নকশী বিওপির যুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ। আগস্টের শুরুতে তৎকালীন ময়মনসিংহের ঝিনাইগাতির (বর্তমানে শেরপুর) নকশী বিওপিতে পাকিস্তানি অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল আক্রমণ পরিচালনা করে। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষেরই বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।[১]

নকশী বিওপির যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
তারিখ৩ আগস্ট ১৯৭১
অবস্থান
ঝিনাইগাতী, শেরপুর
বিবাদমান পক্ষ

বাংলাদেশ বাংলাদেশ


মুক্তিবাহিনী

পাকিস্তান পাকিস্তান


পাকিস্তান সেনাবাহিনী
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী

বাংলাদেশ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান


বাংলাদেশ মেজর এ জে এম আমিনুল হক


বাংলাদেশ ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী

পাকিস্তান ব্রিগেডিয়ার কাদির খান


পাকিস্তান লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান আহমেদ


পাকিস্তান মেজর রিয়াজ
জড়িত ইউনিট

জেড ফোর্স


৮ ইস্ট বেঙ্গল

৯৩ ব্রিগেড


৩১ বালুচ রেজিমেন্ট
শক্তি
২০০ ১৫০-১৬০ জন
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি

২৬ জন নিহত বা নিখোঁজ


৩৫ জন আহত
অজানা

প্রস্তুতি সম্পাদনা

ব্রিগেড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমানের আদেশ মোতাবেক ৮ ইস্টবেঙ্গলের কমান্ডার মেজর এ জে এম আমিনুল হক ৩ আগস্ট নকশী বিওপিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তিনি মূল আক্রমণ পরিচালনার জন্য ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন। আক্রমণ পরিচালনা করে ব্যাটালিয়নের বি (ব্রাভো) এবং ডি (ডেল্টা) কোম্পানি।

৩১ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত ৮ ইস্ট বেঙ্গলের সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী সুবেদার হাকিমকে নিয়ে নকশী বিওপি এলাকায় রেকি করেন। সুবেদার হাকিম বিওপির বাংকার, কাঁটাতারের বেড়া, মাইন ফিল্ড, বিওপির প্রবেশপথ ও প্রহরীর অবস্থান ইত্যাদি ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি একসময় নকশী বিওপিতে কর্মরত ছিলেন বিধায় তাঁর কাজটা সহজ হয়। এদিকে ওই বিওপিতে রান্নার কাজ করা বাবুর্চির সাথে মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ ছিল। তিনিও মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, নকশী বিওপিতে ৪৫ জন সৈন্য অবস্থান করছে এবং আরও ৬৫ জন সৈন্য আসার কথা। এছাড়াও রয়েছে ৫০-৬০ জন রাজাকার।

দ্বিতীয় দিন ক্যাপ্টেন আমীন তাঁর অধীনস্থ প্লাটুন অধিনায়কদের নিয়ে হালজাতি, নালাপথ ও শালবন এলাকা রেকি করেন এবং এফইউপি (ফরমিং আপ প্লেস) ও ফায়ার বেইসের অবস্থান বুঝিয়ে দেন। পরদিন আবার তিনি সেকশন অধিনায়কদের নিয়ে গিয়ে স্থানগুলাে দেখিয়ে সব বুঝিয়ে দেন। হেভি ও মিডিয়াম মেশিনগান এবং ৭৫ মিলিমিটার ও ১০৬ মিলিমিটার আরআর (রিকয়েললেস রাইফেল)-এর জন্য বাংকার তৈরি করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি ১০০ কেজির বস্তা জোগাড় করা হয়। ২ আগস্ট বিকেলে জেড ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান নিজে এসে প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ ও অবস্থানসমূহ পরিদর্শন করে অপারেশনের চূড়ান্ত অনুমােদন দেন।

এফইউপি হিসেবে ঠিক করা হয় বিওপির পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব দিকের শালবনকে। একটি কাট অফ পার্টিকে ঝিনাইগাতি ও সীমান্ত রাস্তার মিলনস্থল রাংটিয়ায় বসানোর সিদ্ধান্ত হয়, যাতে ঝিনাইগাতি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য কোনো সাহায্য আসতে না পারে এবং নকশী বিওপি থেকে কেউ পালাতে চাইলে তাকে আক্রমণ করা যায়। এছাড়াও তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল মূল আক্রমণকারী দলকে প্রয়োজনে কভারিং ফায়ার দেওয়া এবং রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। ফায়ার বেইস ঠিক করা হয় শালবনের পূর্ব দিকের একটি উঁচু টিলায়। পার্শ্ববর্তী হালজাতি গ্রামে ব্রিগেড কমান্ডার জিয়া ও ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এ জে এম আমিনুল হক থাকবেন বলে ঠিক হয়। অপারেশনের আগে পরপর দুই রাত রেজিমেন্টের সৈনিকদের নিঃশব্দে পানিতে হাঁটার অনুশীলন করানাে হয়, যাতে অপারেশন চলাকালীন নালার পানি অতিক্রম করার সময় কোনাে শব্দ না হয়।

৩ আগস্ট দিবাগত রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক হয়, মূল আক্রমণকারী দলটি (বি ও ডি কোম্পানি) ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে নকশী বিওপির উপর আক্রমণ করবে। আক্রমণ শুরুর আগে আরআর ও মেশিনগান থেকে গােলাবর্ষণের মাধ্যমে শক্রর অবস্থানের ক্ষতিসাধনের পর মূল আক্রমণেও আরআর ও মেশিনগান ফায়ার সাপোর্ট প্রদান করবে।[১]

যুদ্ধ সম্পাদনা

রাত ১২টায় অ্যাসেম্বলি এরিয়া হালজাতি গ্রাম থেকে আক্রমণকারী মূল বাহিনী যাত্রা শুরু করে। রাত ৩টা ৩৫ মিনিটে তারা এফইউপিতে পৌঁছে অবস্থান নেয়। আগের দুদিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল বলে যাত্রাপথে নালা অতিক্রমের সময় কোনো শব্দ হয়নি। এফইউপিতে বাঁয়ে ও ডানে অবস্থান গ্রহণ করে যথাক্রমে ৫ ও ১২ নম্বর প্লাটুন। একই সময় ইপিআর ও মুজাহিদ গ্রুপের ১ প্লাটুন সৈনিক নিয়ে গঠিত কাট অফ পাটি রাংটিয়ায় অবস্থান নেয়।

ক্যাপ্টেন আমীন ৩টা ৪৫ মিনিটে আর্টিলারি (কামান) ফায়ার শুরু করার সংকেত দেন। সংকেত দেয়ার সাথে সাথে আর্টিলারি গর্জে ওঠে। পরপরই গর্জে ওঠে পাকিস্তানি বাহিনীর কামান ও মর্টার। ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ কোম্পানির ২০০ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জন সামরিক বাহিনী, ৮ জন ইপিআর ও ২-৩ জন পুলিশের ছিলেন। বাকি সবাই ছিলেন স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাধারণ যোদ্ধা। ফলে কামানের প্রচণ্ড আওয়াজে এফইউপিতে অবস্থানরত স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকেরা ভয়ে প্রায় মাটির সাথে মিশে যায়। এমন সময় হঠাৎ নিজেদের আর্টিলারির ৩টি শেল এফইউপিতে এসে পড়ে। এতে ৮-১০ জন সৈনিক হতাহত হয়। প্লাটুনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং প্লাটুনের সৈনিকেরা আহতদের সেবা করার নাম করে এফইউপিতেই থেকে যায়। এ সময় ফায়ার বেইস থেকে আরআর ও মেশিনগানগুলোও বিওপির উপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ শুরু করে। পাশাপাশি হালজাতি গ্রাম থেকে ২টি ইপিআর প্লাটুন শত্রুকে ভাঁওতা দেওয়ার জন্য গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই সুযোগে আক্রমণকারী দল এক্সটেনডেন্ট লাইনে সামনে অগ্রসর হয়। আক্রমণকারী দলটি ৫০০ গজ দূরে নালার কাছে পৌঁছালে ক্যাপ্টেন আমীন মর্টার গ্রুপকে নালার আড়াল থেকে গােলাবর্ষণ করার নির্দেশ দেন। সেই সুযােগে স্বল্প প্রশিক্ষিত প্রায় সব সৈনিকই নালার আড়ালে অবস্থান নিয়ে মাথা নিচু করে আন্দাজের ওপর ফায়ার করতে থাকে। নায়েব সুবেদার কাদের ও বাচ্চুর ৫ ও ৬ নম্বর প্লাটুন বিওপির গেটের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু ওই প্লাটুনের সৈনিকরাও নালার ভেতর আড়ালে অবস্থান নিয়ে মাথা নিচু করে এলোমেলোভাবে ফায়ার করতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে সৈনিকদের উপর কমান্ড ও কন্ট্রোল শিথিল হয়ে পড়ে। তাই শত্রু শিবির নিকটবর্তী জেনেও ক্যাপ্টেন আমীন বাধ্য হয়ে চিৎকার করে কমান্ড দিতে থাকেন। তিনি চিৎকার করে এবং গায়ে ধাক্কা দিয়ে যােদ্ধাদের সামনে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিতে থাকেন। তাঁর বাঁয়ে হাবিলদার নাসির অত্যন্ত সাহসিকতা ও ক্ষিপ্রতার সাথে সামনে এগিয়ে যান। ক্যাপ্টেন আমীন নিজেও নায়েক সিরাজকে নিয়ে ডানদিকের বাংকারের দিকে অগ্রসর হন। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা অ্যাসল্ট লাইন ফর্ম করেন।

ক্যাপ্টেন আমীন ‘চার্জ’ বলে আদেশ দিলে মুক্তিযােদ্ধারা ‘ইয়া আলী’ বলে বেয়নেট উঁচু করে বিওপি আক্রমণের জন্য দৌড়াতে শুরু করেন। এ সময় সুবেদার মুসলিম 'নারায়ে তকবির’ বলে চিৎকার করে উঠলে মুক্তিযােদ্ধারা উচ্চকণ্ঠে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে রণাঙ্গন প্রকম্পিত করে তােলেন। মুক্তিযোদ্ধারা যখন শত্রু শিবিরের মাত্র ১০০ গজের মধ্যে পৌছে যান, ঠিক তখনই শক্রর নিক্ষিপ্ত একটি আর্টিলারি শেল এসে তাঁদের ওপর পড়ে। এতে বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে হাবিলদার নাসিরও ছিলেন। এ অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধারা কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। অধিনায়ক আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর পায়ে শেলের একটি টুকরা আঘাত করে। আঘাতের গুরুত্ব বুঝে ওঠার আগেই তিনি শত্রু শিবিরের দিকে আরও ৫০ গজ এগিয়ে যান। মুক্তিযােদ্ধারাও ছত্রভঙ্গ অবস্থা সত্ত্বেও এগিয়ে যান এবং পলায়নরত শত্রু সৈন্যদের আঘাত করতে থাকেন। পাকিস্তানিদেরও তখন বেশ হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ সময় অনার্সের ছাত্র মুক্তিযােদ্ধা শামসুল আলম মাইনের আঘাতে শহীদ হন। ক্যাপ্টেন আমীন আরও অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ঠিক তখনই বাঁ পায়ে বাঁশের কঞ্চিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর এত কাছে ছিলেন যে এক পাকিস্তানি সেনা তাকে বেয়নেট বিদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসে। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সালাম গুলি করে তাকে হত্যা করে। এদিকে পেছনে নালার মধ্যে মাথা নিচু করে যারা গুলিবর্ষণ করছিল তাদের গুলিতে অনেক মুক্তিযােদ্ধা হতাহত হন। আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে গিয়েও ক্যাপ্টেন আমীন পাকিস্তানিদের ওপর গুলি চালাচ্ছিলেন। তাঁর সাথে থাকা গার্ড হানিফকে (একজন অবাঙালি ছেলে) তিনি ডান দিকের বাংকারে গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। হতাহতের কারণে মুক্তিযােদ্ধারা তখন অনেকাংশেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছেন। হানিফ তখন বারবার অনুরােধ করছিল, “স্যার, আব পিছে চালে যাইয়ে, ম্যায় কভারিং দে রাহাহু (স্যার, আপনি পেছনে চলে যান, আমি কভার দিচ্ছি)"। দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেয়ার আগেই গুলিবিদ্ধ হয়ে হানিফ শাহাদতবরণ করেন। সাথে সাথে শক্রর গুলিতে ক্যাপ্টেন আমীনের পাশের মাটি উড়ে যায়। তিনি বুঝতে পারেন, শত্রু তাঁকে দেখে ফেলেছে। তিনি সাইড রােল করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় বাঁ দিক থেকে একটি গুলি এসে তাঁর ডান হাতের কনুইতে আঘাত করে। তাঁর হাতের স্টেনগান ছিটকে পড়ে। বাঁ হাত দিয়ে তিনি সেটি তুলে নেন। আঘাতের স্থান থেকে তখন রক্ত ঝরতে থাকে। তিনি ফিল্ড ড্রেসিং বের করতে চেষ্টা করেন। তখনই আবার তাঁর দিকে একঝাঁক গুলি ছুটে আসে এবং পাশের আইল উড়িয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন, সেখানে থাকা আর সম্ভব নয়। চারদিকে তখন কেবল লাশ আর লাশ।

মুক্তিবাহিনীর যে ৮-১০ জন সৈনিক শক্রর বাংকারে ঢুকে পড়েছিলেন, তাঁরাও শহিদ হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নায়েক সিরাজ ও পুলিশের ল্যান্স নায়েক সুজা মিয়া। গুরুতর আহতাবস্থায় শত্রুর আওতা থেকে বের হওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন আমীন সাইড রােল করতে করতে শালবনের দিকে যান। এ সময় অষ্টম শ্রেণির সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সালাম পঞ্চাশ গজ পেছন থেকে হঠাৎ দৌড়ে এসে পড়ে থাকা একটি এলএমজি নিয়ে 'জয় বাংলা’ বলে শত্রু বেষ্টনীর দিকে ছুটে যান। শত্রু তখন কাউন্টার অ্যাটাকের জন্য আবার একত্র হচ্ছিল। “ওরে তােরা আমার মা-বাপ সবাইকে মেরেছিস, আমি তোদেরকে ছেড়ে দেব?” চিৎকার করতে করতে সালাম শত্রু বেষ্টনীর মধ্যে ঢুকে পড়েন। সংসারে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি বলে সালামকে অপারেশনটাতে নেওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি গোপনে পালিয়ে এসে অ্যাসেম্বলি এরিয়ায় আক্রমণকারী দলে যােগ দেন।

বিওপির ভেতর ও আশপাশ তখন লাশে ভরে গেছে। বৃষ্টির মতাে গুলিবর্ষণ চলছে। ফায়ার বেইস থেকে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান তখন পশ্চাদপসরণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের কভার দিয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া ক্যাপ্টেন আমীন নিজেদের কভারিং ফায়ার থেকে বাঁচার জন্য ডানদিকের নিচু ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে চলতে শুরু করেন। নালার কাছে পৌছে সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে কোনাে রকমে নালা পার হন। কিন্তু এ সময় আরো এক ঝাঁক গুলি এসে তাঁর পায়ের কাছের মাটি উড়িয়ে নিয়ে যায়। হঠাৎ তিনি দেখতে পান, ১০-১২ জন পাকিস্তানি সেনা কর্দমাক্ত মাটিতে তাঁর আসার চিহ্ন ও রক্তের দাগ অনুসরণ করে তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে। এদিকে ধানক্ষেতের আড়ালে প্রায় ৩০০ গজ অগ্রসর হওয়ার পর ধানক্ষেত শেষ হয়ে যায়। এরপর ২০০ গজ খােলা মাঠ। মুক্তিযােদ্ধাদের দিক থেকেও তখন কোনাে সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। ফায়ার বেইস থেকে এতক্ষণ কভার দেওয়া মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানটিও তখন নীরব। এফইউপির প্রহরায় যারা ছিল, তারাও স্থান ত্যাগ করেছে। শত্রু তখন ৫০ গজের মধ্যে চলে এসেছে। তিনি কোনােরকমে নিজেকে টেনে নিয়ে কামানের গােলায় সৃষ্ট একটি গর্তে আশ্রয় নেন। সারা শরীরে কাদা মেখে মাথার নিচে হেলমেটটা দিয়ে শুয়ে পড়েন। সময় তখন সকাল ৮টা ১০। নিজ বাহিনীর কারো খোঁজ নেই। ঠিক এমন সময় শালবন থেকে তিনি তাঁর কমান্ডিং অফিসার মেজর এ টি এম আমিনুল হকের গলা শুনতে পান, “আমীন, আস্তে আস্তে আসার চেষ্টা করাে।” ক্যাপ্টেন আমীনের নিহত অথবা নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে ব্রিগেড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক আমিনুল হককে নির্দেশ দেন তাকে খুঁজে বের করতে। সেজন্য মেজর আমিনুল হক ক্যাপ্টেন আমীনের খোঁজে বেরিয়েছিলেন। সৈনিকেরা বিপদের মুখে ক্যাপ্টেন আমীনের দিকে এগিয়ে আসতে ইতস্তত করছে দেখে মেজর আমিনুল হক নিজেই ক্রল করে আসতে থাকেন। হাবিলদার তাহের তাঁকে অনুসরণ করেন। তাঁরা ক্যাপ্টেন আমীনের পা ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকেন। ওদিকে পাকিস্তানি সেনারা তখন তাঁদের অবস্থান থেকে মাত্র ২০-২৫ গজ দূরে। তারা একজন আহত মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করে এগিয়ে আসছে এদিকে। লেফটেন্যান্ট মুদাচ্ছের তখন চিৎকার করে তাঁদেরকে তাড়াতাড়ি সরে আসতে বলছেন। নিজের কমান্ডারদের গায়ে গুলি লাগার ভয়ে তিনি শত্রুদের উপর গুলি চালাতে পারছিলেন না। তাই ২ জন এলএমজি-ম্যানকে তাদের এলএমজি নিয়ে গাছের ওপর উঠে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর ফায়ার করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাকিস্তানিরা ক্যাপ্টেন আমীনের কাছাকাছি আসার আগেই এলএমজির গুলিতে তাদের ৬-৭ জন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পথপ্রদর্শক মকবুলসহ ২ জন দেশীয় দালাল ধরা পড়ে। ২ জন পাকিস্তানি সৈন্য দৌড়ে পালায়। মেজর আমিনুল হক ক্যাপ্টেন আমীনকে কাঁধে তুলে নিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে একটু এগিয়েই ২ জনই নালাতে পড়ে যান। হাবিলদার তাহের তখন ক্যাপ্টেন আমীনকে কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড়ে নিরাপদ স্থানে সরে আসেন। [২] [৩]

ক্ষয়ক্ষতি সম্পাদনা

নকশী বিওপির যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ২৬ জন শহীদ অথবা নিখোঁজ হন। ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীসহ ৩৫ জন আহত হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দশজনের লাশ পরদিন পাকিস্তানিরা ফেরত দেয়। তবে তার আগে তারা মৃতদেহগুলো বিকৃত করে। পাকিস্তানিদের হতাহতের কোনাে বিবরণ পাওয়া যায় নি। তবে তাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।[৪]

বিশ্লেষণ সম্পাদনা

  • নকশী বিওপি আক্রমণের আগে সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হয়। তাই পাকিস্তানি বাহিনী আকস্মিক এ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ পায়নি। একই কারণে তারা বাইরে থেকে অতিরিক্ত সৈন্যও আনতে পারেনি। গােপনীয়তা রক্ষার জন্য বিওপির পার্শ্ববর্তী অবস্থানকে চমৎকারভাবে কাজে লাগানাে হয়। ঘন শালবনের আড়ালে ফায়ার বেইস স্থাপন ও রেকি এবং প্লাটুন ও সেকশন পর্যায়ের কমান্ডারদের এফইউপি ও ফায়ার বেইস সশরীরে নিয়ে গিয়ে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন আমীন। গােপনীয়তার সাথে বালির বস্তা সহযােগে বাংকার তৈরি করে ফায়ার বেইস স্থাপন করা হয়। এর সবই সম্ভব হয়েছিল ঘন শালবনের কারণে। এছাড়াও আক্রমণপূর্ব গােয়েন্দা কার্যক্রমও ছিল সফল। বিওপির গারাে বাবুর্চি ছিলেন মুক্তিবাহিনীর তথ্যদাতা। তিনি বিওপির সামগ্রিক অবস্থা মুক্তিবাহিনীকে জানান। আবার ইপিআর সুবেদার হাকিম মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এ বিওপিতে অবস্থান করেছিলেন বলে রেকির কাজটাও সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
  • যুদ্ধের পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে বিওপির আশপাশের এলাকার জনগণও সহযােগী মনােভাব প্রদর্শন করে। রেকি চলাকালে রেকি পার্টি স্থানীয় একটি গারাে মেয়ের চোখে ধরা পড়ে গেলেও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ মুক্তিবাহিনীর এই কার্যক্রমের কোনাে আভাস পায়নি।
  • ফায়ার বেইসের অবস্থান ও সংগঠন ছিল চমৎকার। ফায়ার বেইস থেকে মেশিনগান ও আরআর এর কার্যকর গােলাবর্ষণ পাকিস্তানিদের বেশ বিপদে ফেলে। যুদ্ধের একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনী যখন পশ্চাদপসরণ করছিল, তখনাে ফায়ার বেইস কার্যকর কভারিং ফায়ার দিতে সক্ষম হয়।
  • যুদ্ধে ব্রিগেড অধিনায়ক জিয়া নিজে আক্রমণের জন্য যেসব স্থান চিহ্নিত করেছিলেন এবং যেসব স্থাপনা ব্যবহার করা হয়েছিল, তা পরিদর্শন করেন। তিনি নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর উপস্থিতি যােদ্ধাদের মনােবল বহুগুণে বৃদ্ধি করেছিল।
  • যুদ্ধে গুরুতর আহত ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদকে মেজর এ জে এম আমিনুল হক ও হাবিলদার তাহের শত্রু সৈন্যের অবস্থানের মাত্র ২০-২৫ গজ দূর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। সহযােদ্ধার প্রতি এ ঝুঁকিপূর্ণ কর্তব্যবােধ ও পদক্ষেপকেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
  • এছাড়াও এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ওপরস্তরের অধিনায়কদের সচেতনতা একটি নতুন মাত্রা যােগ করে। বিশেষ করে ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী শহীদ অথবা নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে জেড ফোর্সের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর আমিনুল হককে কমান্ডােদের সাথে নিয়ে ক্যাপ্টেন আমীনকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। ওপরস্তরের অধিনায়কদের এই দায়িত্ববােধ মুক্তিবাহিনীর মনােবলকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু এসব ইতিবাচক ঘটনা ও পরিস্থিতি অনুকূলে থাকার পরও নকশী বিওপির যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পূর্ণ সাফল্য লাভ করতে পারেনি। যুদ্ধে পুরোপুরি সফল না হওয়ার কারণ হিসেবে বলা যায় স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাল্পতার কথা।

৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিকাংশ সৈন্য ছিল স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের কোনাে যুদ্ধ অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে কামানের গােলাবর্ষণের প্রচণ্ড শব্দে তারা ঘাবড়ে যায়। ৫ ও ৬ নম্বর প্লাটুনের দায়িত্ব ছিল বিওপির গেটের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করা। কিন্তু এ প্লাটুন ২টি বিওপিতে পৌছানাের পূর্বেই নালার আড়ালে আশ্রয় নিয়ে মাথা নিচু করে আন্দাজে ফায়ার করতে থাকে। ফলে লােকবলের ঘাটতি দেখা দেয়। শুধু তাই নয়, তাদের নিক্ষিপ্ত গুলিতেই সামনে এগিয়ে যাওয়া নিজেদের সৈনিকেরা হতাহত হয়। যুদ্ধে সাফল্য না পাওয়ার এটি অন্যতম কারণ।

এফইউপিতে অবস্থান করার সময় আর্টিলারির ৩টি শেল মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এসে পড়ে। নকশী বিওপি, মুক্তিবাহিনীর এফইউপি ও সাপাের্ট আর্টিলারির অবস্থান একই লাইনে হওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। এফইউপিতে শেল এসে পড়ায় ৮-১০ জন হতাহত হয় এবং তাদের সেবা-শুশ্রূষার নামে পুরো প্লাটুনই এফইউপিতে থেকে যায়। ফলে সৈনিকের সংখ্যাল্পতায় আক্রমণের তীব্রতা কমে যায়। নকশী বিওপিতে নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলিয়ে ১ কোম্পানির মতো পাকিস্তানি সেনা মােতায়েন ছিল। কিন্তু আক্রমণের সামরিক নীতি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ২ কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর সেনা পর্যাপ্ত ছিল না। তাছাড়া শত্রুরা ছিল উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যুদ্ধক্ষেত্রে এফইউপি থেকে ১ প্লাটুন সামনে অগ্রসর না হওয়ায় এবং ২ প্লাটুন নালাতে অবস্থান নেওয়ায় আক্রমণকারী সেনার সংখ্যা একেবারে কমে যায়। কোনাে রিজার্ভ রাখা হয়নি। রাংটিয়ায় যে সেনাদল কাট অফ পার্টির ভূমিকা পালন করছিল, তাদেরই রিজার্ভ হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। এজন্য মূল আক্রমণকারী বাহিনী মাইনফিল্ড ও বাঁশের কঞ্চির প্রতিরোধ পার হয়ে বিওপির মূল মাটির দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছালেও পর্যাপ্ত সেনাবলের অভাবে বিওপি দখল করা যায় নি। [১]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "নকশী বিওপির যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক"ঢাকা। ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ১৮, ২০২০ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "নকশী বিওপির যুদ্ধ" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে
  2. https://www.liberationwarbangladesh.org/?p=1242%7C১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন: মেজর জেনারেল (অবঃ) আমীন আহম্মেদ চৌধুরী; প্রথমা প্রকাশন (২০১৬); পৃষ্ঠা ১২১-১৩৪
  3. http://archive.prothom-alo.com/print/news/297453[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  4. ব্যাটল অব নকশী - রকমারি ব্লগ https://blog.rokomari.com/others/battle-of-nakshi-bop/&ved=2ahUKEwje3JGKrortAhXRbCsKHfsNATgQFjAAegQIBBAB&usg=AOvVaw3WWfh4HjrRiwOuiz_nG17s[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]