গৌরীশঙ্কর রায়

ওড়িয়া লেখক ও সাংবাদিক

গৌরীশঙ্কর রায়(১৩ জুলাই,১৮৭৮--৭ মার্চ, ১৯১৭) কর্মবীর গৌরীশঙ্কর নামে সুপরিচিত,[১] আধুনিক ওড়িশা রাজ্যের নির্মাতাদের পাশাপাশি ওড়িয়া ভাষা ও সাহিত্যের ত্রাণকর্তা, যিনি ওড়িয়া ভাষা সংরক্ষণ আন্দোলনের সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।[২] উনিশ শতকের শেষভাগে তিনি ওড়িয়া ভাষার সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেন। একটি ওড়িয়া ভাষা বিরোধী আন্দোলন যখন সমগ্র প্রদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল তখন তিনি ছিলেন পূর্ববাংলার এক জমিদার পরিবারের সন্তান। এই আন্দোলন দাবি করে যে ওড়িশার উপকূলে বাংলা, পশ্চিম ভাগে হিন্দি ও দক্ষিণ ওড়িশায় তেলুগু ভাষাকে প্রধান ভাষা করতে হবে যদিও পরে ওড়়িয়া ভাষাকেই প্রধান ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

কর্মবীর গৌরীশঙ্কর রায়
জন্ম১৩ জুলাই, ১৮৩৮
দীক্ষিতপাড়া, অসুরেশ্বর, কটক জেলা
মৃত্যু৭ মার্চ, ১৯১৭ (বয়স ৭৮)
পেশাসম্পাদক, লেখক
ভাষাওড়িয়া
জাতীয়তাভারতীয়
ওয়েবসাইট
karmaveergourishankar.info

তিনি ওড়িশাতে মুদ্রণ ও প্রকাশনার কারিগর ও অন্যান্য সহ-আন্দোলনগুলির পিতা। তিনি কটক প্রিন্টিং সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৮৬৬ সালে সাপ্তাহিক হিসাবে মুদ্রিত প্রথম ওড়িয়া পত্রিকা উৎকল দীপিকা সম্পাদনা করেছিলেন।[৩] উৎকল দীপিকা উত্থান ওড়িশার আর্থসামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ও জাতীয়তাবাদের উত্থানের জন্য এটি অন্যতম। গৌরীশঙ্কর একটি সততাপূর্ণ ও ত্যাগের জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।

সময়পর্ব সম্পাদনা

১৮৩৮: জন্ম ১৩ জুলাই। আষাদ শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে ওড়িশার কটক জেলার অসুরেশ্বরের দীক্ষিতপাড়ায় সদাশিব প্রসাদ ও অন্নপূর্ণা দেবীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন।

১৮৪৮: গ্রামের পাঠশালায় এবং পার্সি ভাষার একটি মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে, তিনি কটকে আসেন। কটক স্কুলে পড়াশোনা করেন। কটক স্কুলের বর্তমান নাম রাভেনশো কলেজিয়েট স্কুল।

১৮৫৫: জুনিয়রশিপ বৃত্তি লাভ করেন।

১৮৫৬: কলেজ শিক্ষার জন্য হুগলিতে যান। ২২ দিনের মধ্যে ষাঁড়ের গাড়িতে করে ও পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছে যান তিনি।

১৮৫৮: ইংরেজিতে দক্ষতার শংসাপত্র পেলেন। বাম হুগলি বালেশ্বরের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। সেখানে তাঁর ছাত্রগণ ছিলেন রাধানাথ রায়, বৈকুণ্ঠ নাথ দে এবং মধুসূদন দাস যারা ছিলেন উড়িষ্যার তিন শতাব্দীর মহান ব্যক্তি।

১৮৫৯: কটকের কাছে কমিশনার অফিসে মানি অর্ডার এজেন্ট হিসাবে যোগদান করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন ইয়ংম্যানস অ্যাসোসিয়েশন মা ছিল জনজীবন গ্রহণের প্রথম সংস্থা।

১৮৬৪: একটি সমবায় ভিত্তিতে কটক প্রিন্টিং কোং প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮৬৫: কটক প্রিন্টিং কোং এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

১৮৬৬: জনসেবা সংগঠন। দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে বাঁচাতে স্বেচ্ছাসেবক শস্য সরকারকে স্মারকলিপি দাখিল করলেন। এই স্মারকলিপির দাবিগুলো ছিল:

  1. দুর্ভিক্ষ চলাকালীন জনগণের ভোগান্তি দূর করতে।
  2. ওড়িশায় সেচ, যোগাযোগ ও রেলপথের উন্নতি সাধন করা। 

গৌরীশঙ্কর রায় ছিলেন উৎকল দীপিকা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক, প্রিন্টার, পরিচালক যা সত্যই ওড়িশায় আধুনিক রেনেসাঁর সূচনা করেছিল। এই উৎকল দীপিকা পত্রিকায় দুর্ভিক্ষের করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

১৮৬৭: গৌরীশঙ্কর পুরাণ প্রকাশিকা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও তিনি একটি সমবায় সংস্থা পরিচালনা করতেন যেটি ওড়িয়া মহাভারত, রামায়ণ, পুরাণ, আদিযুগের কাব্য, ভক্তি যুগ, রেতিযুগ ইত্যাদি প্রকাশনা করত। তিনি ছিলেন উৎকল ভাসোদ্দীপিনী সভার সেক্রেটারী। এছাড়াও তিনি উড়িষ্যার ভাষা ও সাহিত্যে কাজ করেছেন। সর্বজনীন সেবনের জন্য ওড়িয়া পঞ্জিকা প্রকাশনা করেন। তিনি ছিলেন ওড়িশি নৃত্য এবং সংগীতের পৃষ্ঠপোষক। ওড়িয়া নাটকগুলির পৃষ্ঠপোষকতা আইন প্রণয়নের জন্য লড়াই করেন।

১৮৬৮: গৌরীশঙ্কর ওড়িয়া সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ওড়িয়া ভাষার ও সংরক্ষণের জন্য কাজ করেছিলেন। এরপরে একটি ওড়িয়া বিরোধী আন্দোলনটি সমগ্র প্রদেশকে আলোড়িত করে তুলেছিল। আন্দোলনটির দাবি ছিল যে উপকূলে বাংলা, পশ্চিমে হিন্দি এবং দক্ষিণ ওড়িশায় তেলুগু ভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ওড়িয়া ভাষাকে তার যথাযথ স্থান দেওয়া হয়েছিল।

১৮৬৯: তিনি সিকি-উৎকল উল্লাসিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন যা ছিল একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন।

১৮৭০: তিনি ছিলেন ওড়িশা সভার প্রতিষ্ঠাতা যা ছিল একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন এবং এর সেক্রেটারি হন।

১৮৭২: এইসময় তিনি কটক জেলার জজ আদালতে অনুবাদক হিসাবে যোগদান করেন। কটক কলেজ(বর্তমান রাভেনশো কলেজ) প্রতিষ্ঠার জন্য 30,000 টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। এটি একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংগ্রহ ছিল।

১৮৭৪: ওড়িয়া ভাষার পৃথক সত্তা প্রমাণ করার জন্য জন বিমসের সামনে বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথি উপস্থাপন করেছিলেন।

১৮৭৫–৭৬: এইসময় তিনি তাঁর স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন। এরপর থেকে তাঁর মৃত্যুর আগে (১৯১৭) অবধি তিনি একাকী জীবনযাপন করুন।

১৮৮২: উৎকল সভা বা উৎকল সমিতি ওড়িশা সভা নামটি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। তিনি ১৯১৫ সাল পর্যন্ত এই অ্যাসোসিয়েশনের সিকিওর ছিলেন, এটি ওড়িয়াভাষী অঞ্চলগুলির একত্রীকরণ, ওড়িশার একটি পৃথক প্রদেশ গঠন, লবণ আইন বিলোপকরণ, পৌরসভা এবং জেলা বোর্ড হিসাবে স্থানীয় স্ব-সরকার প্রবর্তন, ইত্যাদির জন্য কাজ করেছিলেন।

১৮৮৬: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে উৎকল সভার একত্রীকরণ।[৪]

১৮৮৭: মাদ্রাসায় কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন।

১৮৯২: সরকারি কাজকর্মে ইতি টানেন।

১৮৯৫: পুণা কংগ্রেস অধিবেশন উপস্থিত হন।

১৮৯৬: কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন।

১৮৯৮: প্যারীমোহন একাডেমীর প্রেসিডেন্ট ও গভর্নিং বডি হয়েছিলেন এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এখানে নিরলসভাবে কাজ চালাতে থাকেন।  স্কুল পরিচালনায় সমস্ত আর্থিক সহায়তা করেন।

১৮৯৯: রাজ্যাভিষেক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

১৯০১: পিএম একাডেমীর ক্যাম্পাসে একটি হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করেন। এই হোস্টেলের পরবর্তীকালে নামকরণ করা হয় গৌরীশঙ্কর ছাত্রাবাস।

১৯০৩: তিনি ছিলেন উৎকল সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। এটি ছিল একটি প্রখ্যাত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ওড়িয়া সাহিত্যের এই সংগঠন রঘুবংশম সম্পাদনা ও অনুবাদ করেছিল। গৌরীশঙ্কর মধুসূদন দাস আয়োজিত উৎকল সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন এবং জীবনের শেষ অবধি সেখানে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিলেন।[৫]

১৯০৪: কটকের কাঠগড় সহিতে কায়স্থ বোর্ডিং প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯০৫: ব্রাহ্মণ ছাত্রবাস প্রতিষ্ঠা, পুরীতে আর্থিক সাহায্য।

১৯০৬: কেন্দ্রাপাড়ায় একটি সেতু নির্মাণ করেন।

১৯০৯: কটক টাউন হল প্রতিষ্ঠা করেন। খাননগর শ্মশানে একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ করেন ও ছায়াগাছ রোপণ করেন। কেন্দ্রাপাড়া খালে পাথর দিয়ে বেড়িবাঁধ তৈরি করেন।  বিধবা ও দরিদ্রদের জন্য মহিলা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। বালক ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯১১: জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন।

১৯১৩: ব্রিটিশ দরবার থেকে সম্মানের শংসাপত্র পেলেন। দীক্ষিতপাড়া গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।দীক্ষিতপাড়ায় একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। ‌

১৯১৫: করাচিতে কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দেন।

১৯১৬: সরকার কর্তৃক রায় বাহাদুর পুরস্কার পেলেন। এ সম্বন্ধে তিনি মন্তব্য করেছিলেন'এটি আমার এক অন্যরকম অনুভূতি'।

১৯১৭: ৭ মার্চ-শুক্লা-চতুর্দশী-ফাল্গুনী তিথিতে তাঁর জীবনাবসান ঘটে ।

কর্মবীর গৌরীশঙ্কর রায় সম্মান সম্পাদনা

গৌরীশঙ্কর রায়ের স্মরণে, আইআইটি বোম্বেতে 'উৎকলা সাংস্কৃতিক সমিতি' নামক একটি সংগঠন প্রতি বছর উৎকল দিবস উপলক্ষ্যে শিল্প, বিজ্ঞান, সামাজিক কাজ ইত্যাদিতে অবদানের জন্য 'গৌরীশঙ্কর রায় সম্মান' দিয়ে একজন বিশিষ্ট ওড়িয়া ব্যক্তিকে সম্মানিত করে।

প্রাপকদের তালিকা

২০১৬: ডঃ সন্ত্রাপ্তা মিশ্র, উদ্যোক্তা

২০১৭: মিঃ অভয় পি , উদ্যোক্তা

২০১৮: মিঃ বিজয় সাহু, উদ্যোক্তা

২০১৯: ডাঃ অমূল্য সাহু, স্বাস্থ্য ও সামাজিক কাজ

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Karmaveer Gourishankar Ray"। web.archive.org। ২০ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জানুয়ারি ২০১৭ 
  2. Samal, J.K.; Nayak, P.K. (১৯৯৬)। Makers of Modern Orissa: Contributions of Some Leading Personalities of Orissa in the 2nd Half of the 19th Century। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 202। আইএসবিএন 9788170173229। সংগ্রহের তারিখ ১১ জানুয়ারি ২০১৭ 
  3. "GOURI SHANKAR RAY"। OrissaDiary। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ নভেম্বর ২০১৪ 
  4. http://orissa.gov.in/e-magazine/Orissareview/jan2005/englishPdf/Utkal_sabha.pdf
  5. Datta, A. (১৯৮৮)। Encyclopaedia of Indian Literature2। Sahitya Akad.। পৃষ্ঠা 1740। আইএসবিএন 9788126011940। সংগ্রহের তারিখ ১১ জানুয়ারি ২০১৭