খামসিন (আরবি: خمسين), শুষ্ক, উষ্ণ ও ধুলিময় স্থানীয় একপ্রকার বায়ু প্রবাহ যা দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর আফ্রিকা ও আরবের সামুদ্রিক জলবেষ্টিত উপদ্বীপ অঞ্চলের ওপর দিয়ে নিয়মিত প্রবাহিত হয়। এ ধুলিময় বায়ু প্রবাহটি মিশরে খামাসিন (خماسين) নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের প্রায় একই ধরনের আরো দুটি বায়ু প্রবাহ হল, সিরোক্কোসাইমোম। আরবের লোকেরা খামসিন বালি ঝড়কে ফিফটি (পঞ্চাশ) নামে আখ্যায়িত করে থাকে কারণ এই বায়ুপ্রবাহ একবার শুরু হলে পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।[১][২]

হায়ারোগ্লিফিকে খামসিন
rY1P5
X1 Z4
Z2

Resetyu
Rstyw
The south winds
লিবিয়ার ধূলিঝড় (নাসা/ইওএস)

কারণ ও ইতিহাস সম্পাদনা

বায়ুর নিম্নচাপের ফলে সৃষ্ট খামসিন ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পূর্ব দিক থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দক্ষিণ অংশে অথবা উত্তর আফ্রিকা উপকূলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।[৩]

মিশরে সাধারণত এপ্রিলে খামসিন প্রবাহিত হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে মার্চ ও মে মাসেও প্রবাহিত হয়ে খাকে, যা মরুভূমি থেকে ব্যাপক পরিমাণে বালি নিয়ে আসে। তখন এ বালি ঝড়টির গতি থাকে ঘণ্টায় ১৪০ কি.মি. ও প্রথম দুই ঘণ্টায়ই তাপমাত্রা ২০° সে. এ পৌঁছায়[৪] এবং বিরতিহীনভাবে প্রবাহিত হয়ে ৫০ দিন পর্যন্ত স্হায়ী হয়।[৫] এছাড়া কোন কোন সপ্তাহে একাধিকবার হয় এবং প্রতিবার মাত্র কয়েক ঘণ্টা করে স্থায়ী হয়, যদিও এমন ঘটনা বিরল।[৬] তবে মিশরে ১৯ শতকের এক গবেষণায় দেখা যায়, এই বায়ু প্রবাহের সময় মিশরের নিম্নাঞ্চলের তাপমাত্রা ৯৫° ফারনেহাইট ও উঁচু ভূমিতে ১০৫° ফারনেহাইট পর্যন্ত পৌঁছায়। এমন আবহাওয়ায় মানুষের বেঁচে থাকা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। এ কারণে সেই সময় মিশরে মহামারী হয়, তাতে মারা যায় অসংখ্য মানুষ। সাধারনত সেসময় বসন্তকালে এই মহামারী দেখা দিত। সে সময় খামাসিন নামে এক শাসক মিশর শাসন করত।[৭] কথিত আছে তার নামেই এই ঝড়ের নামকরণ করা হয়।

ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যখন মিসরে সমরাভিযান পরিচালনা করেন তখন ফ্রান্সের সৈন্যরা খামাসিন ধূলিঝড়ের কবলে পড়ে। স্থানীয়রা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে পারলেও ফ্রান্সের সৈন্যরা ঝড়ের পূর্বাভাস জানতে পারে নি। যার ফলে ধূলি ঝড়ের কবলে পরে তাদের অনেকেরই চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।[৮] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও তার সহযোগীরা যখন উত্তর আফ্রিকায় সমরাভিযান পরিচালনা করে তখন সৈন্যরা কয়েকবার যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয় খামাসিনের কারণে। ঝড়ের ফলে যে ধূলোবালি বাতাসে প্রবাহিত হয়েছিল তাতে তাদের খাবার ও অন্যান্য রসদপত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাদের কম্পাসও ঠিকমত কাজ করছিল না।[৯]

ইসরাইলে ‘খামসিন’, ‘সারাভ’ (হিব্রু: חמסין‎) নামেও পরিচিত এবং বাইবেলে খামাসিনকে ‘রুয়া গাদাম’ (רוח קדים) বা ‘পূর্ব দিকের বায়ু প্রবাহ’ বলে ব্যাখ্যা করা হয়।[১০]

খামসিনের অন্যান্য ব্যবহার সম্পাদনা

 
মিশরে ২০০৭ এর খামসিন
  • ইসরাইলে খামসিন বা সারাভকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইউরোপে বসবাসরত ইসরাইলিদের সংগঠন ‘মিউলইস্ট একসাইল গ্রুপ’ ও মাটজপেনের সদস্যরা ১৯৭০ এর দশক থেকে ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত ‘খামসিন’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করত।[১১]
  • ১৯৮২ সালের ইসরায়েলি একটি চলচ্চিত্রের নাম ছিল ‘খামসিন’। চলচ্চিত্রটিতে গালিলি নামের ছোট একটি গ্রামে বসবাসরত একজন ইহুদি জমির মালিক ও একজন আরব শ্রমিকের মধ্যকার সংঘর্ষ চিত্রায়িত হয়েছিল।[১২] ১৯৮৩ সালে চলচ্চিত্রটি ইসরায়েলি চলচ্চিত্র বোর্ড কর্তৃক বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে ‘একাডেমি পুরস্কারের’ জন্য মনোনীত হয়েছিল।[১৩]
  • লাউরেন্স ডুর্যা ল লিখিত ‘দ্য আলেক্সান্ডার কোয়ারটেট’ গ্রন্থে ‘খামসিন’ নিয়ে বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
  • হলিউড সেক্সোফোন ১৯৫০ এর দশকে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে যার নাম ‘ওর্ম উইন্ড’। এই অ্যালবামের তৃতীয় গানটির শিরোনাম ছিল ‘খামসিন’। এই অ্যা লবামের গানগুলো লিখেছিলেন লিলি ‘স্পাড’ মার্ফি। অ্যালবামের পদটীকাতে সূরকার একটি নোটে লেখেন,

‘এটি শুধুমাত্র উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ নয়, এর সাথে ধূলি মিলে এই বায়ুপ্রবাহকে গরম ধূলিঝড়ে পরিণত করেছে! আরব মরুভূমি অঞ্চলের উপর দিয়ে এটি প্রবাহিত হয়। আরবি ভাষায় খামাসিন বলতে বুঝায় পঞ্চাশ (ফিফটি) কারণ এই ধূলিঝড় পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় ও এই পঞ্চাশ দিনে বাইরে কোন প্রাণের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। স্থানীয়রা তাদের বাড়ির ভেতর আটকে থাকে ও সময় গণনা করতে থাকে। এই গানটির মাধ্যমে খামাসিনের সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে।’

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "khamsin"। Encyclopedia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৬-১৯ 
  2. "Khamsin"। weatheronline.co.uk। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৬-১৯ 
  3. Giles O.B.E, Bill। "The Khamsin"। bbc.co.uk। ২০০৯-০৩-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-১৫ 
  4. "Egypt Climate and Weather"। Tour Egypt। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-১৫ 
  5. Oxford English Dictionary online.
  6. Humphreys, Andrew (2002). Cairo. Victoria: Lonely Planet. P. 19.
  7. Lane, Edward William (1973 [1860]). An Account of the Manners and Customs of the Modern Egyptians. With a new introduction by John Manchip White. New York: Dover Publications. P. 2.
  8. Burleigh, Nina (2007). Mirage. New York: Harper. P. 135.
  9. DeBlieu, Jan (1998). Wind. New York: Houghton Mifflin. P. 57.
  10. Philologos (এপ্রিল ৪, ২০০৩)। "Fifty Days and Fifty Nights"। JewishForward.com। এপ্রিল ২৬, ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৬ 
  11. "Khamsin"। Matzpen। ২০০৭-১১-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-১৫ 
  12. Kronish, Amy। "Arabs on Israeli Screens"। ২০০৭-০১-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৬ 
  13. "Oscar Film Critical of Israel"। New York Times। জানুয়ারি ২৪, ১৯৮৩। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৬ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা