑ Dahalan FA, Churcher TS, Windbichler N, Lawniczak MK (নভেম্বর ২০১৯)। "The male mosquito contribution towards malaria transmission: Mating influences the Anopheles female midgut transcriptome and increases female susceptibility to human malaria parasites"। PLOS Pathogens। 15 (11): e1008063। ডিওআই:10.1371/journal.ppat.1008063 । পিএমআইডি 31697788। পিএমসি 6837289 ।
- ↑ Basu S, Sahi PK (জুলাই ২০১৭)। "Malaria: An Update"। Indian Journal of Pediatrics। 84 (7): 521–528। এসটুসিআইডি 11461451। ডিওআই:10.1007/s12098-017-2332-2। পিএমআইডি 28357581।
- ↑ "Fact sheet about malaria"। www.who.int। ২০২০-০৫-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-১০।
- ↑ "Fact sheet about malaria"। www.who.int। ২ মে ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
- ↑ Nayyar GML, Breman JG, Newton PN, Herrington J (২০১২)। "Poor-quality antimalarial drugs in southeast Asia and sub-Saharan Africa"। Lancet Infectious Diseases। 12 (6): 488–96। ডিওআই:10.1016/S1473-3099(12)70064-6।
- ↑ ৯৯টি দেশের একটি রিপোর্টে ২০১১ সালে ম্যালেরিয়ার মৃত্যুর সংখ্যা
- ↑ ক খ http://www.who.int/mediacentre/factsheets/fs094/en/index.html
- ↑ Reiter P (১৯৯৯)। "From Shakespeare to Defoe: malaria in England in the Little Ice Age"। Emerging Infectious Diseases। 6 (1): 1–11। ডিওআই:10.3201/eid0601.000101। পিএমআইডি 10653562। পিএমসি 2627969 ।
- ↑ Sharpe S (১৭৬৮)। A view of the customs, manners, drama, &c. of Italy, as they are described in the Frusta letteraria; and in the Account of Italy in English, written by Mr. Baretti; compared with the Letters from Italy, written by Mr. Sharp। London: W. Nicoll।
- ↑ Lindemann M (১৯৯৯)। Medicine and Society in Early Modern Europe। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 62। আইএসবিএন 978-0-521-42354-0। ২০২৩-০১-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-১০-২৭।
- ↑ Gratz NG (২০০৬)। The Vector- and Rodent-borne Diseases of Europe and North America: Their Distribution and Public Health Burden। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 33। আইএসবিএন 978-0-521-85447-4। ২০২৩-০১-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-১০-২৭।
- ↑ ম্যালেরিয়া -অতীত এবং বর্তমান, প্রফেসর পল হেনরী ল্যামবার্ট
- ↑ বই উদ্ধৃতি: মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান লেখক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শিরোনাম:ম্যালেরিয়া, প্রকাশক:শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর:১৯৮৬ পৃঃ১৫৪
- উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান (প্রথম পত্র) - ড. মোহাম্মদ আবুল হাসান