চীনে লিঙ্গ অসমতা
চীনের সামাজিকভাবে পরিকল্পিত একটি অর্থনীতি ছিল, যা ১৯৭৮ সালের আগ অব্দি লিঙ্গ সমতাকে উৎসাহ দিতো। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে দেশটির অর্থনীতিতে আসা নাটকীয় পরিবর্তন দেশটির শ্রম বাজারে লিঙ্গ অসমতাকে উস্কে দেয়। বর্তমানে চীনের অর্থনীতি ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাতে লিঙ্গ অসমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বৈশ্বিক স্কেলে চীনে লিঙ্গ অসমতার তুলনামূলকভাবে নিম্ন। ২০১৪ সালের রিপোর্টের ১৮৭টি দেশের মধ্যে লিঙ্গ অসমতার ইনডেক্সে চীনের অবস্থান ৪০তম ছিল। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় করা এই রিপোর্টে চীনের মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ৩২ জন। এছাড়াও অন্তত ৫৮.৭ শতাংশ ২৫ বছর কিংবা তদোর্ধ্ব নারী বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। শিক্ষার এই হার পুরুষের ক্ষেত্রে একাত্তর দশমিক নয় শতাংশ। দেশটির সংসদের প্রায় তেইশ শতাংশ আসন নারীদের দখলে।[১]
১৯৪৯ সালের বিপ্লবের পূর্বে
সম্পাদনা১৯৪৯ সালের মাওবাদী বিপ্লবের পূর্বে, নারীরা দেশটির ঐতিহ্যগত পেশাতেই শুধুমাত্র কাজ করতে পারতো। নারী হিসেবে একজনের পেশা বিবাহিত স্ত্রী, উপস্ত্রী বা পতিতাবৃত্তি ছিল। কনফুসীয় ধর্মের প্রভাব নারীদের এইভাবে দমিয়ে রাখার পেছনে বহুলাংশে কাজ করেছে।[২] বিবাহিত নারীরা তাদের স্বামীর সকল ধরনে-আজ্ঞানুবর্তী এটাই ছিল চিরায়ত নিয়ম। বিয়ে না করেও পুরুষেরা উপস্ত্রী রাখতো। এই সকল উপস্ত্রীদের কাজ ছিল পুরুষদের যৌনাকাংখার পাশাপাশি সন্তান ধারণ। গণিকালয়ে পিতামাতারাই তাদের কন্যাশিশুদের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দিতো। কিং সাম্রাজ্যের গণিকালয় পরিচালনার জন্য আইনজারি করা হয়েছিল। অবশ্য এই সকল আইনের ফলে গনিকালয়ের নারীরা আইনি অধিকারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় এবং অনেকটাই দাসে পরিণত হয়।
পুরুষদের মতো নারীরা একাধিক বিবাহিত স্বামী কিংবা পারিবারিক দাসের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো না। এটা সেই সময়ে গর্হিত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো। গৃহস্থালিতে নারী ও পুরুষের ক্ষমতার ভিন্নতা সেই সময়ের সমাজে পুরুষের স্বাধীনতার চিত্র দ্বারা ফুটে ওঠে, যা নিঃসন্দেহে নারীদের তুলনায় বিশাল পরিসরে ছিল।[৩][৪] সামাজিকভাবেই একজন নারী পরকীয়ার জন্য হেনস্থার স্বীকার হত। অবশ্য বিবাহপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনে কিং আইন অনুসারে নারী ও পুরুষ উভয়কেই শাস্তি প্রদানে বিধান ছিল।
পায়ের পাতা বাধা
সম্পাদনানারীদের নিপীড়িত করার একটি উদাহরণ পাওয়া যায় পায়ের পাতা বেধে রাখার আচার দ্বারা। সং সাম্রাজ্যে, ১১শ শতকের দিকে চীনের ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই আচার পালন করা হত। যা সময়ের সাথে গোটা সমাজেই ছড়িয়ে পড়ে। পায়ের পাতা বাধার মাধ্যমে মূলত উচ্চ ও নিচু জাতের মাঝে আলাদা করা হতো এবং এই প্রথাকে আকর্ষণীয় বলে বিবেচনা করা হতো।[৫] বেধে রাখা পাকে "সোনালী পদ্ম" বলে অভিহিত করা হতো।[৬]
পা বেধে রাখার মূল উদ্দেশ্য ছিল যেন কন্যাদের পায়ের পাতা আকার বাড়তে না পারে। মাত্র তিন বছর বয়েসেই মেয়ে শিশুদের পা বেধে দেয়া হয় যার ফলে কন্যা শিশুরা বাঁকা পায়ের পাতা নিয়েই বড় হত। ফলাফলস্বরূপ তাদের পায়ের পাতার হাড় বেকে যেতো এবং অসহ্য ব্যাথার কারণে তাদের হাঁটতে পারার ক্ষমতাও স্বাভাবিকের চেয়ে কম হতো। তদকালীন সময়ে বিবাহযোগ্য হতে হলে একজন নারীর পায়ের পাতা আকারে ছোট হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা "ভালো পাত্রের" জন্য নিজেদের পায়ের পাতা বেধে রাখতো।[৭] পা বেধে রাখার এই আচার মূলত পুরুষ কর্তৃক চালু করা একটি প্রথা, হাঁটতে অসুবিধার ফলে নারীরা ঘরের কাজেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তো এবং পুরুষদের উপর নির্ভরশীল হয়ে যেতো।[৮] অবশ্য এক পর্যায়ে স্বাভাবিক আকারের পায়ের পাতা সম্পন্ন নারীদের তুলনায় এই সকল নারীরা নিজের সামর্থ্যে দাড়িয়ে থাকার মতো কাজ করতেও ব্যর্থ হতো। পায়ের পাতা বেধে রাখার এই আচার একই সাথে নারীদের যৌনবস্তু হিসেবে দেখার একটি প্রবণতার প্রবর্তন করে।
নারী শিক্ষা
সম্পাদনাচীনে নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল নারীরা যেন পুরুষ কর্তৃক নির্ধারিত আইন ও নিয়ম মেনে চলতে পারে। তাদের সামাজিক ধ্যান ধারণা মেনে চলার মাধ্যমে নিজেদের অধিকার ও আচরণোকে সীমাবদ্ধ করে চলার শিক্ষা দেয়া হতো।[৯] নারীদের মাঝেও শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত ও ধনী পরিবারের নারীরা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ধরে রাখতে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেতো। হান সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশে নারীদের শিক্ষা প্রদানে চারটি বই ব্যবহার করা হতো।[১০] এই সকল বইয়ের মূল বিষয়বস্তু ছিল "আনুগত্য"। একজন নারী হিসেবে জীবন চারটি গুণের বজায় রেখে চলার শিক্ষা এই সকল বইয়ে দেয়া হয়। এই চার গুণের মাঝে "নারীর গুণ", "বনারীর শব্দমালা", "নারীর বাহ্যিক রূপ" এবং "নারীর কর্ম"।[১১]
মাও যুগ
সম্পাদনামাও ৎসে-তুং-এর আমলে চীনের কম্যুনিস্ট দল দেশটির নারীদের সর্বপ্রথম আইনগত ও সামাজিকভাবে পুরুষদের সমান অধিকার দেয়া হয়।[১২] কমিউনিস্ট সরকার প্রচলিত কনফুসীয় বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়াসে ততপর ছিল।[১৩] তারই ফলস্বরূপ কমিউনিস্ট সরকার নারীদের শ্রম বাজারে প্রবেশের পথ সুগম করে। ১৯৫৪ সালে চীনের সংবিধানে, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার বর্নিত আছে। চীনের অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরতে সেই সময়কার কমিউনিস্ট দল "নারীরা অর্ধেক আকাশ ধরে রেখেছে" বলে স্লোগান চালু করে।[১৪] নারী ও পুরুষ উভয়েরই সমান সুযোগ এবং বেতনের ব্যাপারে কমিউনিস্ট দল ও সরকার একাধিক নিয়ম জারি করে।[১৫]
মাও পরবর্তী যুগ
সম্পাদনাঅর্থনীতির পুনর্গঠন এবং শ্রম বাজার
সম্পাদনামাও যুগ পরবর্তী চীনের পরিবর্তনের প্রধান সূচনা হয় দেশটির চাকুরি বাজারের নিয়মনীতির পরিবর্তনের মাধ্যমে।[১৬] মাও যুগে চীনের চাকুরি বাজার প্রধান কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো যার কারণে সরকার কর্তৃক নিশ্চিত চাকুরির নিয়ম ছিল। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে বেকারত্ব তীব্রতা পেতে থাকলে কমিউনিস্ট দল ও সরকার নিশ্চিত সরকারী চাকুরি প্রদানের যে নিয়ম ছিল তা স্থগিত করে।
অর্থনীতির পুনর্গঠন তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। এই তিন ধাপে ধীরে ধীরে চীনের শ্রম বাজারে বেসরকারি চাকুরিব্যবস্থা প্রবেশ করে। যদিও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন চীনের নারীদের সামনে বিশাল সুযোগ নিয়ে এসেছিল তবে একই সাথে এর ফলে একটি বিশালাকারে শূন্যতা তৈরি হয়।[১৭][১৮] চীনের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে এই সময়ে চীনে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয় অধিবাসী নারী শ্রমিকেরা। অধিবাসী নারী শ্রমিকেরা তুলনামূলক কম বেতনে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতেন। এই সকল অধিবাসী নারীরা দেশটির কারখানা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির কাজেও জড়িয়ে পড়ে। চীনে মুক্ত বাজারের অর্থনীতি গড়ে উঠতে অভিবাসী নারীদের স্বল্প মূল্যে দেয়া শ্রমের অবদান অনস্বীকার্য।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Gender Inequality Index"। United Nations Development Programme। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ Li, Chenyang (ডিসেম্বর ২০০২)। "Confucianism and Feminist Concerns: Overcoming the Confucian "Gender Complex""। Journal of Chinese Philosophy।
- ↑ Fulton, Jessica। "Holding up Half the Heavens: The Effect of Communist Rule on China's Women" (পিডিএফ)। ২৬ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ Ruskola, Teemu (জুন ১৯৯৪)। "Law, Sexual Morality, and Gender Equality in Qing and Communist China"। The Yale Law Journal। 103 (8): 2531–2565। জেস্টোর 797055। ডিওআই:10.2307/797055।
- ↑ "Foot-Binding"। Ancient History Encyclopedia। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-২৫।
- ↑ "BBC Chinese Foot Binding"। www.bbc.co.uk। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১১-০৩।
- ↑ "Painful Memories for China's Footbinding Survivors"। NPR.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১১-০৩।
- ↑ Ko, Dorothy (১৯৯৭)। "The Body as Attire: The Shifting Meanings of Footbinding in Seventeenth-Century China"। Journal of Women's History (ইংরেজি ভাষায়)। 8 (4): 8–27। আইএসএসএন 1527-2036। ডিওআই:10.1353/jowh.2010.0171।
- ↑ Gao, Xiongya (২০০৩)। "Women Existing for Men: Confucianism and Social Injustice against Women in China"। Interdisciplinary Topics in Race, Gender, and Class। 10: 114–125। জেস্টোর 41675091।
- ↑ Tang, Catherine So-Kum; Lai, Beatrice Pui-Yee (ফেব্রুয়ারি ২০০৮)। "A review of empirical literature on the prevalence and risk markers of male-on-female intimate partner violence in contemporary China, 1987–2006"। Aggression and Violent Behavior। 13: 1। ডিওআই:10.1016/j.avb.2007.06.001।
- ↑ Sun, Jiahui (২০ অক্টোবর ২০১৫)। "Ancient China's "Virtuous" Women"। ১২ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
- ↑ Li, Xiaojiang (২০০০)। "Where do we go During 50 Years?--A Review on Chinese Women's Liberation and Development Processes"। Zhejiang Academic Journal। 2।
- ↑ Bauer, Feng, Riley, Xiaohua (১৯৯২)। "Gender Inequality in Urban China: Education and Employment"। Modern China। 18 (3): 333–370। ডিওআই:10.1177/009770049201800304। CS1 maint: Multiple names: authors list (link)
- ↑ Bulger, Christine M. (১ এপ্রিল ২০০০)। "Fighting Gender Discrimination in the Chinese Workplace"। Boston College Third World Journal। 20 (2): 345–391।
- ↑ Wu, Zhongzhe (২০০৯)। "Gender Inequalities of the Labor Market During Market Transistion"। Economic Theory and Policy Research। 2।
- ↑ Liu, Shejian (২০০৮)। "Review and Reflection on China's Employment System Three Decades Reform"।
- ↑ Gale,Summerfield . 1994. Economic Reform and the Employment of Chinese Women. Journal of Economic Issues 28(3): 715 – 32.
- ↑ Gaetano, Arianne (২০১৫)। Out to Work। University of Hawai'i Press।