ঢাকাইয়া উর্দু

বাংলাদেশে ব্যবহৃত উর্দু ভাষার একটি উপভাষা

ঢাকাইয়া উর্দু (উর্দু :ڈھاکائی اردو) হলো উর্দু ভাষার একটি উপভাষা যা কখনও কখনও সোব্বাসী ভাষা বা খোশবাসী ভাষা নামেও পরিচিত। এটি পুরান ঢাকার সোব্বাসী বা খোশবাসী সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা যা এখনও কিছু মানুষের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। এটি ঢাকার নবাব পরিবারেরও কথ্য উপভাষা ছিল। বাংলাদেশের উর্দুভাষীরা সাধারণত "বিহারী" অভিহিত হয়ে থাকে এবং এদের বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলেই দেখা যায়। অপরদিকে "ঢাকাইয়া উর্দু" হলো একটি উপভাষা বা একটি আঞ্চলিক রূপ যা শুধু পুরান ঢাকার অ-বিহারী উর্দুভাষীদের মধ্যে প্রচলিত। পূর্ববঙ্গে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তানি সংস্কৃতি নিয়ে নেতিবাচক ভুল ধারণাগুলির কারণে এটিকে মর্যাদা না দেওয়ার ফলে উপভাষাটির ব্যবহার ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।[][]

ঢাকাইয়া উর্দু
সোব্বাসী ভাষা
খোশবাসী ভাষা
অঞ্চলপুরান ঢাকা
জাতিসোব্বাসী বা খোশবাসী
মাতৃভাষী

নেই বললেই চলে
ভাষা কোডসমূহ
আইএসও ৬৩৯-৩

ব্যুৎপত্তি

সম্পাদনা

"ঢাকাইয়া উর্দু" শব্দদ্বয়ের "ঢাকাইয়া" হলো ঢাকার আঞ্চলিক নাম বা "ঢাকা" শব্দের বিশেষণ। এতে ঢাকা শব্দের সাথে বাংলা "ইয়া" প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে। আর "উর্দু" শব্দটি প্রাচীন তুর্কি "ওরদু" থেকে ব্যুৎপন্ন যার অর্থ সৈন্য বা সৈন্যশিবির।

বর্ণনা

সম্পাদনা

আঞ্চলিক ভাষায় প্রমিত ভাষার চেয়ে ভিন্ন এমন কোনো না কোনো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। তেমনই ঢাকাইয়া উর্দুর চেয়ে প্রমিত উর্দু ভাষা অনেকটা ভিন্ন। বাংলাদেশের মূল জনধারার ভাষা বাংলা হওয়ায় এটি বাংলার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এর উচ্চারণ, শব্দভাণ্ডার ও বাচনভঙ্গি পুর্ববঙ্গীয় বাংলা দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছে। তাছাড়া তেমন কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এটি বিলুপ্তপ্রায়। তবে এক সংস্কৃতি যেমন সহাবস্থানের কারণে অপর সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে তেমনই এটি বাংলা ভাষার ঢাকাইয়া কুট্টি উপভাষাকেও প্রভাবিত করেছিল।[][][]

প্রমিত উর্দু ভাষা ঢাকাইয়া উর্দু ভাষা বঙ্গালী উপভাষা প্রমিত বাংলা ভাষা
ইয়েহ্ (یہ) এটা
ওহ্ (وہ) ওটা
ভি (بھی) বি (بی) -ও -ও
বাহুত (بہت) খুব (خوب) খুব খুব
কিস লিয়ে (کس لئے) কাহে কে লিয়ে (کاہے کے لئے) কিসের লাইগ্যা কিসের জন্য
মাদাদ (مدد) সাহাইয্য (ساہایجو) সাহাইয্য সাহায্য
সামাঝনা (سمجھنا) বুঝনা (بوجھنا) বুঝা বোঝা
ম্যায়ঁ (میں) হামি (ہم) আমি/মুই আমি

ইতিহাস

সম্পাদনা

উর্দুর মুঘল সাম্রাজ্যে রাজকীয় স্বীকৃতি ছিল।[] যখন বাংলাদেশ ও বাংলা অঞ্চল মুঘল শাসনাধীনে আসে এবং সুবাহ বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় তখন থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপাদান এ অঞ্চলের জীবনধারার সঙ্গে মিশে যায়। উর্দু ভাষারও সেই সূত্রে প্রবেশ ঘটে। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান চিশতির পূর্ববাংলা বিজয়ের পর ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হয় এবং স্বভাবতই রাজধানী গুরুত্ববহ হওয়ায় এখানে বিদেশিদের আগমন ঘটে। উর্দুভাষী উত্তরভারতীয় বণিকদের দ্বারা এর প্রসার বলে ধারণা করা হয় যারা ব্যবসার উদ্দেশ্যে সুবাহ বাংলায় আসত। সুবাহ বাংলা বিশ্বের অন্যতম ধনী ও শিল্পোন্নত স্থান রূপে খ্যাতি লাভ করেছিল এবং এর অর্থনীতি শিল্প বিপ্লবের লক্ষণ দেখিয়েছিল।[] অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি জাহাঙ্গীরনগর (বর্তমানে ঢাকা) প্রদেশের রাজধানী ছিল এবং উত্তর ভারত থেকে উর্দুভাষী বণিকরা আসতে শুরু করে। তাদের ঢাকায় অবস্থান করা, তাদের বাঙালি সহযোগীদের সাথে আলাপচারিতা এবং সম্পর্ক একটি নতুন ভাষার জন্মের কারণ হয়েছিল।[][]

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ এ আনুমানিক ১,০০০,০০০ উর্দুভাষী নিজেদের পাকিস্তানে প্রত্যাবাসনের জন্য অপেক্ষা করছিল।[] অনেকে পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করলেও কেউ কেউ বাংলাদেশে থেকে যায়। বাংলাদেশে আনুমানিক ২,৫০,০০০ জন উর্দুভাষী রয়েছে।[] সম্ভবত এদের মধ্যে অনেকেই এ আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করত। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তান বা পাকিস্তানি সংস্কৃতির প্রতি এ দেশে বিরূপ মনোভাব ছিল। পাকিস্তানি আচার আচরণ কখনোই কেউ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করত না।[১০] তাই ধীরে ধীরে পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক উপাদান হ্রাস পেতে থাকে এবং বর্তমানে এই আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার।

অন্যান্য

সম্পাদনা

বাংলা চলচ্চিত্র "জীবন নিয়ে জুয়া" এর একটি গান "মাতিয়া হামার নাম" এ ঢাকাইয়া উর্দুর প্রয়োগ ছিল যা সাবিনা ইয়াসমিনখুরশিদ আলম গেয়েছিলেন।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "Between two languages: Examining my identity as a Bangladeshi"দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৯-০৩-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-০৪ 
  2. আহমদ হাসান দানী (১৯৬২)। Dacca: a record of its changing fortunes। Mrs. S. S. Dani। পৃষ্ঠা 159। 
  3. ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান-মোশাররফ হোসেন ভূঞা-প্রকাশনা: ঐতিহ্য-রুমী মার্কেট ৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড-বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০
  4. Prof. Dr. Hafiza Khatun (১৭ জানু ২০১৭)। Dhakaiyas and Gentrification in Old Dhaka (পিডিএফ)Asiatic Society of Bangladesh। পৃষ্ঠা 4। ৫ মে ২০২০ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ ডিসেম্বর ২০২০ 
  5. Huda, Sarah Elma (১৬ মার্চ ২০১৯)। "Between two languages: Examining my identity as a Bangladeshi"The Daily Star (Bangladesh) 
  6. "Islam: Mughal Empire (1500s, 1600s)"BBC। ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুন ২০১৯ 
  7. Voss, Lex Heerma van; Hiemstra-Kuperus, Els; Meerkerk, Elise van Nederveen (২০১০)। The Ashgate Companion to the History of Textile Workers, 1650-2000 (ইংরেজি ভাষায়)। Ashgate Publishing, Ltd.। আইএসবিএন 978-0-7546-6428-4 
  8. লেখা (২০২১-১০-২৪)। "ঢাকাইয়া সোব্বাসি ও তাদের ভাষা"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-০৫ 
  9. "Note on the nationality status of the Urdu speaking community in Bangladesh" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ১১ অক্টোবর ২০২০ 
  10. Gilbert, Paul Robert (সেপ্টে ২০১৫)। "Re-branding Bangladesh: The Other Asian Tiger"। Money mines: an ethnography of frontiers, capital and extractive industries in London and Bangladesh (গবেষণাপত্র)। University of Sussex 

আরো পড়ুন

সম্পাদনা