বয়রার যুদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর তারিখে সংগঠিত একটি আকাশ যুদ্ধ যেটি ভারতীয় বিমান বাহিনী ও ভারতীয় আকাশ সীমায় অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর যুদ্ধ বিমানের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অংশ হিসাবে গরিবপুরের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর (বাঙালি গেরিলা যোদ্ধা) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়নও জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের স্থল বাহিনী ঢাকায় অবস্থিত পিএএফ'এর নিকট থেকে সরাসরি বিমান আচ্ছাদনঘনিষ্ট বিমান সহায়তা পায় এফ-৮৬ স্যাবর জেটের দ্বারা যার চালকগণকে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ইন্দো-পাক সীমান্ত পেরোনোর দায়মুক্তির নির্দেশনা দেয়া হয়েছিলো। এই আকস্মিক আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য ৪টি ফোলল্যান্ড ন্যাট'এর একটি বহর মূল ঘাটি ১০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত খড়গপুরের নিকটবর্তী কালাইকুন্ড হতে দমদম (কোলকাতা বিমানবন্দর)'এ স্থানান্তরিত করা হয়। এই বহরের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রয় অ্যান্ড্রু ম্যাসে।[৪]

বয়রার যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
তারিখ২২ নভেম্বর ১৯৭১
অবস্থান
বয়রা মুখ, যেটি পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাংশ হতে ভারতে প্রবেশ করেছে।
ফলাফল ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাময়িক বিজয়।
পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর ঘনিষ্ট বিমান সহায়তা কার্যক্রম স্থগিত।
বিবাদমান পক্ষ
 India
ভারত (আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধে যোগদান)
 পাকিস্তান
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
ভারত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রয় এন্ড্রু ম্যাসে পাকিস্তান উইং কমান্ডার আফজল চৌধুরী
পাকিস্তান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পারভেজ মেহেদী কোরেশী
শক্তি
৪টি এইচএএল ফোলল্যান্ড ন্যাট ৩টি স্যাবর এমকে৬
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
নেই ২টি পিএএফ স্যাবর ভূপাতিত।
একটি ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু ঢাকায় অবতরণ করতে সক্ষম হয়। ২ জন পিএএফ পাইলট যুদ্ধবন্দি[১][২][৩]

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় ও পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর মধ্যে প্রথম সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণে এই যুদ্ধটি ছিলো একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এটিকে গরিবপুরের যুদ্ধের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করা হয় যেখানে মিত্র বাহিনী (মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর জোটকে বাংলায় মিত্রবাহিনী হিসেবে উল্লেখ করা হয়) সফলভাবে গরিবপুর এলাকায় অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর একটি ব্রিগেডকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় এবং ফলশ্রুতিতে তাদের চরম হতাহত করে।

“বয়রা যুদ্ধ” নামকরণ করা হয়েছে গরিবপুর এলাকার সন্নিকটবর্তী বয়রা ভূখণ্ড থেকে এবং কার্যত এটি যেহেতু এটি আকাশ পথে সংগঠিত হয়েছেিলো সেহেতু এটি বয়রার আকাশ যুদ্ধ হিসাবেই চিহ্নিত হওয়া উচিত।

পটভূমি সম্পাদনা

পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অভ্যন্তরীণ উত্তেজনার মাসআধিক কাল পরে সংগঠিত ১৯৭১ সালের গণহত্যা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের উপর চালানো দমন-পীড়নের অনেক স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা গেরিলা বাহিনী হিসাবে সংগঠিত হয়। মুক্তিবাহিনী নামে পরিচিত এই বিদ্রোহীরা তাদের লড়াইয়ে ভারতের সাহায্য ও সহযোগীতা লাভ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রাথমিক সাফল্যের পর এই অঞ্চলে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং ঘটনা চক্রের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য আরও ভারতীয় সহায়তা চাওয়া হয়। অর্থনৈতিকভাবে ১ কোটিরও অধিক বাংলাদেশী শরণার্থীর[৫][৬][৭] চাপের কারণে ভারত পূর্বাঞ্চলের এই দ্বন্দ্বে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং সীমান্তের কাছে তার বাহিনী মোতায়েন করতে থাকে।[৮]

গরিবপুর গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত বয়রা মুখ অঞ্চলটি পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিমাংশের অভ্যন্তর ভাগে অবস্থিত, যেটি উভয় দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিস্থল ছিল। ভারত থেকে যশোরে আসার একটি মহাসড়ক অন্তর্ভুক্ত থাকায় এর নিয়ন্ত্রণ নেয়া উভয় পক্ষের জন্যই অত্যাবশ্যক ছিল।

ভারতের ১৪ নং পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ন ২১ নভেম্বর তারিখে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অবস্থিত গরিবপুরের পার্শ্ববর্তী এলাকা দখল নেয়ার জন্য ৪৫ ক্যাভার্লি থেকে প্রাপ্ত ১ স্কোয়াড্রন ১৪ পিটি-৭৬ ট্যাংক বহরের সহায়তায় অগ্রসর হয়। এই অগ্রসর হওয়ার পদক্ষেপটি একটি চমৎকৃত ঘটনা হিসাবে পরিগণিত হতো, কিন্তু পূর্বের দিন উভয় সেনাদলের টহল সেনাদের মধ্যে সংগঠিত সংঘর্ষের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানি সেনা দলকে এই আসন্ন আক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিলো। এম২৪ চ্যাফি হালকা ট্যাংকে সজ্জিত ৩য় স্বতন্ত্র আর্মার্ড স্কোয়াড্রন দ্বারা সমর্থিত ১০৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড যোগদানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনা দলের সংখ্যা বৃদ্ধির দ্বারা অবিলম্বে এই অগ্রগমণের প্রত্যুত্তর দেয়া হয়। সুবিশাল সেনাদলের সহায়তায় সংখ্যাধিক্যের কারণে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়ে পাকিস্তানি সেনারা ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের আঘাত করতে অবস্থান নেয়। কিন্তু দীর্ঘ বীরত্বব্যঞ্জক ইতিহাসের জন্য সুবিদিত পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ন প্রতিহত করে এবং নিজেদের পালটা আঘাতের জন্য নিজেরা সুসংহত অবস্থান নেয়। আসন্ন পাকিস্তানি আক্রমণের প্রতিআক্রমণ করার জন্য পদাতিক এবং রিকয়েললেস রাইফেলধারীরা আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে ট্যাঙ্ক বহরকে এগিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় কুয়াশার কারণে দৃশ্যমানতা হ্রাসের ফলে হামলার সঠিক উৎস নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হওয়া পাকিস্তানিদের আক্রমণকে ভারতীয় সেনারা বিচূর্ণ করে দেয়। আর, এই মুখোমুখি মোকাবেলায় ভারতীয় সেনাদলের আত্মরক্ষামূলক অবস্থানের বিপরীতে পাকিস্তানি ট্যাংক এবং পদাতিক বাহিনী আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।[১][৩] এর ফলশ্রুতিতে সংগঠিত হওয়া যুদ্ধটিই গরিবপুরের যুদ্ধ নামে খ্যাত।

শত্রুর সাথে সন্মুখ যুদ্ধকালীন উচ্চস্তরেরসহ হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় এবং মিত্র বাহিনীকে স্থানচ্যুত করাতে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর্টিলারিঘনিষ্ট বিমান সহায়তা চায়।[১][২] ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর প্রত্যুষে ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে কিছু স্যাবর এমকে৬ প্রেরণের মাধ্যমে তাতে সাড়া দেয়া হয়। এটিই বয়রার যুদ্ধের সূচনা করে।[২]

জড়িত ইউনিটসমূহ সম্পাদনা

পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জড়িত ইউনিটটি ছিল ১৪ নং স্কোয়াড্রন টেইল-চপার্স,[৯] যাদের শক্তিমত্তা হিসাবে ছিলো ২০টি ক্যানডাইর স্যাবর এমকে৬। এগুলো ছিল ক্যানডাইর নির্মিত এফ-৮৬ স্যাবরের সংস্করণ যেগুলোতে এআইএম-৯ সাইডউইন্ডার মিসাইল সংযোজন দ্বারা মানোন্নীত করা এবং অধিক শক্তিশালী এ্যাভ্রো কানাডা ওরেন্ডা ইঞ্জিন দ্বারা চালিত। জার্মানি এবং ইরানের মধ্যে সম্পাদিত একটি গোপন চুক্তির ফলে এই স্যাবরগুলো পাকিস্তানে পাচার হয়ে আসে।[১০][১১] এই স্কোয়াড্রনটির নেতৃত্বে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পারভেজ মেহেদী কোরেশী যিনি পরবর্তীকালে সিএএস হিসাবে নিযোগ লাভ করেন যাতে তিনি পিএএফ'এর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার স্পষ্টাস্পষ্টি এবং সোজা-সাপ্টা কর্মকান্ডের জন্য সুবিদিত ছিলেন।

ঠিক কি কারণে অপেক্ষাকৃত নবীন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কোরেশি একটি স্কোয়াড্রন বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ লাভ করেছিলেন (সাধারণতঃ একজন “স্কোয়াড্রন লিডার” নেতৃত্ব দেন) তা অজ্ঞাত। তবে ৭১'এ যুদ্ধকালীন সময়ে এটি পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে থাকা বাঙালিদের জন্য প্রচলিত ছিল দল ত্যাগ করা ও মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করা বা বিমান চালনা হতে অব্যহতি দিয়ে ঘাঁটিতে সরিয়ে নেয়া বা নের্তৃত্ব দানকারী অবস্থানে থাকা ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য সম্পর্কিত সন্দেহের কারণে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া,[৮] সম্ভবতঃ এটি একটি সম্ভাবনা যার ফলশ্রুতিতে এমনটি ঘটেছিলো।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর জড়িত ইউনিটটি ছিল আইএএফ ২২ নং স্কোয়াড্রন সুইফ্টস্ যেটি সজ্জিত ছিলো পরিমার্জিত ফোলল্যান্ড জিনাট দ্বারা যা “স্যাবর হত্যাকারী” (Sabre Slayer) নামে আখ্যায়িত হতো। এই স্কোয়াড্রনটি ছিলো কালাইকুন্ড বিমান বাহিনী ঘাটি ভিত্তিক এবং কলকাতায় সেক্টরের আকাশ সীমা প্রতিরক্ষায় নিযোজিত। এর একটি খন্ডিত অংশ কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে অবস্থান নিয়েছিলো। এই ইউনিটটির নেতৃত্বে ছিলেন উইং কমান্ডার বিএস সিকান্দ (যিনি পরবর্তী কালে ‘এয়ার মার্শাল’ পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন)।

যদিও ক্যানডাইর স্যাবর এমকে৬-কে ব্যাপকভাবে তার যুগের সেরা “ডগ ফাইটার” (dogfighter) হিসাবে গণ্য করা হয়।[১২] জিনাট বুদ্ধিমত্তার সাথে স্যাবরকে উল্লম্ব অবস্থান গ্রহণে বাধ্য করে যেটিতে স্যাবরের দুর্বলতা ছিলো। অধিকন্তু, স্বল্প ওজন এবং যুথবদ্ধ আকৃতির কারণে জিনাট সচরাচর দৃশ্যমান হতো না, বিশেষত নিচু স্তরে যেখানে অধিকাংশ ডগ ফাইটার সংগঠিত হয় সেখানে এমনটি ঘটতো।[১৩]

যুদ্ধের বিবরণ সম্পাদনা

যেহেতু পিএএফ স্যাবর সীমান্ত এলাকায় আক্রমণ পরিচালনা করেছিলো সেহেতু তাদের দ্বারা এই স্থানে ভারতীয় ভূখণ্ডের আকাশ সীমা লঙ্ঘন ঘটে। ভারতীয় রাডারে ০৮১১ ঘটিকায় যশোর এলাকায় চার স্যাবরের প্রথম অনুপ্রবেশের ঘটনাটি ধারণ করা হয়। এদের বাধা দিতে দমদম বিমানবন্দর থেকে থেকে ২২ নং স্কোয়াড্রনের চারটি জিনাট ছুটে যায়। যদিও যে সময় জিনাট বয়রা এলাকায় পৌঁছে ততক্ষণে স্যাবর তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে ফিরে আসে। পাকিস্তানিদের দ্বিতীয় অভিযানটি ১০২৮ ঘটিকায় ঘটে। এই ক্ষেত্রেও পুনরায় সময়মতো বাধা দেয়া সম্ভব হয়নি এবং স্যাবরগুলো নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলো।

প্রায় ১৪৪৮ ঘটিকায় রাডারে চারটি স্যাবরের অবস্থান ধরা পড়ে যেগুলো ভূমি থেকে প্রায় ২,০০০ ফু (৬১০ মি) উঁচু দিয়ে উত্তর পশ্চিম অভিমুখে ছুটে যাচ্ছিলো। এক মিনিটের মধ্যে দমদম ওআরপি থেকে সাড়া দেয়া হয়। ১৪৫১ ঘটিকায় ঘাটির অধিনায়ক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রায় অ্যান্ড্রু ম্যাসের নেতৃত্বে চারটি জিনাট ধেয়ে যায়। এটি রাডার কর্তৃক স্যাবরগুলো শনাক্ত করার তিন মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে।[১৪]

এই অংশের বিমান নিয়ন্ত্রক হিসাবে ছিলেন ফ্লাইং অফিসার কেবি বাগচী, যিনি জিনাটগুলোর দ্বারা স্যাবরগুলোকে নিশ্চল করে দিয়েছিলেন এবং বাঁধা দান সম্পর্কে নির্দেশনাগুরো জানাচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে অতিবাহিত আট মিনিটে বেশ কিছু হামলা চালানো স্যাবরগুলো বয়রা ভূখন্ডে পৌঁছানো জিনাটগুলোর মুখোমুখি হয়ে অরেকটি আক্রমণ করার জন্য ঝাঁপ দেয় - তারা ছিলো ১,৮০০ ফুট (৫৫০ মি) উচ্চতায় এবং আক্রমণ করার জন্য ৫০০ ফুট (১৫০ মি)-এ নেমে আসার জন্য নিম্ন মুথী ঝাঁপ দেয়।

চারটি জিনাট দুটি ভাগে বিভক্ত হয় এবং হঠাৎ করে নিম্নগামী হয়ে স্যাবরগুলোর উপর আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়ে। প্রথম ভাগের জিনাটে ছিলেন ম্যাসে এবং ফ্রাইং অফিসার এসএফ সরোজ ছিলেন তার ডানা-সহচর হিসাবে। দ্বিতীয় ভাগটি গঠিত হয়েছিলো ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম এ গণপতি এবং ফ্রাইং অফিসার ডি লাজারাসকে নিয়ে। যেহেতু হঠৎ করে জিনাটগুলো নিম্নমুখী ঝাপ দিয়েছে সেহেতু দুটি স্যাবরের একটি অংশ হামলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে এবং নিজেদেরকে গণপতি ও লাসারাসের ঠিক সামনের একটি বিশ্রী অবস্থানে এনে স্থাপন করে। উভয় বিমান চালকই তখন ২০মিমি কামান থেকে গোলা বর্ষণ শুরু করে দেন এবং উভয় স্যাবরই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণপতি আর/টি'তে সামরিক বার্তা হিসাবে “খুন খুন খুন” প্রেরণ করেন। পাকিস্তানি চালক পারভেজ মেহেদী কোরেশী এবং খালীল আহমেদ বয়রার উপর প্রক্ষিপ্ত হন এবং প্যারাস্যুটের মাধ্যমে নিরাপদে অবতরণ করেন কিন্তু যুদ্ধবন্দী হিসাবে ধৃত হন। পরিত্যক্ত স্যাবরগুলোর ধ্বংসাবশেষ ভারতের বনগাঁ গ্রামের কাছাকাছি ছিঁটকে হয়।[৩][১৪][১৫]

ইত্যবসরে ম্যাসে অন্য স্যাবরের মুথোমুথি হতে গণপতি এবং লাসারাসের উপর অবস্থান নেন। স্যাবরের পাইলট উইং কমান্ডার চৌধুরী - একজন সুদক্ষ বিমানযোদ্ধা ন্যায় পদক্ষেপ নেন - ম্যাসের হামলা ন্যাস্যাত করে দেবার জন্য তাকে অধিক কৌণিক অবস্থানে যেতে বাধ্য করেন যার ফলে তার ছোড়া গোলা লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হন। গুলি করার সঠিক অবস্থানে ফিরে আসার অব্যহতি পর এবং লক্ষ্যস্থির করে ম্যাসে ৭০০ গজ (৬৪০ মি) দূরে অপর একটি গোলা নিক্ষেপ করেন এবং তার পোর্ট উইং'এ আঘাত করতে সক্ষম হন। এই সময় ম্যাসের বিমানের ডানদিকের কামান থেকে গুলি বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু স্যাবর পেছনো আগুন এবং ধোঁয়ার কুন্ডলি নিয়ে পাকিস্তানের সীমানায় ফিরে যায়। ম্যাসে বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের আকাশসীমায় বিমানযুদ্ধটি ভালো ভাবে সমাপণ করেছে এবং বিমান ঘুরিয়ে পুনরায় তার দলের অন্যদের সাথে যোগ দিলেন যারা তখন ঘাঁটিতে ফিরে আসার জন্য রওনা হযেছিলেন। প্রথমে এটা ধারণা করা হয়েছিলো যে, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত স্যাবরটি পরবর্তীতে নিশ্চিতভাবেই বিধ্বস্ত হবে, কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী প্রতিবেদন নিশ্চিত করে সেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত স্যাবরকে উড়িয়ে ঢাকার অদূরে অবস্থিত তেজগাঁও বিমানবন্দরে ফিরিয়ে নিয়ে এসে ম্যাসের দ্বারা আক্রান্ত উইং কমান্ডার চৌধুরী অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। চৌধুরী নিজে একটি জিনাট ভূপাতিত করেছেন বলে দাবী করেন, যেহেতু ৪টি জিনাটের সবগুলোই নিরাপদে অবতরণ করেছিলো ফলে তা পরবর্তীকালে মিথ্যা বলেই প্রমাণিত হয়।[২][৩][১৬]

যুদ্ধ অব্যাহতির পর সম্পাদনা

হাজার হাজার মানুষের সামনে সংঘটিত এই যুদ্ধটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত হিসাবে চিরভাস্বর হয়ে আছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে চার বিমান চালক ভারত ও বাংলাদেশে রাতারাতি বিখ্যাত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাদের ছবি, অস্ত্র-চিত্রধারকে ধারণকৃত (বহিঃচিত্র দেখুন) জজ্বল্যমান স্যাবরগুলোর ছবি এবং পিএএফ'এর যুদ্ধবন্দিগণ বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিলো।[১৭]

৬ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত এই সম্পৃক্ততা দ্বারা চিহ্নিত হয় যে ভারতীয় উপমহাদেশে আকাশ যুদ্ধ্বে গুলি করে বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে এবং এই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে যা ১৯৭১'এর ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধে রূপ নেয় এবং এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে।

  • প্রত্যেক ভারতীয় পাইলট বীর চক্র সম্মননা লাভ করেন। বিমান নিয়ন্ত্রক ফ্লাইং অফিসার কেবি বাগচী বায়ুসেনা পদক লাভ করেন। উইং কমান্ডার সিকান্দা'কে অতি বিশিষ্ট সেবা পদক (AVSM)-এ ভূষিত করা হয়।
  • রয় অ্যান্ড্রু ম্যাসে পরবর্তীতে আইএএফ'এর ২২৪ নং স্কোয়াড্রন'এর কমান্ডার নিযুক্ত হন যেটি মিগ-২৩ পরিচালনা করত। তিনি ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে, ঠিক ১২ বছর পরে, পাখি-সংঘর্ষে মৃত্যুবরণ করেন।[১৬][১৮]
  • ডোনাল্ড লাজারাস আইএএফ ১০২ নং স্কোয়াড্রন - দ্যা ট্রিসোনিক -'এর কমান্ডিং অফিসার হয়েছিলেন যেটি ভারতের গোপনতম মিগ-২৫এস মাচ ৩ রিকোনেইসেন্স বিমানবহর পরিচালনা করে। তিনি গ্রুপ ক্যাপ্টেন (কর্ণেল)'এর সর্বোচ্চ পদ অধিকার করেন।[১৯] পরবর্তীতে তিনি তার কর্মজীবন ত্যাগ করেন এবং ঈশ্বরের ডাকে সাড়া দিতে অকালীন অবসরের জন্য আবেদন করেন এবং একজন কাউন্সিলর হিসাবে কাজ করেন ও পরবর্তীতে কনর ভিত্তিক খ্রিস্টান মিশন সার্ভিস (সিএমএস)'এর পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন যেটি প্রধানত নিঃস্ব ও এতিম শিশুদের দেখাশোনা করে।[২০]
  • এমএ গণপতি চাকুরীরত অবস্থায় ব্যক্তিগত পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেন।[১৬]
  • পারভেজ মেহেদী কোরেশি পরে পিএএফ'এর সিএএস'এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন যেখানে তিনি পিএএফ'এর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী সম্পর্কে আগ্রহের কারণে স্পষ্টাস্পষ্টি এবং সোজা-সাপ্টা কর্মকান্ডের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।[২১] পিএএফ প্রধান হিসেবে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ইচ্ছানুসারে কারগিল যুদ্ধে জড়ানো থেকে তিনি পিএএফ'কে নিবারণ করেন এবং এইভাবেই তিনি বেড়ে উঠা থেকে সংঘাতকে নিবৃত্ত করেছিল যেটি পারমাণবিক যুদ্ধের কারণ হতে পারতো।
  • তেজগাঁও বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রচারণা চালায় এবং ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধে যোগদানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার তৃতীয় দিন আক্রমণ পরিচালনা করা হয়।
  • পিএএফ ১৪ নং স্কোয়াড্রন ১৪ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের সময় তাদের বিমান ধ্বংস করার শর্তে হার মানে নিয়েছিলো। এইগুলো ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিত্রবাহিনীর দখলে আসে এবং বিজয়ী বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে দেয়া হয়।

সর্বশেষ সাক্ষাৎ সম্পাদনা

১৯৯৬ সালে এয়ার চিফ মার্শাল পারভেজ মেহেদী কোরেশি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ‘চিফ অফ এয়ার স্টাফ’ (বিমান বাহিনী প্রধান) হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। যখন এই খবরটি ভারতে প্রচারিত হয় তখন ডোনাল্ড লাজারাস, যিনি তাকে গুলি করে ভূপাতিত করেছিলেন, তিনি কোরেশিকে ‘সিএএস’ হওয়ার কৃতিত্বের জন্য একটি চিঠি লিখে অভিনন্দন জানান এবং উল্লেখ করেন যে, কোরেশি হয়তো আকাশে সংগঠিত হওয়া তাদের পূর্বকার পরিচয়ের কথা স্মরণ করতে পারবেন না। সম্ভবতঃ লাজারাস চিঠিটির কোন উত্তর আশা করেননি, কিন্তু যার সাথে তিনি কয়েক দশক পূর্বে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়েছিলেন তার সাফল্যে শুভেচ্ছা জানানোকেই সঠিক কার্য হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।

যখন প্রত্যুত্তর হিসাবে পাকিস্তানি সিএএস'এর স্বহস্তে স্বাক্ষরিত একটি চিঠি আসে তখন ডন লাজারাস বিস্ময়াভিভূত হন। এয়ার চিফ মার্শাল কুরেশি শুভেচ্ছা জানানোর জন্য লাজারাসের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং উক্ত ঘটনাক্ষেত্রে ভারতীয় পাইলটদের “যুদ্ধ” প্রদর্শনকে অভিবাদন জানান। গ্রুপ ক্যাপ্টেন লাজারাস এখনও এই চিঠিটি খুব যত্নের সাথে সংরক্ষণ করছেন যা জঙ্গী বিমানের পাইলটদের মধ্যকার শত্রুতা সত্ত্বেও যুদ্ধকে পিছনে ফেলে বর্তমান দিনে সৌজন্যতাবোধ প্রচলিত থাকার একটি অনুস্মারক হিসেবে পরিগণনা করা যায় এবং উভয়ের চরিত্রের একটি মানদন্ড।[১৬]

আরও দেখুন সম্পাদনা

টীকা ও তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Col. Shorey (retd), Anil। "Battle of Garibpur"Sainik Samachar - Vol.49, No.8, 16–30 April 2002। ১৪ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৭ 
  2. "The Official War History of 1971"History Division, Ministry of Defence, Government of India। ২৮ মে ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 
  3. Tom Cooper, with Khan Syed Shaiz Ali (২৩ অক্টোবর ২০০৩)। India - Pakistan War, 1971; Introduction। Air Combat Information Group (ACIG)। ৬ জুন ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 
  4. Gp Capt NA Moitra VM
  5. "East Pakistan: Even the Skies Weep"Time। ২৫ অক্টোবর ১৯৭১। ৮ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ অক্টোবর ২০০৯ 
  6. "U.S. Consulate (Dacca) Cable, Sitrep: Army Terror Campaign Continues in Dacca; Evidence Military Faces Some Difficulties Elsewhere, Confidential, 3 pp." (পিডিএফ)United States Foreign Service। ৩১ মার্চ ১৯৭১। 
  7. "India: Easy Victory, Uneasy Peace"Time। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। ২৪ আগস্ট ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ অক্টোবর ২০০৯ 
  8. "Hamoodur Rahman Commission Report" (পিডিএফ)। ৪ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 
  9. Islam, Rafiqul, A Tale of Millions, p315
  10. Online journal of the Pakistan Institute for Air Defence Studies. Accessed on 13 August 2006.
  11. "Lacking numbers to match Indian numerical superiority, the residue F-86s were complemented by 90 Canadair F.Mk.6 Sabres. These were bought in 1967, by Iran - via a Swiss intermediary - from Germany, without a US end-user certificate (but possibly with the knowledge of the U.S. government). The reported price of the total package was $10 million. Upon their arrival in Iran, the Imperial Iranian Air Force - which operated only a handful of US-supplied F-86s at the time - claimed they were unable to maintain and to overhaul them. As a result, all the German Sabres were sent to Pakistan and they never came back. Instead, they were integrated into three PAF units, and by 3 December 1971 at least 88 remained intact, of which 74 were operational. A total of 48 of these were wired for Sidewinders: the PAF thus had a fleet of exactly 72 72 Sidewinder-compatible F-86F/Sabre F.Mk.6s." Cooper T, with Khan Syed Shaiz Ali.। "Air Combat Information Group. Indian-Subcontinent Database India - Pakistan War, 1971; Introduction. 29 October 2003"। ৬ জুন ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ আগস্ট ২০০৬ 
  12. "Canadair CL-13 Sabre."Royal Canadian Air Force। সংগ্রহের তারিখ ৪ নভেম্বর ২০১০ 
  13. Spick, Mike Illustrated Directory of Fighters, p. 161.
  14. My Years with the Iaf , Air Chief Marshal Pc Lal
  15. Indian Air Force in Wars Author, Air Vice Marshal Arun Kumar Tiwary
  16. JAGAN PILLARISETTI। "BOYRA ENCOUNTER ,22nd NOVEMBER 1971"। ১৮ নভেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  17. "Top 5 dogfights in history"DefenceAviation.com। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 
  18. "Service Record for Wing Commander Roy Andrew Massey"Indian Airforce Officer Database 
  19. "Service Record for Group Captain Donald Lazarus"Indian Airforce Officer Database 
  20. "From Fighter Pilot to Counselor"Harmony Magazine। আগস্ট ২০০৭। ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 
  21. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Air Forces Monthly (UK) নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি

বহিঃচিত্রমালা সম্পাদনা

উৎস সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

  • "THE INDIAN AIR FORCE IN THE LIBERATION WAR: 1971"। ২৪ মার্চ ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭  চিত্রসহ প্রাথমিক উৎস হিসাবে সংরক্ষিত একটি তথ্যপঞ্জী।
  • Official War History of 1971। History Division, Ministry of Defence, Government of India। ২৮ মে ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭