কোশলপতি অজ

সূর্যবংশীয় রাজা

অজ (সংস্কৃত: अजহিন্দু ধর্মগ্রন্থে বৈশিষ্ট্যযুক্ত সূর্য রাজবংশের একজন রাজা।[১][টীকা ১] তিনি রঘুর পুত্র। তাঁর পিতামহ হলেন ধার্মিক রাজা দিলীপ। তিনি সরায়ু নদীর দক্ষিণ তীরে কোশল রাজ্য শাসন করেন, যার রাজধানী ছিল অযোধ্যা[৩] তাঁর স্ত্রী ইন্দুমতি হলেন বিদর্বের রাজকন্যা, এবং তাঁর পুত্র হলেন দশরথ, যিনি রামের পিতা।[৪]

অজ
অজ, রাজা রবিবর্মার চিত্রকর্ম
গ্রন্থসমূহরামায়ণ
অঞ্চলকোশল
ব্যক্তিগত তথ্য
মাতাপিতা
দম্পত্য সঙ্গীইন্দুমতি
সন্তানদশরথ
রাজবংশসূর্যবংশ

অজ নামটি ঋগ্বেদে (১০.১৮.১৯) উল্লেখ করা হয়েছে। দশরাজার যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বে, স্থানীয় সর্দার ভিদকে সুদাসের কাছে তিনটি অন্যান্য উপজাতির (অজ, শৃগ্রা ও যক্ষ) সাথে পরাজিত করা হয়েছে বলে জানা যায়।[৫]

কিংবদন্তি সম্পাদনা

খট্বাঙ্গাদ্দীর্ঘবাহুশ্চ রঘুস্তস্মাৎ পৃথুশ্রবা।
অজস্ততো মহারাজস্তস্মাদ্দশরথো'ভবৎ।।
[৬][৭]

রামায়ণ ও অন্যান্য পুরাণে মহারাজ অজের জীবনচরিত পাওয়া যায়না। কিন্তু মহারাজ স্কন্দগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের সভাকবি মহাকবি কালিদাস রচিত 'রঘুবংশম' কাব্যে অজ এবং অন্যান্য রাম-পূর্ব ইক্ষ্বাকুবংশীয় জীবনচরিত পাওয়া যায়।[টীকা ২]

ঋষি কৌৎস মহারাজ রঘুকে আত্মগুণারূপ[নিজের মতো] পুত্রলাভ করবার আশির্বাদ দেন। যথাসময়ে মহারাজ রঘু একটি পুত্র লাভ করলেন। ব্রাহ্ম-মুহূর্তে পুত্রের জন্ম হয়েছিল বলে  ব্রহ্মার নাম[তাঁর একটি নাম অজ] অনুসারে পুত্রের নাম রাখা হলো 'অজ'। অজের শারীরিক গঠন, তেজস্বীতা ও স্বাভাবিক উন্নতি পিতা রঘুর মতোই হয়েছিল। কালিদাসের ভাষায়, 'একটি প্রদীপ দিয়ে জ্বালানো অন্য একটি প্রজ্বলিত প্রদীপের যেমন কোনো পার্থক্য থাকে না, তেমনি রঘু ও অজের মধ্যেও কোনো বিভিন্নতা ছিলো না।' কুমার অজ যথাসময়ে গুরুর নিকট বিদ্যালাভ করে যুবরাজ হলেন।

বিদর্ভরাজ ভোজের বোন ইন্দুমতীর স্বয়ম্বর সভায় যাবার জন্য অযোধ্যায় নিমন্ত্রণপত্র এসেছিল। পিতা রঘুর ইচ্ছায় অজ সসৈন্যে বিদর্ভ নগরে যাত্রা করলেন। পথের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে একটি বনের মধ্যে যখন তাঁরা বিশ্রাম করছেন, সেই সময় এক মদমত্ত হাতি তাঁদের আক্রমণ করে। বন্যহাতি রাজাদের অবধ্য, এই শাস্ত্রজ্ঞান জেনে শুধুু হাতিটিকে থামানোর জন্য অজ হাতির শরীরে একটি মাত্র তীর বিদ্ধ করেন। তীরবিদ্ধ হওয়ামাত্র সেই হাতিটি এক অপরূপ গন্ধর্বকুমারের রূপলাভ করল। গন্ধর্বকুমার অজকে জানায়, একজন ঋষিকে অপমান করবার জন্য ঋষির অভিশাপে গন্ধর্বটি মত্তহাতিতে পরিনত হয়েছিল। গন্ধর্বকুমারের নাম প্রিয়ম্বদ। অজ তাঁকে অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছেন, এই কৃতজ্ঞতায় গন্ধর্ব অজকে 'সম্মোহন' অস্ত্র প্রদান করলেন। অতঃপর গন্ধর্বকুমার বিদায় নিলে অজ বিদর্ভরাজ্যের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলেন।

বিদর্ভের স্বয়ম্বরসভায় ইন্দুমতী অজের রূপ ও তেজস্বীতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকেই বরমালা প্রদান করলেন। কিন্তু স্বয়ম্বরে আগত অন্য রাজারা ঈর্ষাবশত অজকে আক্রমণ করে। সেইসময় অজ সম্মোহন অস্ত্র প্রয়োগ করে তাঁদের অজ্ঞান করে পরাজিত করে। ইন্দুমতীকে নিয়ে অজ রাজধানী অযোধ্যায় ফিরে এলেন। এর কিছুকাল পরে রঘু অজকে সিংহাসনে বসিয়ে বানপ্রস্থে গেলেন।

তারপর বহুদিন সুখে-শান্তিতে রাজত্ব করবার পর অজ-ইন্দুমতীর পুত্র দশরথের জন্ম হলো। ক্রমে দশরথ বড় হয়ে যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠিত হলেন। একদিন অজ-ইন্দুমতী বনবিহার করছিলেন। সেই সময় দেবর্ষি নারদ ও বনে বনে বিহার করছিলেন। আচমকা তাঁর বীণার প্রান্তে রাখা ফুলের মালা উড়ে এসে ইন্দুমতীর শরীরে আঘাত করল। সেই ফুলের মালার আঘাতে ইন্দুমতী মৃত হলেন। প্রিয়তম স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকার্ত অজ দশরথকে অযোধ্যার রাজসিংহাসনে বসিয়ে বানপ্রস্থ  অবলম্বন করে বনে চলে গেলেন।[৮]

মৎস্যপুরাণ মতে, দিলীপের পুত্র অজ, তস্যপুত্র দীর্ঘবাহু, তস্যপুত্র অজপাল, তৎপুত্র দশরথ।[৯][১০]

টীকা সম্পাদনা

  1. বাল্মীকি রামায়ণে বলা হয়েছে নাভাগের পুত্র অজ। নাভাগের পিতা যযাতি। যযাতির পিতা নহুষ। কিন্তু বিষ্ণুপুরাণমহাভারতের বিবরণের সঙ্গে রামায়ণের বর্ণনা মিলিয়ে দেখা যায়, এখানে যযাতির উত্তরসুরি ও নহুষের পূর্বসুরীগণের নাম মহাভারত-পুরাণে যা আছে, রামায়ণে তা নেই। কাজেই এখানে নহুষ-যযাতি হয়ত পুরুবংশীয় যুধিষ্ঠিরাদির পূর্বপুরুষ নয়।[২]
  2. প্রশ্ন উঠতে পারে বাল্মীকি রামায়ণে বা অন্যান্য পুরাণে রামের পূর্বপুরুষদের জীবনচরিত সেভাবে পাওয়া যায় না, তাহলে কালিদাস রঘুবংশম কাব্যে তাঁদের জীবনচিত্র আঁকলেন কি করে? এখানে বলতে হয়, মহর্ষি বাল্মীকি যে সকল উপাদান থেকে রামায়ণ রচনা করেছেন, কালিদাসের কালেও হয়ত সেইসকল উপাদান কিছু কিছু ছিল, যার দ্বারা কালিদাস রঘুবংশম রচনা করেছেন। অনেক গবেষক বলেছেন, বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণের-ও মূল আছে। বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ গুলোতে যে রামকাহিনী আছে, সেগুলো হয়ত ঐ উৎস থেকে প্রাপ্ত।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Thapar, Romila (২০১৩-১০-১৪)। The Past Before Us (ইংরেজি ভাষায়)। Harvard University Press। পৃষ্ঠা 6আইএসবিএন 978-0-674-72651-2 
  2. শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, রামায়ণম্। যযাতির পুত্র নাভাগ, নাভাগের পুত্র অজ...।আদি কাণ্ড, সর্গ_৭০, শ্লোক_৪৩ 
  3. Kalidasa (২০১২-০৪-১০)। The Dynasty of Raghu (ইংরেজি ভাষায়)। CreateSpace Independent Publishing Platform। আইএসবিএন 978-1-4751-7250-8 
  4. Shah 2004, পৃ. 31-32।
  5. Brereton, Joel P.; Jamison, Stephanie W., eds. (2014). The Rigveda: The Earliest Religious Poetry of India. Vol. I. Oxford University Press. pp. 880, 902–905, 923–925, 1015–1016.
  6. শ্রীরামনারায়ণ বিদ্যারত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ। শুকদেব কহিলেন, খট্বাঙ্গ রাজার পুত্র দীর্ঘবাহু...।নবম স্কন্দ, অধ্যায়_১০, শ্লোক_১ 
  7. পঞ্চানন তর্করত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, বিষ্ণুপুরাণম্ , আর্য্যশাস্ত্র। সপ্তর্ষিগণ পুরাকালে এই খট্বাঙ্গদিলীপ সম্বন্ধে এক...।চতুর্থাংশ, অধ্যায়_৪, শ্লোক_৩৯-৪০ 
  8. কালিদাসের, রঘুবংশম। শ্রেয়াংসি সর্বাণ্যধিজগ্মুষন্তে। পুত্রং লভস্বাত্মগুনানুরুপং ভবন্তমীড্যং ভবতঃ পিতেব।। পঞ্চমসর্গ(৩৪ নং শ্লোক হতে)_৮ম সর্গ পর্যন্ত সম্পূর্ণ 
  9. শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন কৃত বঙ্গানুবাদিত, মৎস্যপুরাণম্। অনমিত্র বনগমন করেন, রঘুর দিলীপ নামে এক পুত্র হয়...।অধ্যায়_১২, শ্লোক_৪৮-৪৯ 
  10. নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী সম্পাদিত, পুরাণকোষ(অ-ঔ)। অজ