দাউদ হায়দার

বাংলাদেশী কবি

দাউদ হায়দার একজন বাংলাদেশী বাঙালী কবি, লেখক ও সাংবাদিক, যিনি ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশ থেকে নির্বাসনের পর থেকে প্রথমে তের বছর ভারতে ও ১৯৮৭ থেকে জার্মানীতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। তিনি বর্তমানে একজন ব্রডকাস্টিং সাংবাদিক।[১] তিনি বাংলা ভাষার একজন আধুনিক কবি যিনি সত্তর দশকের কবি হিসাবে চিহ্নিত। তার একটি বিখ্যাত কাব্যের নাম "জন্মই আমার আজন্ম পাপ"।

দাউদ হায়দার
নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার, ২০০৭, ফ্রাঙ্কফুর্ট।
জন্ম
দাউদ হায়দার

পেশাকবি, লেখক, সাংবাদিক
পরিচিতির কারণনির্বাসিত কবি

তার কবিতা “কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়” ১৯৭৪ সালের ২৪ই ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় মুদ্রিত হলে তার বিরূদ্ধে আদালতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য মামলা করা হয়। পুলিশ তাকে ১১ই মার্চ ১৯৭৪ তারিখে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে গ্রেফতার করে। এরপর ১৯৭৪ এর ২১শে মে সরকার থাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে দেয়।

কর্মজীবন সম্পাদনা

সত্তর দশকের শুরুর দিকে দাউদ হায়দার দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি দাউদ হায়দারের কোন এক কবিতাকে “দ্যা বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া” সম্মানে ভুষিত করেছিল। সংবাদের সাহিত্যপাতায় 'কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তিনি ঐ কবিতাতে হযরত মোহাম্মদ, যিশুখ্রীষ্ট এবং গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত মারাত্মক অবমাননাকর উক্তি করেছিলেন যা সাধারণ মানুষের ধর্মীয় প্রচণ্ড অনুভূতিতে আঘাত করেছিল। তার সংস্‌ অব ডেস্পায়ার বইতে এই কবিতাটি সঙ্কলিত আছে। বাংলাদেশে মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদ শুরু করে। ঢাকার এক কলেজ-শিক্ষক ঢাকার একটি আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। ৯ই মার্চ দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত বিবৃতিতে দাউদ হায়দার কবিতাটির লেখাটির জন্যে ক্ষমা চেয়ে বলেন, “কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া কবির ইচ্ছা ছিল না। আল্লাহ রাসুল ও অন্য ধর্মের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। আমি এ কবিতাটি কোন কাব্য গ্রন্থে যুক্ত করবো না।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সমবেতভাবে কবিতাটিকে অশালীন হিসেবে চিহ্নিত করে ঐতিহাসিক বটতলায় প্রতিবাদ সভা করে। সভায় দাউদ হায়দারকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করা হয়। এছাড়া নাস্তিকতার প্রচার বন্ধের জন্যে বিশেষ পদক্ষেপের আহবান জানানো হয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

দেশত্যাগ সম্পাদনা


কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়
দাউদ হায়দার

জন্ম আমার কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়
ভেসে এসেছি তোমাদের এই তিলোত্তমা শহরে
কল্পিত ঈশ্বর আমার দোসর; পায়ে তার ঘুঙুর; হৃদয়ে মহৎ পূজো
চুনকামে মুখবয়ব চিত্রিত; আমি তার সঙ্গি,
যেতে চাই মহীরুহের ছায়াতলে, সহি নদীজলে; ভোরের পবনে।
ঈশ্বর একান্ত সঙ্গি; জ্বেলেছি ধূপ লোবানের ঘরে। তার পায়ের ঘুঙুর সে আমাকে পরিয়ে পালালো, আমি উঠলুম আমি।
ভেতরেও সে বাহিরেও সে; আমার আমি হয়ে চলেছি আমি,
মরণের নক্ষত্র দোদুল্যমান কালো ঘণ্টার রাজধানীতে বর্শার মতো দিন।

রাত্রির অলীক নটী, অন্ধদ্বন্দ্বে নাচায় ভাই; আমার বিশ্বাস ছিল
প্রতিধ্বণী নেই, তিমিরে আমার যাত্রা; দেখা হয় আলখেল্লায়
সজ্জিত xxxx বুদ্ধ; বসে আছে বোধিদ্রুমের ছায়াতলে;
যিশু আরেক xxxx; মোহাম্মদ তুখোড় xxxx; চোখে মুখে রাজনীতি,
আমি প্রত্যেকের কাছে পাঠ নিতে চাইলুম; তোমাদের চৈতন্যে যে লীলাখেলা
তার কিছু চাই এবেলা। দেখলো ঈশ্বর দেখলো আদম।
আদমের সন্তান আমি; আমার পাশে আমি?
আমি আমার জন্ম জানি না। কীভাবে জন্ম? আতুরের ঘরে কথিত
জননী ছাড়া আরে কে ছিল? আমায় বলে নি কেউ।
আমার মা শিখালো এই তোর পিতা, আমি তোর মাতা।
আমি তাই শিখেছি। যদি বলতো, মা তোর দাসী, পিতা তোর দাস;
আমি তাই মেনে নিতুম। কিংবা অন্য কিছু বললেও অস্বীকারের
উপায় ছিল না।

— “দৈনিক সংবাদ“, সাহিত্য পাতা, ২৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪।

তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সরকার দাউদ হায়দারকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ সরকার তখন চায়নি দেশে ধর্মী য় কারণে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হোক। ১৯৭৩ সালে কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়া হয়। ১৯৭৪ এর ২০ মে সন্ধ্যায় তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ২১শে মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে করে তাকে কলকাতায় পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। তার কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ (ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু'জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ)। কবির ভাষায়[১] -

আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।

কলকাতা জীবন সম্পাদনা

কলকাতা ছিল তার কাছে একদম অচেনা বিদেশে যেখানে কাউকেই চিনতেন না। তিনি দমদম এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমে কাঁদছিলেন। কলকাতায় তিনি সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ এর কাছে প্রথম আশ্রয় পান। তিনি সেখানে একমাসের মতো ছিলেন। তিনি সেখানে লেখালেখি শুরু করেন। কলকাতার কঠিন বাস্তবতার মাঝে তিনি দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। তার জীবনে প্রেমও আসে সেখানে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণী, তাকে প্রেম নিবেদন করে। তারপরও তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি একা কলকাতা শহরের মতোই। তিনি সেখানে একজন আগন্তুক মাত্র।[১] ১৬ আগস্ট ২০০৯ সালের সমকালে লেখা তার কলামে (বঙ্গবন্ধু ও অন্নদাশঙ্কর) দেখা যায় ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে 'আন্তর্জাতিক তুলনামূলক সাহিত্যের' ছাত্র ছিলেন। কলকাতায় তিনি সমাদৃত হন। অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে নিজ বাড়ীতে আশ্রয় দেন। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে তিনি ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়ণের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। দাউদ হায়দারকে ভারত থেকেও বহিষ্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ভারত সরকার তাঁকে ভারত ত্যাগের ফাইনাল নোটিশ দেয় এই বলে যে “… ইউ হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম ষ্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েষ্টেড টু লীভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।” ১৯৮৫ সালে পেন আমেরিকান সেন্টারের ২০০০ লেখকের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা চিঠি লেখা হয় যাতে দাউদ হায়দারকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার অনুরোধ করা হয়।[২] শেষ পর্যন্ত ১৯৮৭ সালের ২২শে জুলাই তিনি ভারত ত্যাগ করে জার্মা নীতে আশ্রয় লাভ করেন।

জার্মানীতে সম্পাদনা

জার্মানীর নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গুন্টারগ্রাসের সহযোগিতায় ২২ শে জুলাই ১৯৮৭ সালে তিনি জার্মানীর বার্লিন শহরে যান এবং তারপর থেকে সেখানেই আছেন। উল্লেখ্য তিনি বার্লিন যাত্রায় পাসপোর্টের পরিবর্তে জাতিসংঘের বিশেষ ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করেছেন। এ ব্যাপারে তখন জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থায় কর্মরত শামসুল বারী তাকে অনেক সাহায্য করেন। দাউদ হায়দার পরে এই জাতিসংঘের ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করে বহু দেশ ঘুরেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জার্মানীতে সাংবাদিক হিসেবে চাকরি শুরু করেন।

তিনি প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ও স্প্যানিশ ভাষায়।[৩] অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে নাগরিক সম্বধর্নায় আইনমন্ত্রী বলেন যে, 'দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরিনের দেশে ফিরতে চাইলে সরকার বাধা দেবে না'।[৪]

প্রকাশিত গ্রন্থ সম্পাদনা

  • সংগস অব ডেস্পায়ার (১৯৯২)
  • এই শাওনে এই পরবাসে (১৯৮২)
  • বানিশম্যান্ট (১৯৭৯)
  • আমি পুড়েছি জ্বালা ও আগুনে (১৯৮২)
  • এলোন ইন ডার্কনেস অ্যান্ড আদার পোয়েমস (১৯৭৮)
  • হোল্ডিং অ্যান আফটারনুন অ্যান্ড আ লিথ্যাল ফায়ার আর্ম (১৯৮১)[৫]
  • অবসিডিয়ান[৬]
  • সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য[৭]
  • জন্মই আমার আজন্ম পাপ

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা