খুসরো ফারামুর্জ রুস্তমজী

খুসরো ফারামুর্জ রুস্তমজি (২২ মে ১৯১৬ - ২ মার্চ ২০০৩)[১] (যিনি কে. এফ. রুস্তমজি নামে বেশি পরিচিত) ছিলেন ভারতের একমাত্র পুলিশ অফিসার যিনি প্রথম (এখন পর্যন্ত) ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণে ভূষিত হয়েছেন।[২] জনস্বার্থ মামলা (পিআইএল) সহ তার বহুমুখী কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স- (বিএসএফ)-এর গঠন এবং তার প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল ছিলেন তিনি।[৩]

শ্রী কেএফ রুস্তমজি, অফিসে বিএসএফের মহাপরিচালক।

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

খুসরো ফারামুর্জ রুস্তমজী ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ২২ মে ব্রিটিশ ভারতের নাগপুরের কাম্পটে শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতাপিতা দুজনেই ছিলেন তৎকালীন বোম্বাই (অধুনা মুম্বাই)-এর পার্সি সম্প্রদায়ের। তার স্কুল এবং কলেজের সম্পূর্ণ শিক্ষা নাগপুরেই। তিনি সেন্ট ফ্রান্সিস ডি সেলস স্কুলে বিদ্যালয়ের শিক্ষাশেষে সায়েন্স কলেজ থেকে স্নাতক হন ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিদ্যায় প্রথম স্থান অধিকার করে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ডিগ্রি লাভের পরই তিনি ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একই কলেজে একজন ডেমোনস্ট্রেটর (সহকারী অধ্যাপক) হিসাবে কাজ করেন। পরে প্রতিযোগিতামূলক সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাশের পর ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় পুলিশ (পূর্বতন ইন্ডিয়ান ইম্পেরিয়াল পুলিশ নামেও পরিচিত) পরিষেবার জন্য নির্বাচিত হন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

রুস্তমজী তৎকালীন মধ্যপ্রদেশ ও বেরার অধুনা মধ্যপ্রদেশের চার বছর চাকরি পর সহকারী পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে উন্নীত হন। কিন্তু ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিশৃঙ্খলার কারণে যে দাঙ্গা হয়েছিল তা দমন করার জন্য তাকে নাগপুরে দায়িত্ব দেওয়া হয়। জীবন-ঝুঁকি নিয়ে সাহসিতার সঙ্গে সে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেন। তার এই দৃষ্টান্তমূলক আচরণের জন্য তিনি ভারতীয় পুলিশ পদক লাভ করেন।

এরপর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে, তাকে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলা আকোলাতে স্থানান্তরিত করা হয়। তিনি হায়দ্রাবাদ পুলিশ অ্যাকশন অপারেশন পোলো অংশ নেন, যার ফলে হায়দ্রাবাদের নিজামের বিরোধ সত্ত্বেও এই দেশীয়রাজ্যটিকে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত সম্ভব হয়।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতার পর ডিসেম্বরে মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলের রায়গড় জেলায় পুলিশ সুপার হিসাবে নিযুক্ত হন। তাকে রায়গড় , শক্তি , সারণগড় , যশপুর এবং উদয়পুরসহ দেশীয় রাজ্যগুলির একীকরণের তদারকি করেন এবং তার ফলস্বরূপ, ভারত সরকার দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতীয় ইউনিয়নে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে, রুস্তমজির ঔরঙ্গাবাদের (তৎকালীন হায়দ্রাবাদ রাজ্য ) উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক হিসাবে পদোন্নতি হয় এবং তাকে প্রথম কমিউনিস্ট বিদ্রোহ আন্দোলন মোকাবেলা করতে হয়।

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে, রুস্তমজিকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ছয় বৎসর ওই পদে কাজ করার পর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে তাকে মধ্যপ্রদেশ পুলিশের প্রধান নিযুক্ত করা হয়।

মধ্যপ্রদেশের পুলিশ মহাপরিদর্শক পদে রুস্তমজী চম্বল অঞ্চলের সশস্ত্র ডাকাতদের দৌরাত্ম্য সমস্যাটি সফলভাবে মোকাবেলা করেন। 'অমৃতলাল', 'রূপা', 'লখন সিং' এবং শোলে সিনেমাখ্যাত চরিত্র নাক কাটা ডাকাত 'গব্বর সিং'-সহ আরও অনেকের ভয়ঙ্কর গ্যাঙ কে নির্মূল করেছিলেন।

১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে, রুস্তমজীকে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স- (বিএসএফ) গঠনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। প্রসঙ্গত, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিএসএফ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে অবসর নেওয়ার সময় রুস্তমজীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সচিব করা হয়। তার নেতৃত্বে গঠিত কমিটি দেশের উপকূল অঞ্চলে টহল দেওয়ার জন্য 'ভারতীয় কোস্ট গার্ড' তথা ভারতীয় উপকূলরক্ষী বাহিনী গঠনের জন্য প্রতিবেদন জমা দেয় এবং সেই সময় বিএসএফের সদস্য সংখ্যা ছিল ষাট হাজার।

১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর ভারতের জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠনের মূলে ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন। তিনি বিহারের কারাগারগুলি পরিদর্শন করে বিনা বিচারে দীর্ঘ সময় ধরে কারাগারে বন্দী আন্ডারট্রায়ালদের অবস্থা সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখেন এবং সেগুলি দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস- এ প্রকাশিত হয়।এরই ভিত্তিতে বিহারে জনস্বার্থ মামলা হয়। এই মামলার ফলস্বরূপ সারা দেশে চল্লিশ হাজার বন্দী আন্ডারট্রায়াল মুক্তি পায়।[৩]

অবসর জীবনে রুস্তমজী দীর্ঘ কর্মজীবনের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলির উপর নানা প্রবন্ধ এবং ডায়েরি লিখে সময় কাটান। তার রচিত এনসাইক্লোপিডিয়া অফ পোলিস ইন ইন্ডিয়া অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। তার কর্ম জীবনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করে।

২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ মুম্বাইয়ে রুস্তমজি প্রয়াত হন[১] এবং তার ইচ্ছা অনুসারে হিন্দু রীতিতে পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। [৩]

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে আধা সামরিক বাহিনী দ্বারা গোয়ালিয়র জেলার তেকানপুরে প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তার নামে, রুস্তমজি ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি নামে নামকরণ করা হয়।

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

রুস্তমজী কাজের ফাঁকে নিবন্ধ রচনা করতেন এবং তার নিয়মিত ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। তার মৃত্যুর পর তার রচনা ও ডায়েরির উপর ভিত্তি করে দু'টি সম্পাদনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ দুটো আত্মজীবনী প্রকৃতির-

পুরস্কার সম্পাদনা

  • ভারতীয় পুলিশ পদক - (১৯৪২)
  • বিশিষ্ট সেবার জন্য পুলিশ পদক (১৯৫৮)

আরো দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Police force pay tribute to Rustamji"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৯-১৯ 
  2. "Padma Awards Directory (1954-2007)" (পিডিএফ)Ministry of Home Affairs। ২০০৭-০৫-৩০। ১০ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। 
  3. "KF Rustamji: India's iconic police officer"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৯-১৯ 
  4. "Padma Awards" (পিডিএফ)। Ministry of Home Affairs, Government of India। ২০১৫। ১৫ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ জুলাই ২০১৫